বিভিন্ন কারণে হার্টের রক্তনালিতে চর্বি ও রক্ত জমাট বেঁধে রক্তনালিতে ব্লক সৃষ্টি করে হার্টের কোষের মৃত্যু ঘটায়-চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এ অবস্থাকে হার্ট অ্যাটাক বলে। যেমন ডিপটিউবয়েলের পানি চৌবাচ্চায় জমা হয়ে নালা/ড্রেন দিয়ে ধান খেতে যাওয়ার পথ বাধাপ্রাপ্ত হলে ধান মারা যায়-ওকে আমরা ধান অ্যাটাক বলি। ঠিক তেমনি হার্ট অ্যাটাকও তাই। সাধারণত উচ্চরক্ত চাপ, ডায়াবেটিস, ধূমপান, রক্তে খারাপ চর্বি অতিরিক্ত মাত্রা/ভালো চর্বির কম মাত্রা/বংশগত কারণ (মায়ের বয়স ৫০ এর নিচে অথবা বাবার বয়স ৪৫ এর নিচে থাকা অবস্থায় হার্ট অ্যাটাক হলে ওই পরিবারের সন্তানদের অল্প বয়সে হার্ট অ্যাটাকের প্রবণতা বেশি থাকে)। এছাড়া অলস জীবনযাপন, মানসিক চাপ ইত্যাদিও কারণে হার্ট অ্যাটাক বেশি হয়।
হার্ট অ্যাটাক হলে সাধারণত বুকের মাঝখানে ব্যথা/ভারী ভারী ভাব-যা গলা, ঘাড়, পিট/হাতের বাম হাত বেয়ে ছোট আঙ্গুল, বুকের বাম দিক বা ডান দিক হয়েও ডান হাতের আঙ্গুল/এমনকি পেটের উপরিভাগ পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে (অনেকে এ ব্যথাকে গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা মনে করেন), সঙ্গে সঙ্গে অতিরিক্ত ঘাম, বমি, শ্বাসকষ্ট, বুক ধড়ফড়ানিসহ অস্থির ভাব হতে পারে। এমনকি রোগী সঙ্গে সঙ্গে মৃত্যুবরণও করতে পারে। হার্ট অ্যাটাকের শুরু থেকে প্রথম এক ঘণ্টার মধ্যে শতকরা ২৫ জন রোগীর মৃত্যু হয় এবং পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আরও ২৫ জনের মৃত্যু হয়, অর্থাৎ প্রথম ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শতকরা ৫০ ভাগ রোগী মৃত্যুবরণ করতে পারে। তাই এ রোগ হলে প্রথমেই ৩০০ মিলিগ্রাম ইকোসপিরিন, ৩০০ মিলিগ্রাম ক্লোপিডেগ্রেল, ২০ মিলিগ্রাম অ্যাট্রোভাস্টেটিন ২০ মিলিগ্রাম প্যান্টেপ্রাজল খেয়ে নিকটস্থ হাসপাতালে পৌঁছে ইনজেকশন স্টেপটোকাইনেজ দিয়ে দিতে পারলে প্রায় শতকরা ২৫ জন রোগী মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে। পরবর্তীতে করোনারি অ্যানজিওগ্রাম করে হার্টের ব্লকের পরিমাণ ও সংখ্যা নির্ধারণ করে নিম্নোক্ত তিনটি চিকিৎসার মধ্যে একটি নির্ধারণ করতে হয়।
১। ছোট ছোট ব্লকের ক্ষেত্রে প্রধান রক্তনালিতে ৪০% এর নিচে বা শাখা রক্তনালিতে ৭০% এর নিচে থাকলে শুধু ওষুধ দ্বারাই চিকিৎসা নিয়ে রোগী ভালো থাকতে পারে। ২। কিন্তু ব্লকের পরিমাণ প্রধান রক্তনালিতে ৪০% ও শাখা রক্তনালিতে ৭০% বা তার অধিক হলে ব্লকগুলোকে বেলনু দিয়ে পরিষ্কার করে ওইখানে (যা কালভার্টের মতো দেখতে) বসিয়ে দেওয়া হয় অনেকে এ পদ্ধতিকে রিং বসানো বলে তাকে। হার্ট অ্যাটাকের প্রথম ৯০ মিনিট থেকে তিন ঘণ্টার মধ্যে এ পদ্ধতি ব্লক ছুটিয়ে রিং বসিয়ে দিলে সবচেয়ে বেশি উপকার পাওয়া যায়—একেই প্রাইমারি পিসিআই বলে— যা বর্তমান বিশ্বে হার্ট অ্যাটাকের সর্বাধুনিক চিকিৎসা, যা আমরাই এদেশের চিকিৎসকরা অহরহই করে চলেছি।
৩। যেসব ক্ষেত্রে রিং বসানো সম্ভব হয় না সেক্ষেত্রে ব্লকগুলোকে পাশ কাটিয়ে নতুন রাস্তা বানিয়ে রক্ত সামনে নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা হয়— এ পদ্ধতিকে বাইপাস সার্জারি বলে। হার্ট অ্যাটাকের ফলে রক্তনালিতে সৃষ্ট ব্লকের কারণে হার্টের যে অংশ অপর্যাপ্ত রক্ত পায়— সে অংশে উপরোক্ত যে কোনো একটি পদ্ধতিতে সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত পরিমাণ রক্ত সরবরাহ করাই মূল কথা। পুনরায় যাতে ব্লক না হয় সেই জন্য ওষুধ খাওয়াসহ প্রতিদিন এক ঘণ্টা হাঁটাসহ চতুষ্পদী জন্তু, ঘি, পামঅয়েল খাওয়া বন্ধ করতে হবে। খেতে হবে ইলিশ মাছসহ সামুদ্রিক মাছ, শাকসবজি, চামড়া ছাড়া হাঁস-মুরগি ইত্যাদি। সর্বোপরি মানসিক চাপ পরিহার করে সহজ জীবনধারণ করে চলতে পারলে হার্টকে সুস্থ রাখা সম্ভব। হার্ট অ্যাটাক হলে উপরোক্ত তিনটি চিকিৎসার যে কোনো একটি চিকিৎসাই বিজ্ঞানসম্মত, শুধু ওষুধ ও জীবনধারণ পরিবর্তন করে এ চিকিৎসা বিজ্ঞানসম্মত নয়তো বটে বরং এ তত্ত্ব অবাস্তব ও সমাজে ভুল বার্তা প্রেরণ ছাড়া কিছুই নয়। আসুন আমরা এ প্রাণঘাতী রোগ থেকে বাঁচতে সঠিক চিকিৎসার ব্যাপারে সবাই যত্নবান হই।
বার্তা বিভাগ প্রধান