অনলাইন ডেস্ক: নিপাহ ভাইরাস এখন বাংলাদেশে একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখা দিচ্ছে। ২০২৪ সালে জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া পাঁচজনের সবাই মারা গেছেন। এর অর্থ, এ বছরের মৃত্যুর হার শতভাগ, যা অত্যন্ত ভীতিকর। আগের বছর, ২০২৩ সালে, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন ১৩ জন, যার মধ্যে ১০ জনের মৃত্যু হয়। সে সময় মৃত্যুর হার ছিল ৭৭ শতাংশ। এ বছর তা বেড়ে ১০০ শতাংশে পৌঁছেছে, যা আমাদের সবাইকে সতর্কতার বার্তা দেয়।নিপাহ ভাইরাস কোনো নতুন রোগ নয়। এটি প্রথম শনাক্ত হয় ১৯৯০ সালে মালয়েশিয়ায়। বাংলাদেশে এ রোগ প্রথম ধরা পড়ে ২০০১ সালে। তখন থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে মোট ৩৪৩ জন নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এ রোগে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে। এটি অত্যন্ত উদ্বেগজনক একটি বিষয়। তবে, দুঃখজনক সত্য হলো, এ রোগ সম্পর্কে সাধারণ মানুষ এখনও যথেষ্ট জানে না।
আমরা জানি, নিপাহ ভাইরাসের প্রধান বাহক হলো বাদুড়। বিশেষ করে খেজুর গাছে থাকা বাদুড়ের মাধ্যমে এই ভাইরাস মানুষের মধ্যে ছড়ায়। বাদুড় যখন খেজুরের রস পান করে, তখন তাদের লালার সঙ্গে ভাইরাস মিশে যায়। সেই রস যদি কাঁচা অবস্থায় মানুষ পান করে, তাহলে তারা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। শীতকালে খেজুরের রস সংগ্রহ ও পান করার রীতি বাংলাদেশের অনেক এলাকায় একটি ঐতিহ্য হিসেবে প্রচলিত। কিন্তু এটি এখন বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শীতকালই নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ সময়। এই সময়ে খেজুরের রস পান করার প্রবণতা বেশি। শুধু খেজুরের রসই নয়, বাদুড়ের মাধ্যমে সংক্রমিত অন্যান্য ফল বা খাবার থেকেও এ ভাইরাস ছড়াতে পারে। ফলে সচেতনতা ও প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরি।
চিকিৎসকদের মতে, নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর প্রধান উপসর্গ হলো এনকেফেলাইটিস, যা মস্তিষ্কের প্রদাহ সৃষ্টি করে। এর ফলে রোগীর জ্বর, শ্বাসকষ্ট, এবং খিঁচুনির মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। অনেক সময় রোগী অজ্ঞান হয়ে যান বা আবোল-তাবোল কথা বলতে থাকেন। এ ধরনের উপসর্গ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া এবং রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। রাজধানীর ক্ষেত্রে আইসিডিডিআর’বি নিপাহ রোগীর চিকিৎসার জন্য একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠান।
নিপাহ ভাইরাসের জন্য বর্তমানে কোনো নির্দিষ্ট ওষুধ বা টিকা নেই। রোগটি ধরা পড়লে শুধু উপসর্গ দেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এ কারণে রোগটি মোকাবিলায় প্রতিরোধই সবচেয়ে কার্যকর উপায়।
সাধারণ মানুষকে নিপাহ ভাইরাস সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। খেজুরের রস কাঁচা অবস্থায় পান করা বন্ধ করতে হবে। রস সংগ্রহের সময় গাছে ঢাকনা দিয়ে বাদুড়ের প্রবেশ বন্ধ করা যেতে পারে। এছাড়া বাদুড় দ্বারা সংক্রমিত ফল বা খাবার খাওয়া থেকেও বিরত থাকতে হবে।
আশার কথা হলো, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, থাইল্যান্ডসহ মোট চারটি দেশে নিপাহ ভাইরাসের টিকা তৈরির কাজ চলছে। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন, ২০২৭ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে এই টিকা বাজারে আসতে পারে। কিন্তু টিকা আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সচেতন থাকতে হবে এবং ভাইরাসটির ঝুঁকি মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।
ডেঙ্গুর মতো নিপাহ ভাইরাসও আমাদের স্বাস্থ্য খাতের ওপর বিশাল চাপ সৃষ্টি করতে পারে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবে ভুগছে। এর সঙ্গে নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ বেড়ে গেলে তা জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য মারাত্মক বিপর্যয় ডেকে আনবে।
নিপাহ ভাইরাস মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে আরও বিনিয়োগ প্রয়োজন। চিকিৎসকদের জন্য বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালগুলোতে নিপাহ রোগীর জন্য আলাদা চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আক্রান্ত ও তার পরিবারকে সচেতন করতে হবে। এই রোগের ক্ষেত্রে সঠিক সময়ে চিকিৎসা শুরু করলে অনেক সময় রোগীর প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হতে পারে।
তাই নিপাহ ভাইরাসের ঝুঁকি মোকাবিলায় সামাজিক সচেতনতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। গ্রামের মানুষদের এই রোগ সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে শীতকালে খেজুরের রস পান করার ক্ষতিকর দিকগুলো তাদের জানাতে হবে। স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও স্বাস্থ্যকর্মীদের এই প্রচারণায় ভূমিকা রাখতে হবে।
স্কুল, কলেজ, এবং কমিউনিটি সেন্টারগুলোতে নিপাহ ভাইরাসের বিষয়ে সচেতনতা সেমিনার আয়োজন করা যেতে পারে। রেডিও, টেলিভিশন, এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
নিপাহ ভাইরাস মোকাবিলায় একটি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেওয়া জরুরি। গবেষণা ও উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে টিকা তৈরির প্রচেষ্টাকে আরও জোরদার করতে হবে।
স্বাস্থ্য খাতে আরও দক্ষ জনবল তৈরির পাশাপাশি জনগণের জন্য সহজলভ্য চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার উন্নয়নই নিপাহ ভাইরাসের মতো রোগ মোকাবিলার চাবিকাঠি।
পরিশেষে বলা যায়, নিপাহ ভাইরাস এখনই নিয়ন্ত্রণে না আনলে এটি বাংলাদেশের জন্য একটি বড় স্বাস্থ্য সংকট তৈরি করতে পারে। এ রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি, প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, এবং যথাযথ চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে। একযোগে সরকার, চিকিৎসক, এবং সাধারণ জনগণের প্রচেষ্টায়ই আমরা এই ভাইরাসের ঝুঁকি কমিয়ে আনতে পারব। আসুন, সবাই মিলে একটি নিরাপদ এবং সুস্থ বাংলাদেশ গড়ে তুলি।
প্রতিনিধি