মন্ত্রিসভার বৈঠকে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণহানি কিংবা গুরুতর আহত হলে দায়ী চালকের সর্বোচ্চ পাঁচ বছরের কারাদ-ের বিধান রেখে ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’-এর খসড়ার চূডান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।
সচিবালয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘সম্পূরক এজেন্ডা’ হিসেবে আইনটির অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মোহাম্মদ শফিউল আলম প্রেস ব্রিফিংয়ে এ তথ্য জানান। শফিউল আলম জানান, বেপরোয়া গাড়ি চালিয়ে কাউকে গুরুতর আহত বা প্রাণহানি ঘটালে আগে শাস্তি ছিল ৭ বছরের জেল। পরে কমিয়ে ৩ বছর করা হয়। এখন সেটা বাড়িয়ে ৫ বছর করা হয়েছে।
তিনি জানান, আইন অনুযায়ী শাস্তি ৫ বছরের জেল বা জরিমানা বা উভয় দ- হতে পারে। তবে জরিমানার লিমিট (সীমা) উল্লেখ নেই। জরিমানার পরিমাণ সীমাহীন। এ ছাড়া খসড়া সড়ক পরিবহন আইনে দুর্ঘটনার শিকার ব্যক্তি ও তার পরিবারকে সহায়তা দিতে একটি তহবিল গঠনের বিধান রাখা হয়েছে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব। শফিউল আরও জানান, মোটরযান দুর্ঘটনায় আহত বা প্রাণহানি হলে পেনাল কোড অনুযায়ী অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। তবে শর্ত থাকে, পেনাল কোডে যা কিছু থাকুক না কেন অবহেলাজনিত কারণে গুরুতরভাবে আহত বা প্রাণহানি হলে পাঁচ বছরের কারাদ- বা অর্থদ- বা উভয় দ-ে দ-িত হবে। সড়ক সচিব নজরুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া গাড়ি চালানোর শাস্তি সর্বোচ্চ চার মাসের জেল বা ৫০০ টাকা অর্থদ-।
নতুন আইনে এ জন্য ছয় মাসের জেল ও ২৫ হাজার টাকা অর্থদ-ের বিধান রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, নতুন আইনে রেজিস্ট্রেশন ছাড়া গাড়ি চালানোর শাস্তি ছয় মাসের জেল বা ৫০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দ- রাখা হয়েছে। আগে এ অপরাধের সাজা ছিল তিন মাসের জেল বা দুই হাজার টাকা জরিমানা। ফিটনেসবিহীন গাড়ির জরিমানা বর্তমানে সর্বোচ্চ তিন মাসের জেল বা দুই হাজার টাকা জরিমানা থাকলেও নতুন আইনে তা ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দ-ের প্রস্তাব করা হয়েছে।
নজরুল ইসলাম জানান, গাড়ির চেসিস পরিবর্তন, জোড়া দেওয়া, বডি পরিবর্তন করার শাস্তি দুই বছর কারাদ- বা পাঁচ হাজার টাকা অর্থদ- বা উভয় দ- ছিল। সেটা বাড়িয়ে এক থেকে তিন বছরের কারাদ- বা তিন লাখ টাকা অর্থদ- বা উভয় দ-ের বিধান করা হয়েছে। সড়কের ত্রুটির জন্য দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী দায়ী হবেন কিনা এমন প্রশ্নে মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম জানান, তাদের দায়ী করা হবে। কোনো সরকারি কর্মচারী তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব অবহেলা বা ত্রুটিপূর্ণভাবে পালনের জন্য দুর্ঘটনা ঘটলে ওই কর্মচারীকে দায়ী করে প্রচলিত আইনে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। তিনি জানান, চালক নিয়োগে চুক্তি করতে হলে চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্স লাগবে, আর শ্রম আইন অনুযায়ী মালিক ও চালককে চুক্তিপত্র করতে হবে। শফিউল জানান, নতুন আইন পাস হলে ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার জন্য বয়স কমপক্ষে ১৮ বছর হতে হবে। আর পেশাদার ড্রাইভিং লাইসেন্স পেতে চাইলে বয়স হতে হবে ২১ বছর। অষ্টম শ্রেণি পাসের সনদ না থাকলে কেউ ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবে না। প্রত্যেক চালকের ড্রাইভিং লাইসেন্সের বিপরীতে ১২ পয়েন্ট করে বরাদ্দ থাকবে জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, অপরাধ করলে পয়েন্ট কাটা যাবে, পয়েন্ট শূন্য হয়ে গেলে ড্রাইভিং লাইসেন্স বাতিল হবে। লাইসেন্সধারী ব্যক্তি অপ্রকৃতস্থ, অসুস্থ, শারীরিক বা মানসিকভাবে অক্ষম, মদ্যপ বা অপরাধী হলে সরকার তার ড্রাইভিং লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করার ক্ষমতা রাখে। খসড়া আইনে সরকারি, লাশ বহনকারী ও সৎকারে নিয়োজিত, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, অ্যাম্বুলেন্স এবং রেকারগুলোকে রুট পারমিট থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। নতুন আইন অনুযায়ী কর্তৃপক্ষ দেশের যে কোনো এলাকার জন্য যে কোনো ধরনের মোটরযানের সংখ্যা নির্ধারণ করে দিতে পারবে বলেও জানান শফিউল আলম। চালক ও তার সহকারীদের যথাযথভাবে রেস্ট হয় না, তাদের সুবিধার জন্য সরকারি প্রজ্ঞাপন দ্বারা শ্রম আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কর্মঘণ্টা ও বিরতিকাল নির্ধারণ করে দেওয়া যাবে। নিয়োগকারী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে আবশ্যিকভাবে সেই কর্মঘণ্টা বা বিরতিকাল মেনে চলতে হবে। আইনে মোটরযানের গতিসীমা, শব্দমাত্রা এবং পার্কিংয়ের বিষয়ে বিস্তারিত বলা আছে। মোটরযান চলাচলে সাধারণ নির্দেশাবলি আছে উল্লেখ করে শফিউল বলেন, মদ বা নেশা জাতীয় দ্রব্য সেবন করে কেউ গাড়ি চালাতে পারবে না। নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করে চালকের সহকারী গাড়িতে অবস্থান করতে পারবে না। চালকের সহকারীদের যানবাহন চালানোর দায়িত্ব দেওয়া যাবে না। সড়ক বা মহাসড়কে উল্টো পথে গাড়ি চালাতে পারবে না। মোটরযান চালানোর সময় চালক মোবাইল ফোন বা অনুরূপ কোনো কিছু ব্যবহার করতে পারবে না। এ ছাড়া সিট বেল্ট বাঁধা; যান চলাচলে যাত্রীরা যাতে চালককে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করেন; মহিলা, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়োজ্যেষ্ঠ যাত্রীদের জন্য সংরক্ষিত আসনে যাতে অন্য কেউ না বসতে পারেন এবং যাত্রীদের সিটবেল্ট বাঁধার বিষয়ে নির্ধারিত বিধান অনুসরণে নির্দেশনা রয়েছে বলে জানান মন্ত্রিপরিষদ সচিব। প্রস্তাবিত আইনে দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের আর্থিক ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিধান আছে উল্লেখ করে মন্ত্রিপরিষদ সচিব জানান, সরকারি অনুদানের পাশাপাশি মোটরযানের মালিকের কাছ থেকে আদায়কৃত চাঁদা, এই আইনের অধীন জরিমানার অর্থ, মালিক সমিতির অনুদান, মোটর-শ্রমিক ফেডারেশন বা সংগঠনের অনুদান বা অন্য যে কোনো বৈধ উৎস থেকে পাওয়া অর্থ নিয়ে এই তহবিল গঠন করা হবে। তিনি আরও জানান, সড়ক দুর্ঘটনা ঘটলে সংশ্লিষ্ট চালক ও তার সহকারীরা তাৎক্ষণিকভাবে নিকটস্থ থানা এবং ক্ষেত্রমতে ফায়ার সার্ভিস, চিকিৎসাসেবা ও হাসপাতালকে জানাবে। আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তি নিকটস্থ সেবাকেন্দ্র বা হাসপাতালে সেবা পাবেন। প্রসঙ্গত, পরিবহন নেতাদের আপত্তিতে আট বছর ধরে ঝুলছিল সড়ক পরিবহন আইনটি। অবশেষে নিরাপদ সড়কের দাবিতে চলমান ছাত্র আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে মন্ত্রিসভা আইনটির অনুমোদন দিল।’