নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে মঙ্গলবার (২৫ ডিসেম্বর) দুপুরে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বৈঠকে বসেছিলেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। নির্বাচনি প্রচারের সময় নেতাকর্মীদের ওপর আক্রমণ, মামলা, গ্রেফতার, হয়রানি, ভাঙচুর—এসব বিষয়ে কমিশনকে অবহিত করেন তারা। পুলিশ নিরাপত্তা না দিলেও তাদেরকে লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে যেন ব্যবহার করা না হয়, সে ব্যাপারে কমিশনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। প্রধান নির্বাচন কমিশনার আহত ও ভুক্তভোগীদের প্রতি কোনও ধরনের সহানুভূতি বা সহমর্মিতা প্রকাশ না করে উল্টো যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তাদের পক্ষ নেওয়ায় বৈঠক বয়কট করেন ঐক্যফ্রন্ট নেতারা। মঙ্গলবার দুপুর ১২টায় ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে ঐক্যফ্রন্টের একটি প্রতিনিধি দল আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে আসেন। কিন্তু বৈঠক শুরুর ঘণ্টাখানেক পর বেরিয়ে আসেন তারা। এ সময় সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তার সঙ্গে ছিলেন দলের নেতা নজরুল ইসলাম খান, মির্জা আব্বাস, ড. মঈন খান, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এসেছিলাম জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে। সারাদেশে নির্বাচনে যে ভয়াবহ তাণ্ডব চলছে, বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, আক্রমণ, আহত করা, হত্যা করা হচ্ছে এবং নির্বাচনের পরিবেশ যে বিনষ্ট করা হচ্ছে—সেসব ব্যাপারে প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে জানাতে এসেছিলাম। গতকাল (সোমবার) থেকে সারাদেশে নির্বাচনের পরিবেশ যেভাবে অবনতি হয়েছে এবং জনগণের মধ্যে প্রশ্ন এসে গেছে, নির্বাচন আদৌ সুষ্ঠু ও অবাধ হবে কিনা?’. তিনি বলেন, ‘কারণ, নির্বাচন কমিশনে যারা প্রতিনিধিত্ব করেন, রিটার্নিং অফিসার, পুলিশ, র্যাব ও ল অ্যান্ড অর্ডার ফোর্সের যারা আছেন, তাদের যে ভূমিকা, বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের ওপরে আক্রমণ, তাদেরকে আহত করা, তাদেরকে গ্রেফতার করা, পোস্টার ছিঁড়া, গাড়ি ভেঙে দেওয়া—এই পরিস্থিতি প্রধান নির্বাচন কর্মকর্তাকে যখন আমরা জানিয়েছি, তখন আমরা সেই ধরনের আচরণ পাইনি যে, তিনি এটাতে কোনও গুরুত্ব দিচ্ছেন।’ সরকার, নির্বাচন কমিশন যৌথভাবে এ নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করছে বলে মন্তব্য করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘ড. মঈন খান এখানে আছেন, তার পিএস আইসিইউতে। গাজীপুরে আমাদের মিলন (ফজলুল হক মিলন) সাহেব, তাকে তফসিল ঘোষণার পর জেলে নেওয়া হয়েছে। তার স্ত্রী নির্বাচন পরিচালনা করছিলেন। তিনি হামলায় আহত হয়ে আইসিইউতে আছেন। আমাদের এখানে মির্জা আব্বাস আছেন। কতবার তার ওপর, আফরোজা আব্বাসের ওপর তাণ্ডব চালানো হয়েছে। বিষয়টা হচ্ছে, উদ্দেশ্যটা কী? সরকার, নির্বাচন কমিশন যৌথভাবে এ নির্বাচনকে বানচাল করার চেষ্টা করছে। নির্বাচনের ন্যূনতম পরিবেশ তারা সৃষ্টি করতে পারছে না। যদি বলি ব্যর্থ হয়েছে, তাহলে ঠিক বলা হবে না। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে তারা ব্যর্থ করছে, যেন এটা (নির্বাচন) বানচাল হয়ে যায়। সেক্ষেত্রে এই নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হবে, অবাধ হবে, কতটুকু গ্রহণযোগ্য হবে— এ প্রশ্ন ইতোমধ্যে জাতির সামনে এসেছে। আর মাত্র তিন দিন আছে। এই তিন দিনেও যদি গ্রেফতার, অত্যাচার, নির্যাতন, আহত করা বন্ধ না হয়—তাহলে ভোটাররা কীভাবে ভোট দিতে যাবেন। এটা সবচেয়ে বড় প্রশ্ন। ঢাকা শহরে মনে হয় না কোনও নির্বাচন হচ্ছে। প্রতিদ্বন্দ্বী আছে বলেই তো মনে হয় না। নির্বাচন কমিশন ও সরকার এ নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে। জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে কী করা দরকার।’ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, ‘‘আরও দুটো কথা যোগ করা দরকার। কামাল হোসেন সাহেব প্রধান নির্বাচন কমিশনারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন—পুলিশ সর্বত্র লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। মওদুদ বাড়িতে আছে। বাড়ির সামনে গাড়ি আটকে দেওয়া হয়েছে, যাতে বের হতে না পারে। বলা হচ্ছে সিকিউরিটি। এটা কী ধরনের সিকিউরিটি, আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দেবেন না!’ এগুলো জানিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনকে বলা হয়েছে, আপনাকে এতটুকু প্রতিহত করতে হবে পুলিশকে, অন্তত নিরাপত্তা না দিক, সে-তো (পুলিশ) লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে কীভাবে কাজ করে। এতে চিফ কমিশনার সাহেব ক্ষিপ্ত হয়েছেন। দ্বিতীয়ত, যে কথাটা ড. কামাল বলেছেন— আপনি কী নির্বাচন চাচ্ছেন। সুষ্ঠু নির্বাচনে একটা প্রধান বিষয় হলো সাংবাদিকদের সহজ বিচরণ। সাংবাদিকরা যদি সহজ বিচরণ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে আপনারই লাভ হবে। আপনার কাছে তথ্য প্রবাহটা ভালো হবে। আপনি সেটাও বন্ধ করে দিলেন। তাদের যাতায়াত বন্ধ করেছেন। তারা খবর নিতে পারবে না। এসবের তো প্রতিকার পাওয়া দরকার। যেখানে আপনার এসব কথা শোনা প্রয়োজন, সে জায়গায় পুলিশের পক্ষ হয়ে কথা বলছেন। ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, ‘এটা পরিষ্কার হয়ে গেছে, উনি (সিইসি) ওপরের কারও নির্দেশনায় কাজ করছেন। তারা চাইছে, আমরা যেন বলি— এনাফ ইজ এনাফ, আমরা চলে গেলাম। আমাদের বাধ্য করতে চাইছে। এটা কখনও হতে পারে না। নির্বাচন কমিশনের এ ধরনের কার্যক্রমকে আমরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করছি। আমরা বাধ্য হয়ে ওয়াকআউট করে চলে এসেছি।’ এখন কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে, এমন প্রশ্নে ফখরুল বলেন, ‘জনগণ এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা ঐক্যফ্রন্টের সভা করে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবো। তবে এবার ফাঁকা মাঠে গোল দিতে দেবো না।’ ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী যুক্ত করেন, ‘আমরা থাকবোই। মাঠেই আছি।’
সেনাবাহিনী আসার পরও পরিস্থিতির পরিবর্তন কেন হচ্ছে না, এমন প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘এখনও আমরা আশা করি এ পরিবেশের উন্নতি হওয়া উচিত। কিন্তু নির্বাচন কমিশন যদি তার দায়িত্ব পালন না করে, তাহলে তো সেভাবে হবে না। এখন তো দায়িত্ব সব নির্বাচন কমিশনের। সেনাবাহিনী তো আলাদা কিছু না।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, ‘আমাদের অনেক প্রার্থী জেলে, তাদের পরিবারের সদস্যরা প্রচার করতে গিয়ে হামলায় আহত হয়ে আইসিইউতে আছেন। প্রতিদিন অসংখ্য মানুষকে গ্রেফতার ও মারপিট করা হচ্ছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এসব বিষয়ে আলোচনার পর আমরা আশা করছিলাম— যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, যারা আইসিইউতে আছেন, যাদের বাড়িঘর পুড়ে গেছে— তাদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে সিইসি বক্তব্য শুরু করবেন। কিন্তু আমরা দেখলাম উনি ধারেকাছে না গিয়ে, যাদের বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ করছি— তাদের পক্ষাবলম্বন করছেন।’
নজরুল ইসলাম খান আরও বলেন, ‘সেনাবাহিনীকে আমরা চেয়েছি। কিন্তু সেনাবাহিনী এখন নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণে। তারা তাদেরকে কোথাও বের হতে দিচ্ছে না। সেনাবাহিনীকে ক্যাম্পে রেখে, পুলিশ দিয়ে যে অত্যাচারটা বাড়ানো হয়েছে—এটা আসলে সেনাবাহিনীকে হেয় করার চক্রান্ত কিনা, সেটাও বিবেচনার বিষয়।’ ড. মঈন খান বলেন, ‘১১ তারিখ আমার শান্তিপূর্ণ গণসংযোগে আক্রমণ হয়েছে। ১৬ তারিখ আক্রমণ হয়েছে। এরপর গতকাল (সোমবার) আবার আক্রমণ হয়েছে। আমি আজকে প্রধান নির্বাচন কমিশারকে স্পষ্ট করে বলেছি— আমার তো ৭২ বছর বয়স। নিজের জীবন গেলেও সমস্যা নাই। যারা মানবঢাল করে আমার জীবন রক্ষা করেছে, এই কয়েক দিনে তিনবার তারা আমাকে রক্ষা করেছেন, আমি কি তাদের মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেবো? আপনি আমাকে স্পষ্ট বলে দেন, যদি আমাকে বলেন নির্বাচন করতে দেবেন তাহলে আমি করবো। আর যদি না দেন, তাহলে বিকালে প্রেসক্লাবে গিয়ে জানাবো আমার পক্ষে নির্বাচন করা সম্ভব না।’ জবাবে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কী বলেছেন, এমন প্রশ্নে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘জবাব একই ছিল। যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তাদের পক্ষ নিয়ে কথা বলেছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার।’
বার্তা বিভাগ প্রধান