Home » রোহিঙ্গাদের চোখে আনন্দের অশ্রু এনেছে মিয়ানমারের চিঠি

রোহিঙ্গাদের চোখে আনন্দের অশ্রু এনেছে মিয়ানমারের চিঠি

ডেস্ক নিউজ: 

নিরাপত্তাবাহিনীর তল্লাশি চৌকিতে হামলার পর গত বছরের আগস্টের শেষ সপ্তাহে রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর পূর্ব পরিকল্পিত ও কাঠামোবদ্ধ সহিংসতা জোরোলো করে মিয়ানমার। নিপীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে থাকে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। পৃথিবীর সবচেয়ে বিপন্ন জাতিগোষ্ঠীর পরিচয় পাওয়া রোহিঙ্গাদের বয়ানে উঠে আসতে থাকে রাখাইনে স্থানীয়দের সঙ্গে নিয়ে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর চালানো নৃশংসতার চিত্র। এই বছরের ২১ থেকে ২৪ জানুয়ারি এপিএইচআর বাংলাদেশের শরণার্থী শিবিরে তদন্তমূলক অনুসন্ধান চালায়। অনুসন্ধান শেষে দেওয়া প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সরকারি তথ্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে পালিয়ে আসা ২৮ হাজার তিনশো রোহিঙ্গা শিশু নিজেদের বাবা-মায়ের কমপক্ষে একজনকে হারিয়েছে। এছাড়া শিবিরের সাত হাজার সাতশো শিশু বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছে। আর এই দুই সংখ্যা মিলিয়ে রোহিঙ্গা শিশুর নিখোঁজ হওয়া বাবা-মায়ের সংখ্যা ৪৩ হাজার সাতশো।  আন্তর্জাতিক রেডক্রস গত আগস্ট মাস থেকে বাংলাদেশের রোহিঙ্গাদের কাছ থেকে প্রায় ১৬০০টি বার্তা সংগ্রহ করেছিল। এগুলোর মধ্যে ১৬০টির মতো বার্তা চিঠির মাধ্যমে মিয়ানমারের কারাগারে বন্দি রোহিঙ্গা প্রাপকদের কাছে পৌঁছানো সম্ভব হয়। আর তারপর মিয়ানমার থেকে সেসবের উত্তর আসে বাংলাদেশে থাকা স্বজনদের কাছে। রোহিঙ্গাদের ভাষার লিখিত রূপ নেই। তবে কেউ কেউ বার্মিজ ও ইংলিশ ভাষা জানেন। বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবির থেকে সংগ্রহ করা চিঠিগুলো ইংরেজিতে লিখেছেন রেডক্রসের কর্মীরা। রোহিঙ্গাদের কথা বুঝতে তারা সহায়তা নিয়েছিলেন দোভাষীর। অপরদিকে মিয়ানমার কারাগার থেকে আসা চিঠিগুলো ছিল বার্মিজ ভাষায় লেখা। কারাগার থেকে পাঠানো চিঠি যাচাই-বাছাইয়ের মধ্যে দিয়ে যায়। কারা কর্তৃপক্ষ যাচাই প্রক্রিয়া শেষে চিঠিগুলো যেন স্বজনদের কাছে পাঠাতে দেয় তা নিশ্চিত করতেই চিঠিগুলো বার্মিজ ভাষায় লেখা। স্বাভাবিকভাবেই সেসব চিঠিতে পারিবারিক প্রসঙ্গ ছাড়া অন্য কিছুর কথা উল্লেখ করা সম্ভব হয়নি। মিয়ানমারের সরকারি ভাষ্য, সশস্ত্র রোহিঙ্গাদের সংগঠন ‘আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মির’ (আরসা) সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে মোট ৩৮৪ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়েছে। যদিও মিয়ানমার ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন জানিয়েছে, রাখাইনের সিতওয়ে ও বুথিডং কারাগারে ২ হাজার ৭০০ জন আটক রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, এদের মধ্যে কতজন রোহিঙ্গা তা তারা আলাদা করে উল্লেখ করেনি। মিয়ানমার থেকে চিঠি পাওয়া এমন একজন ৫৮ বছর বয়সী সইত বানু। মিয়ানমারের কারাগারে আটক থাকা তার স্বামী চিঠিতে বলেছেন, উপযুক্ত পাত্র পেলে সইত বানু যেন তাদের মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন। হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট, জীবন্ত পুড়িয়ে মারার মতো ঘটনা ঘটানো মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হাতে আটক থাকলেও, তিনি স্ত্রীকে আশ্বস্ত করতে লিখেছেন, ‘চিন্তা করো না। জেলে কোনও অসুবিধা নেই।’ গত আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর ওই চিঠি পেয়েই সইত বানু জানলেন, তার স্বামী জীবিত রয়েছেন। সইত বানু  বলেছেন, তার স্বামীকে রাখাইন থেকে যেদিন ধরে নিয়ে যাওয়া হয়, সেদিন একই সঙ্গে গ্রামে মোট ৫০ জনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাদের ধরে নিয়ে যাওয়ার কোনও কারণ বলা হয়নি। গত বছরের ২৫ আগস্ট ৩০ পুলিশ চৌকিতে হামলা হওয়ার কয়েকদিন আগে এই গ্রেফতারের ঘটনা ঘটে। মিয়ানমার থেকে স্বজনদের কাছে পাঠানো চিঠিতে কেউ কেউ বলেছেন, ‘আমার তিন বছরের জেল হয়েছে। কিন্তু আমাকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করো না।’ আরেকজন লিখেছেন, ‘আমরা সবসময় তোমাদের অভাববোধ করি। আর আমি জানি তোমরাও আমাদের অভাব বোধ করো।’ আরেকটি চিঠিতে লেখা হয়েছে, ‘সবার ছবি পাঠিয়ো। তোমাদের সবাইকে দেখতে পারলে খুব ভালো লাগবে। ছেলেমেয়েদের খবর জানিয়ো।’
সম্প্রতি বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি বুথিডং জেলে থাকা ১৬ রোহিঙ্গার খবর নিয়ে যান জাদিমুরা শিবিরে। তাদের পাশে জড়ো হওয়াদের মধ্যে একজন ছিলেন ৭০ বছরের অলি মিয়া। আর সবার মতো নাম পরিচয় শোনার পর তিনিও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না, তার ছেলে চিঠি পাঠিয়েছে। দ্বিতীয়বার নাম-পরিচয় নিশ্চিত করার পর তার বিশ্বাস হয়। ওই চিঠিতেই তিনি জানতে পারেন, তার ছেলে জীবিত। ৩৫ বছর বয়সী ছেলেকে ২০১৬ সালে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ছেলের কথা জেনে তার চোখ ছলছল করে ওঠে। লাঠিতে ভর দিয়ে তিনি এগিয়ে যান ঘরের দিকে; স্ত্রীকে ছেলের সংবাদ জানাতে।  কথা বলতে বলতে অলি মিয়ার চোখ দিয়ে টপটপ করে অশ্রু ঝরে পড়তে থাকে তার হাতের ওপর। তিনি বলতে থাকেন, ‘যদি আমার ছেলে এখানে থাকত, তাহলে আমাকে খাবারের জন্য ত্রাণের লম্বা লাইনে ঘন্টার পর ঘণ্টা দাঁড়াতে হতো না।’ তার স্ত্রী রোশান বেগম বললেন, ‘আমি আমার ছেলের কাছে চিঠি লিখব। আমি তাকে বলব, আমি তার কণ্ঠস্বর শুনতে চাই। আমি তাকে জানাতে চাই, তার বাবা-মা বেঁচে আছে।’ অলি মিয়ার মতো তার স্ত্রী রোশান বেগমের অশ্রুও বাঁধ মানছিল না।

 

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *