অনেক জল্পনা-কল্পনা, আলোচনা-সমালোচনার অবসান ঘটিয়ে সিলেট-২ আসনে অবশেষে আবারো মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে একাদশ সংসদ নির্বাচনে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়া। ফলে মনোনয়ন বঞ্চিত হয়ে নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ালেন জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, সাবেক এমপি আলহাজ্ব শফিকুর রহমান চৌধুরী ও যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
তবে আওয়ামীলীগে কেউ মনোনয়ন পাওয়ায় আবারো নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন বিশ্বনাথের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান, আলোচিত আওয়ামী লীগ নেতা মুহিবুর রহমান।
এদিকে, নির্বাচনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন অধ্যক্ষ ড. এনামুল হক সরদার। তিনি দলীয়ভাবে আওয়ামী লীগের কেউ না হলেও আওয়ামী ঘরানার ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত। গত জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে আওয়ামীলীগের প্রার্থী এডভোকেট লুৎফুর রহমানের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে পরাজিত হন অধ্যক্ষ ড. এনামুল হক সরদার।
অন্যদিকে, সিলেট-২ আসনে আওয়ামী লীগের মনোনিত নৌকা’র কোন প্রার্থী না থাকায় বিশ্বনাথ-ওসমানীনগর উপজেলায় আওয়ামী লীগ অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মাঝে বিরাজ করছে ক্ষোভ। তারা বর্তমান সাংসদ এহিয়া চৌধুরীকে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে মেনে নিতে নারাজ। তাই অনেকেই ফেসবুকে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করে এহিয়া চৌধুরীকে নিয়ে বিভিন্ন কটুক্তিমূলক মন্তব্য করছেন। ক্ষুব্ধ অনেকেই মহাজোট প্রার্থী এহিয়া চৌধুরীর বিকল্প হিসেবে মুহিবুর রহমান ও অধ্যক্ষ ড. এনামুল হক সরদারকে দেখছেন।
মহাজোটের প্রার্থী এহিয়া চৌধুরীকে ২য় বারের মতো এমপি নির্বাচিত করতে তার পক্ষে এবার শফিকুর রহমান চৌধুরী ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী কি ভূমিকা রাখবেন এবং তাদের অনুসারী বিশ্বনাথ-ওসমানীনগরের আওয়ামী লীগ অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা নির্বাচনী মাঠে মহাজোট প্রার্থীর পক্ষে নাকি মুহিবুর রহমান ও অধ্যক্ষ ড. এনামুল হক সরদারের পক্ষে কাজ করবেন তা দেখার বিষয়। তবে উপজেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র একাধিক নেতা বলেছেন- দলীয় সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও দলীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মহাজোট প্রার্থীর বিরুদ্ধে কাজ করার সুযোগ নেই।
১৯৯১ সালে এ আসনে বিজয়ী হন জাতীয় পার্টির মকসুদ ইবনে আজিজ লামা, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা শাহ আজিজুর রহমান, ২০০১ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হন বিএনপির এম ইলিয়াস আলী। ১৯৯১ ও ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে এই আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে এবং ২০০১ সালে অনুষ্ঠিত ৮ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি থেকে লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে সিলেট-২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন মুহিবুর রহমান। এরপর ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের পূর্বে মুহিবুর রহমান যোগদান করেন আওয়ামী লীগে। যোগদানের পর ঐ নির্বাচনে (২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচন) আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন প্রাপ্তি নিয়ে সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী ও মুহিবুর রহমানের মধ্যে সৃষ্টি হয় দন্ধ। এক পর্যায়ে মুহিবুর রহমান দলীয় মনোনয়ন পেলেও শেষ পর্যন্ত শফিকুর রহমান চৌধুরী দলীয় ও মহাজোটের মনোনয়ন পেয়ে বিএনপির হেভিওয়েট প্রার্থী ইলিয়াস আলীকে ভোটের মাধ্যমে পরাজিত করে চমক সৃষ্টি করেন শফিক চৌধুরী। তখন দলের হাই কমান্ডের নির্দেশে মুহিবুর রহমান সংসদ নির্বাচন থেকে সড়ে দাঁড়ান। এরপর ১০ম সংসদ নির্বাচেন ফের শফিক চৌধুরী ও মহিবুর রহমান মনোনয়ন যুদ্ধে অবতির্ণ হলে বঞ্চিত হন দু’জনই। আসনটি চলে যায় জাতীয় পার্টির কব্জায়। মহাজোটের প্রার্থী হয়ে এমপি হন ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মুহিবুর রহমান বিদ্রুহী প্রার্থী হলেও তিনি পরাজিত হন। নির্বাচনে এহিয়া চৌধুরীর পক্ষে কাজ করেন শফিক চৌধুরী ও যুক্তরাজ্য আওয়ামীলীগের যুগ্ম সম্পাদক আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। কিন্ত সময়ের ব্যবধানে পাল্টে যায় রাজনীতির চিত্র। এহিয়া চৌধুরীর সাথে দূরত্ব সৃষ্টি হয় শফিক চৌধুরীর। ফলে আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এহিয়া চৌধুরীকে ছাড় দিতে নারাজ আওয়ামী লীগ। তাই একদিকে আওয়ামী লীগ তথা মহাজোটের মনোনয়ন পেতে জোর তৎপরতা শুরু করেন শফিকুর রহমান চৌধুরী ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। অন্যদিকে আবারো মহাজোটের মনোনয়ন পেতে জোর লবিং চালান এহিয়া চৌধুরী।
নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর থেকে মহাজোটের মনোনয়ন প্রত্যাশী তিন চৌধুরীকে ঘিরেই চলে নানা হিসাব-নিকাশ। মনোনয়ন পেতে নিজ নিজ অবস্থান থেকে তারা চেষ্টা চালিয়ে যান। কিন্ত সিলেট-২ আসনে আওয়ামীলীগ তাদের দলের প্রার্থী হিসেবে কারো নাম ঘোষণা না করায় এবং আবারো এই আসনটি জাতীয় পার্টির ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে জেনে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন শফিক চৌধুরী ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর অনুসারী নেতাকর্মীরা। তাই দলীয় প্রার্থী ঘোষণার দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধ করেন নেতাকর্মীরা। শেষ পর্যন্ত এহিয়া চৌধুরী মহাজোটের প্রার্থী হচ্ছেন তা প্রায় নিশ্চিত হয়ে মনোনয়ন না পেয়ে গতকাল বুধবার ঢাকা থেকে ফিরে আসেন শফিক চৌধুরী ও আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
এদিকে, ১০ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় কাজ শুরু করেন মুহিবুর রহমান। তিনি যুক্তরাজ্য থেকে দেশে এসে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরীর পক্ষে মাঠে কাজ চালিয়ে যান। কিন্ত আসন্ন নির্বাচনে আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী মনোনয়ন না পাওয়ায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মুহিবুর রহমান নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে গতকাল বুধবার মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
এসময় তিনি সংবাদিকদের বলেন- আমরা আশাবাদি ছিলাম আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করবেন। আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকের কাছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সিলেট-২ আসনে নৌকা দেওয়ার দাবী জানিয়ে আসলেও আসনটিতে মহাজোটের কারণে টানা দ্বিতীয় বারের মতো জাতীয় পার্টির ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এহিয়াকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে। আর তা মানে নিতে পারছেন না আওয়ামী লীগের তৃণমূলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা। তাই আওয়ামী লীগের ঘাটি এই আসনটি পুনরুদ্ধার করতে নেতাকর্মীদের চাপে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে তিনি মনোনয়নপত্র দাখিল করেছেন বলে জানান মুহিব।
নির্বাহী সম্পাদক