বাঙালির সংস্কৃতি ও সাহিত্যের ইতিহাস হাজার বছরের পুরনো। বিশ্বে বাংলা ভাষা একমাত্র ভাষা যার জন্যে মানুষ প্রাণ দিয়েছে এবং এই বাংলা ভাষার গৌরবোজ্জ্বল অবদানের কারণেই ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের স্বীকৃতি লাভ করেছে। বাংলা ভাষায় আছে দুটি বর্ণমালা। একটি প্রমিত বাংলা এবং অন্যটি সিলেটি নাগরীলিপি। প্রায় ছয়শো বছরের পুরনো নাগরীলিপি বাংলা ভাষাকে সমৃদ্ধ করলেও বলা যায় অজানা কারণে তা অনুচ্চারিতই রয়ে গেছে।
নাগরীলিপি নিয়ে বাংলাদেশ, আসাম এবং যুক্তরাজ্যের কাজগুলোকে গবেষকরা দেখছেন এর নবজাগরণ হিসাবে। নাগরীলিপির জাগরণ এবং এর ব্যবহারে কাজ করছেন দেশ-বিদেশের অনেক গবেষক। শত বছরের বইগুলোর অনুসন্ধান করে বাংলা ও নাগরী বর্ণমালায় বই প্রকাশের কাজটিও অনেক আশাব্যঞ্জক।
ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে নাগরীলিপির অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ বই। নব্বইয়ের দশকে ব্রিটিশ নাগরী গবেষকরা এই নাগরীলিপির কম্পিউটার ফন্ট তৈরি করে ধারাবাহিক গবেষণার মাধ্যমে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
সাহিত্য সংস্কৃতির সংগঠন ‘পলল’ সম্প্রতি পূর্ব লন্ডনের ব্লমোন সেন্টারে আয়োজন করেছিল নাগরীলিপি জাগরণ বিষয়ক একটি মৌলিক অনুষ্ঠানের। শিরোনাম ‘সিলেটি নাগরীলিপি চর্চা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে’। প্যানেল আলোচনায় অংশ নেন ব্রিটেনের শিক্ষাবিদ ও বিশিষ্ট সিলেটি নাগরীলিপি গবেষক ড. সু লয়েড উইলিয়াম ও জেমস লয়েড উইলিয়াম।
সেখানে আরো উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ থেকে আসা সিলেটি নাগরীলিপি গবেষক এবং বর্তমানে নাগরী পুস্তকসমূহের অন্যতম প্রকাশক মোস্তফা সেলিম, শিক্ষাবিদ ও লেখক ড. রেনু লুৎফা, সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক নজরুল ইসলাম বাসন, ৫২বাংলাটিভির সিইও ও প্রধান সম্পাদক ফারুক যোশী। মৌলিক আলোচনার অনুষ্ঠানটির প্রানজ সঞ্চালনায় ছিলেন পলল ও ৫২বাংলাটিভি সম্পাদক আনোয়ারুল ইসলাম অভি।
বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ব্রিটিশ গবেষক এবং নাগরীলিপির কম্পিউটার ফন্ট সুরমার আবিষ্কারক ড. সু লয়েড উইলিয়াম সিলেটি নাগরীলিপির আন্তর্জাতিক ব্যাপ্তি নিয়ে কথা বলেন। জানান, সিলেটি ভাষাকে ব্রিটেনের লোকাল অথরিটি গুরুত্ব দিয়েই বিবেচনা করে। নতুন প্রজন্মরা খুব সহজে এই নাগরীলিপিতে বা সিলেটি ডায়লগে বাংলা শিখতে ও পড়তে পারে।
তিনি এই কাজে সংশ্লিষ্টদের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গী ও নীতিগত কাজে সহযোগিতার প্রতি গুরুত্ব দিয়ে বলেন, সিলেটি ডায়লগে শিক্ষার্থীরা প্রাতিষ্ঠানিক সহযোগিতায় এই ভাষা বিশ্বব্যাপী টিকিয়ে রাখতে পারে।
বাংলাদেশ ও দেশের বাইরের লেখক গবেষকদের সিলেটি নাগরী নিয়ে শ্রম ও সাধনার বিষয়কে কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে ড. সু আরো বলেন, এটাই সিলেটি নাগরীলিপি ও সিলেটি ভাষা বেঁচে থাকার অন্যতম প্রেরণাশক্তি। এই অঞ্চলের মানুষের তাঁর নিজস্ব ভাষার প্রতি গভীর টান ও শ্রদ্ধাবোধ খুব বেশি। আমি বিশ্বাস করি, আগামী ১০ থেকে ২০ বছরের মধ্যে সিলেটি ভাষায় মানুষ আবার লিখবে ও পড়বে।
জেমস লয়েড উইলিয়াম সিলেটি নাগরী লিপি নিয়ে নব্বই দশকে বিলেতবাসী সাংবাদিক মতিয়ার চৌধুরী, ড. সু লয়েড ও তাঁর সিলেটি ট্রান্সলেশন এন্ড রিসার্চ সংক্ষেপে (স্টার) এর কার্যক্রম এবং বাংলাদেশের গবেষক মোস্তফা সেলিম এর কাজের বিভিন্ন দিক তুলে ধরে বলেন, এই ভাষা কোনো দিন মরবে না বা হারিয়ে যাবে না। কারণ দেশ-বিদেশে অসংখ্য মানুষ এই ভাষায় অন্তর দিয়ে কথা বলে।
দ্য স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজ (সোয়াস), ইউনির্ভাসিটি অব লন্ডন থেকে নাগরী ভাষা চর্চা ও বইগুলো প্রকাশের গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, সিলেটি নাগরীলিপি নিয়ে ইউনেস্কোর সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছে এবং আমাকে তারা জানিয়েছে যে এই ভাষার ৫০টি বই প্রকাশের পর তারা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতির বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবে। যা আমাদের নিকট ভবিষ্যতের জন্য সুসংবাদ বয়ে আনবে বলে বিশ্বাস করি।
বাংলাদেশ থেকে আসা মোস্তফা সেলিম নাগরীলিপি নিয়ে গবেষণা ও পুস্তক প্রকাশনার বিষয়গুলো তুলে ধরে বলেন, ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত তথ্য-গ্রন্থগুলোতে দেখা যায়, নাগরীলিপি ও এবং সিলেটি ভাষার ব্যবহার উল্লেখযোগ্য। বাংলা ভাষার দুটি বর্ণমালা প্রতিম বর্ণ এবং সিলেটি নাগরী। নাগরীলিপি বাংলা ভাষারই অবিচ্ছেদ্য অমূল্য সম্পদ। প্রায় ৬ শ বছরের পুরাতন বাংলা সাহিত্যে এর ব্যবহার থাকলে অজানা কারণে এটি গবেষক লেখকদের কাছে উপেক্ষিত ছিলো। ১৯০৫ সালে নাগরীলিপি নিয়ে প্রথম গবেষণা কাজটি করেন গবেষক শ্রী পদ্মনাথ ভট্টাচার্য।
গবেষক সেলিম বলেন, নাগরীলিপির কম্পিউটার ফন্ট থেকে শুরু করে সিলেট বিভাগীয় শহরগুলোতে ঐতিহ্যিক স্থাপনা ও প্রতিষ্ঠানে জায়গা করে নিচ্ছে। দেশের প্রায় সকল প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক্স মিডিয়া এটি নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন এবং আলোচনা গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ ও প্রচার করছে। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রীকেও স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে সিলেটি নাগরীলিপি সংযুক্তের দাবি জানানো হয়েছে। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন বলে আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন।
শিক্ষাবিদ ও লেখক ড. রেনু লুৎফা সিলেটি নাগরিলিপির প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে বিলেতের নতুন প্রজন্মের সিলেটি উপভাষার প্রয়োগ নিয়ে বিভিন্ন সমস্যা এবং সম্ভাবনার দিক তুলে ধরেন। বলেন, বাঙালি নতুন প্রজন্মের অধিকাংশই এখানে প্রমিত বাংলাকে তাদের ভাষা হিসেবে দেখে না। তারা সিলেটের উপভাষাকেই তাদের মায়ের ভাষা হিসেবে দেখে। ব্রিটেনে বাংলাদেশি অরিজিনের পরবর্তী প্রজন্মদের বাংলার প্রতি আকৃষ্ট করতে হলে প্রমিত বাংলা তাদের ওপর চাপিয়ে না দেয়ার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
লেখক ও সিনিয়র সাংবাদিক নজরুল ইসলাম বাসন ব্রিটেনের বাঙালি কমিউনিটিতে সিলেটি আঞ্চলিক বাংলার প্রভাবের কথা উল্লেখ করে সাপ্তাহিক সুরমায় তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। দশ বছরের সুরমা সম্পদানায় তাঁরই লিখিত ‘বইতল’ নাম নিয়ে তাঁর লেখা কলামে এ কমিউনিটির বিভিন্ন সম্ভাবনা এবং অসঙ্গতির কথাগুলো জনমনে রেখাপাত করত। এ ভাষাই ব্রিটেনের কমিউনিটিতে মূল স্পন্দন হিসেবে কাজ করত এবং আজও তা করছে বলে উল্লেখ করেন।
৫২বাংলাটিভি ডটকমের প্রধান সম্পাদক কলামিস্ট ফারুক যোশী আলোচনা সভার শুরুতে ভূমিকা বক্তব্য রাখেন। লিখিত এ বক্তব্যে সিলেটি নাগরীলিপির প্রায় অর্ধশতাব্দিকালেরও বেশি সময় ধরে চলমান গবেষণার কথা তুলে ধরেন তিনি। বক্তব্যে উল্লেখ করেন, বাঙলিদের নিজস্ব ভাষা যেমন বাংলা, ঠিক সেভাবেই আমাদের নিজস্ব বর্ণমালাও আছে। যে বর্ণমালা দিয়ে আমরা লিখি এটা বাংলা। এই পঁচিশ কোটির মাঝে সবাই যে লিখতে পারি তা নয়, অনেক নিরক্ষর লোক আছেন। আবার বাংলাভাষী অনেক প্রাজ্ঞ লোকও আছেন, যারা হয়ত বাংলা লিখতে জানেন না।
সভ্যতার ক্রমবিকাশে দেখা যায়, প্রায় ৬ শ বছর আগেও সিলেটি ভাষার মানুষরা শিক্ষায়-প্রজ্ঞায় নিজস্ব একটা বলয় সৃষ্টি করেছিলেন। সিলেটি নাগরীলিপিতে বাংলা ভাষা চর্চা ও ব্যবহার তারই উজ্জ্বলতম উদাহরণ।
অনুষ্ঠানে একটি প্রামাণ্য চিত্র প্রদর্শন করা হয়। অনুষ্ঠানে গবেষক মোস্তফা সেলিমের উৎস প্রকাশনের মাধ্যমে নাগরীলিপিতে লেখা ২৫টি বই প্রদর্শন করা হয়।
তিন পর্বের অনুষ্ঠানে শেষ অংশে ছিল প্যানেল আলোচকদের সাথে উপস্থিত সুধীবৃন্দের ভাব বিনিময়। এতে অংশ নেন সাংবাদিক কে এম আবু তাহের, কবি আহমেদ ময়েজ, ছড়াকার শাহাদাৎ করিম, কবি তুহীন চৌধুরী, রাবিয়া জামান জোৎস্না, সাবেক কাউন্সিলার সাহেদ আলীসহ অনেকে। শুরুতে স্বাগত বক্তব্য রাখেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক কবি ইকবাল হোসেন বুলবুল।
ভাষা ও শিকড়ের তাগিদে সিলেটি নাগরীলিপি নিয়ে বিলেতে প্রথমবারের মতো আয়োজিত গবেষকদের প্যানেল আলোচনায় বিলেতের বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার নেতৃস্থানীয় প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
নির্বাহী সম্পাদক