Home » হজ মানবাধিকারের স্মারক

হজ মানবাধিকারের স্মারক

হজ, এক প্রেমময় ইবাদতের নাম। বিশ্ব মুসলিমের এক মহাসমাবেশ, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের, বিভিন্ন বর্ণের, ভাষা এবং আকার-আকৃতির মানুষ একই ধরনের পোশাকে সজ্জিত হয়ে একই কেন্দ্রবিন্দুতে সমবেত হন। আল্লাহ প্রেমের চূড়ান্ত উন্মাদনার এই পবিত্র সফরে নেই কোনো পার্থিব চাওয়া-পাওয়া, নেই কোনো লক্ষ্য, শুধুমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টিই কাম্য। আল্লাহর নির্দেশে সমগ্র বিশ্বমানবকে আপন করে পাওয়ার আকুতিটুকুই পরম পাওয়া হয়ে দাঁড়ায়। এভাবেই হৃদয়ে গভীরে অঙ্কুরিত হয় বিশ্ব মুসলিমের ঐক্যের অদৃশ্য চারাগাছ।

মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইবরাহিম (আ.) আল্লাহর নির্দেশে বাইতুল্লাহকে পূননির্মাণ করে তার নির্মাণকে কবুল করে তার শ্রমকে স্বার্থক করার জন্য যখন মহান আল্লাহ তায়ালার দরবারে দোয়া করলেন। আল্লাহ তায়ালা ইবরাহিমকে (আ.) তার দুআ কবুল করে নিদের্শ দিলেন, ‘আর হে (ইবরাহিম! তুমি) মানুষের মাঝে হজের ঘোষণা দাও। তারা দূর-দূরান্তের আনাচে কানাচ থেকে তোমার কাছে আসবে হেঁটে। আসবে সর্বপ্রকার ক্ষীণকায় উষ্ট্রসমূহের পিঠে সওয়ার হয়ে। (সুরা হজ: ২৭) সেই থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের লাখো মানুষ একত্র হয় বাইতুল্লাহর পানে। পৃথিবীর ইতিহাসে হজই পথিবীর একমাত্র বড় মানবসমাবেশ। মানবেতিহাসে হজের মতো এতবড় জনসমাগমের নজির নেই কোথাও। যুক্তরাষ্ট্রের প্রগ্রেসিভ পলিসি ইনস্টিটিউটের ‘ট্রেড ফ্যাক্ট অব দ্য উইক’ প্রকাশনায় ২০০৯ সালেই বিশ্বের সবচেয়ে বড় একক অনুষ্ঠানের স্বীকৃতি দেয়া হয় হজকে। ৩০ লক্ষাধিক মানুষের ‘লাব্বাইকের’ এই মিছিলে বাংলাদেশীদের অংশগ্রহণও কম নয়। সরকারি ও বেসরকরি ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ থেকে এ বছর হজ করবেন ১ লাখ ২৭ হাজার ১৯৮ জন হাজি। ”জেই চিরন্তন মানবাধিকারের ঘোষণা করেছিলেন বিশ্ব মানবতার পরম বন্ধু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সা.। দেড় হাজার বছর আগেই তিনি মরুভূমির প্রান্তে দাঁড়িয়ে কোরআন হাতে নিয়ে তিনিই ঘোষণা করেছিলেন সর্বজনিন মানবাধিকার। নারী নির্যাতনের অপ্রতিরোধ্য সাইক্লোন থামানোর পাশাপাশি শিশু এবং শ্রমিকের অধিকারের ব্যাপারেও তিনি ছিলেন আপোসহীন। উচু-নিচু, ধনী-গরিব, আমির-ফকির সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজে তার বাস্তব চর্চা শিক্ষা দিয়েছেন।”

বড়লোক হলেই নামাজের সামনের কাতারে দাঁড়ানোর সুযোগ নেই। আবার গরিব হওয়ার কারণে নামাজে পেছনের কাতারে দাঁড়াতে হবে এমন নিয়মও নেই। একজন ফকির আর আমির উভয়ই নামাজের কাতারে দাঁড়ানোর ব্যাপারে সমান অধিকার ভোগ করেন। ফকিরও যদি আগে আসেন তাহলে তিনিই সামনের কাতারে দাঁড়াবেন। পক্ষান্তরে শাসকও দেরিতে আসলে শাসক বলেই সামনের কাতারে দাঁড়ানোর বিধান নেই ইসলামে। তাকে পেছনের কাতারেই দাঁড়াতে হবে। ইসলামের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ ও মানব ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সমাবেশ হজেও মানবাধিকারের চর্চা হয় বাস্তবভাবে। আদিকাল থেকেই শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গের দ্বন্দ্ব চলে এসেছে। শুধু কালো হওয়াকেই অপরাধ হিসেবে দেখার নজির পৃথিবীতে নতুন নয়। যারা মানবাধিকারের জন্য চিতকার করে পৃথিবী কাঁপিয়ে দিচ্ছেন তাদের দেশেও শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গের দ্বন্দ মেটেনি আজো। খোদ মার্কিন মুল্লুকে বারাক ওবামার ২০০৮ সালের প্রেসিডেন্ট হওয়ার ৫ বছর আগেও শুধু কালো হওয়ার অপরাধে কৃষ্ণাঙ্গদেরকে হত্যা করা হতো। মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গদের ভালো স্কুলে ভর্তি হওয়া, পাবলিক গাড়িতে উঠা এমনকি ভালো রেস্টুরেন্টে প্রবেশেরও সামজিক অধিকার ছিল না। এমেরিকার ইতিহাসে ১৯৬৩ সালের ১৮ আগস্ট মার্টিন লুথার কিং ওয়াশিংটন ডিসিতে এক সমাবেশে প্রথমবারের মতো ঘোষণা করেন যে, কৃষ্ণাঙ্গরাও মানুষ, তাদেরও সব সামাজিক অধিকার আছে। কিন্তু মার্টিন লুথার কিংবা নেলসন ম্যান্ডেলারও প্রায় দেড় হাজার বছর আগেই প্রিয়নবী (সা.) ৬৩২ খৃস্টাব্দে বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে বর্নবাদী বৈষম্যকে সমূলে উৎপাটন করে দিয়েছিলেন। এক লাখ চব্বিশ হাজার সাহাবির সামনে সেদিন তিনি ঘোষণা করেছিলেন সর্বজনিন মানবাধিকারের সনদ। হজরত আব্দুর রহমান (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে এসেছে, মানবাধিকারের শাশ্বত ঘোষণা হিসেবে ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত ঐতিহাসিক সে ভাষণের চুম্বক অংশ ছিল, ‘আজ থেকে বংশগত কৌলিন্য বিলুপ্ত হলো। কৃষ্ণাঙ্গের ওপর শ্বেতাঙ্গের কোনো শ্রেষ্ঠত্ব নেই। যে ব্যক্তি স্বীয় কাজের দ্বারা শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করবে, তারাই আল্লাহর কাছে বেশি মর্যাদাবান। (মুসলিম: ১/৩৯৪) তার দুনিয়া কাঁপানো ঘোষণার ফলে সেই বর্বর যুগেও আরবের তপ্ত বালুকারাশিতে প্রস্ফুটিত প্রকৃত মানবাধিকারের স্বর্গোদ্যান।”

যেখানে ইসলাম অনুপস্থিত সেখানে আজো বর্ণবৈষম্য তীব্র। সভতার দাবীদার বৃটেনে কৃষ্ণাঙ্গরা এখনো তীব্র বর্নবাদী বৈষম্যের শিকার হচ্ছে। দেশটির ‘সমতা ও মানবাধিকার কমিশনের’ তথ্যমতে চাকরি, আবাসন, মজুরি এবং অপরাধের বিচারের মতো কয়েকটি খাতে কৃষ্ণাঙ্গরা তীব্রভাবে বঞ্চিত। শ্বেতাঙ্গের চেয়ে কৃষ্ণাঙ্গদের খুন হওয়ার ঝুকি তিনগুণ বেশি। সমান প্রাতিষ্ঠানিক অর্জনের পরও কর্মক্ষেত্রে একজন কৃষ্ণাঙ্গের আয় শ্বেতাঙ্গ ব্যক্তির চেয়ে ২৩.১ শতাংশ কম। (দৈনিক কালের কণ্ঠ: ১৯-০৮-২০১৬) অথচ সেই দেড় হাজার বছর ধরে মুসলমনারা শ্বেতাঙ্গ কৃষ্ণাঙ্গের মধ্যে সমতার বাস্তব দৃশ্য ফুটিয়ে তুলছে হজের মাধ্যমে । হজের ড্রেসকোড প্রতিবছর আমাদেরকে বিশ্বনবীর সেই ঘোষণার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হজ ও উমরায় শাসক-শাসিত আর শ্বেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ সবাই আভিজাত্যকে ভুলে গিয়ে নিজেদেরকে এহরামের অভিন্ন সাদা পোষাকে জড়িয়ে একাকার হয়ে যায়। প্রেসিডেন্টের পোশাকেরও আলাদা কোনো বৈশিষ্ট্য নেই। যে দেশের নাগরিকই হোক না কেন একই বাক্য উচ্চরণ করতে হয়। এমনটি নয় যে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা বৃটেনের নাগরিকরা তালবিয়া পড়বে একভাবে আর অন্য দেশীদের জন্য ভিন্ন বাক্যের তালবিয়া। সাদা-কালোর পোশাক আর মুখের ভাষার অভিন্নতা এভাবেই হজ আজো মানবাধিকারের স্মারক হয়ে আছে।”

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *