গত দুই মাস ধরে অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার, মাদক কারবারি ও বিভিন্ন অপরাধীর বিরুদ্ধে সারা দেশে চলছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর যৌথ অভিযান। এসব অপরাধীদের ঠেকাতে সম্প্রতি নিরাপত্তা জোরদারের পাশাপাশি অভিযানের গতি আরও বাড়ানো হয়েছে। ঢাকা মহানগর এলাকায় ছিনতাই-ডাকাতি প্রতিরোধে পুলিশকে টহল দিতে ৩০০ মোটরসাইকেল দেওয়া হয়েছে। যৌথ অভিযানে কিছু এলাকায় ব্লক রেড ও কম্বিং অপারেশন (চিরুনি অভিযান) পরিচালনা করা হচ্ছে। অপরাধী যত প্রভাবশালী হোক, যে দলেরই হোক, ছাড় না দেওয়ার কথা বলছে প্রশাসন। এমন কঠোর অভিযানের মধ্যেও রাজধানীর কোথাও কোথাও হানা দিচ্ছে দুষ্কৃতকারীরা।
পুলিশের দাবি, ৫ আগস্টের পর থানায় থানায় পুলিশ কর্মকর্তা-সদস্য বদলি হয়েছে। বদলি হওয়া এসব কর্মকর্তা-সদস্যরা থানা এলাকায় অলিগলি চিনতে কিছু দিন সময় লেগেছে। এছাড়া এ সময় তাদের সোর্সও ঠিকমতো গড়ে ওঠেনি। তাই মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে তাদের বেগ পেতে হয়েছে। আর সে সুযোগে অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কিছু এলাকায় গড়ে উঠেছে নতুন সন্ত্রাসী গ্রুপ। তবে এসব দুষ্কৃতকারী ও সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে এখন সক্ষম হচ্ছে তারা।
সম্প্রতি মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই, ডাকাতি, সন্ত্রাসীসহ কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেড়ে যাওয়ায় বাসিন্দাদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। পরে দুষ্কৃতকারীদের লাঘাম টানতে মোহাম্মদপুর এলাকায় নিরাপত্তা জোরদার করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। গত কয়েকদিনে যৌথ অভিযানে এসব অপরাধীদের অনেকেকে গ্রেফতারও করা হয়েছে।
এমন অভিযানের মধ্যেও দিন দুপুরে গত ৫ নভেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরের মোহাম্মদী হোমস আবাসিক এলাকার একটি বাসায় দুর্ধর্ষ চুরির ঘটনা ঘটে। ওই এলাকার মাহমুদা ইসলাম ভিলা নামের একটি ভবনে বোরকা পরে নারী সেজে চার ফ্ল্যাটের স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়। এ বিষয়ে ঘটনার দিন ডিএমপির মোহাম্মদপুর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন ভবনটির মালিক বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সাবেক পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. নুরুল ইসলাম মিঞা।
নুরুল ইসলাম মিঞার মেয়ে লিখন ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে আমরা এই এলাকায় এ বাড়িতে বসবাস করছি। এরকম ঘটনা আগে কখনও ঘটেনি। দুপুর ২টার সময় ঢুকে ভবনের নিচ তলা, দ্বিতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম তলার চারটি ফ্ল্যাটে হানা দেয়। তালা ভেঙে এসব ফ্ল্যাট থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার নিয়ে যায়। যাওয়ার সময় সিসিটিভির মেমোরি কার্ডটাও খুলে নিয়ে যায়। আমরা পুলিশকে জানিয়েছি। এখন আতংকের মধ্যে আছি। নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’
এর আগের দিন ৪ নভেম্বর রাজধানীর গেন্ডারিয়া ডিআইটি প্লট এলাকার সতীশ সরকার রোডের একটি বাসায় দুপুর ১২টায় একই ধরনের ঘটনা ঘটে। ছয় তলা ভবনের ৩ তলার একটি ফ্ল্যাটের তালা ভেঙে স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা লুট করে নিয়ে যায়।
ভুক্তভোগী সুমন হোসেন বলেন, ‘আমরা স্বামী-স্ত্রী সকালে অফিসের কাজে বের হই। ফিরে এসে দেখি ঘরের তালা ভাঙা ও ভেতরে সব কিছু এলোমেলোভাবে পড়ে আছে। পরে বুঝতে পারি বাসায় চুরি হয়েছে।’
তিনি দাবি করেন, নগদ টাকা ও স্বর্ণালঙ্কারসহ তার সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে গেছে।
এর আগে ১১ অক্টোবর রাতে মোহাম্মদপুর বেড়িবাঁধ এলাকায় ব্যবসায়ী আবু বকরের বাসায় ও কার্যালয়ে ডাকাতি হয়। সেনাবাহিনী ও র্যাবের পোশাক পরা ডাকাতেরা নিজেদের যৌথ বাহিনীর সদস্য পরিচয় দিয়ে ৭৫ লাখ টাকা ও ৭০ ভরি সোনা লুট করে নিয়ে যান। এই ঘটনায় জড়িত অনেককে শনাক্ত করে দ্রুত গ্রেফতার করা হয়। এসব ঘটনার সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চাকরিচ্যুত সদস্যদের কারও কারও জড়িত থাকার খবরও পাওয়া যায়।
এছাড়া গত ৩০ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুর পল্লবী এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই মাদক কারবারি গ্রুপের গোলাগুলিতে আয়েশা আক্তার (২৬) নামে এক নারী নিহত হয়েছেন। পরের দিন ৩১ অক্টোবর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্পে বোমা হামলায় রাজ ওরফে ‘একগাল’ নামে এক ব্যক্তি নিহত হন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থানা থেকে লুট হওয়া আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে তারা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। গত তিন মাসে সেখানকার সংঘর্ষে রাজাসহ অন্তত ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া গত সেপ্টেম্বর মাসেও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাইকারীদের ছুরিকাঘাতে একাধিক হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
এ প্রসঙ্গে ডিএমপির তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ জিয়াউল হক বলেন, ‘সম্প্রতি আমাদের রদবদলের কারণে, একসঙ্গে অনেকের নতুন জায়গায় পোস্টিং হয়েছে। এর ফলে শুরুতে অনেক পুলিশ সদস্যের মাঠে কাজ করতে গিয়ে বেগ পেতে হয়েছে। এখন আর এ সমস্যা হচ্ছে না। আমরা সেটা কাটিয়ে উঠেছি। মোহাম্মদপুর এলাকায় অপরাধ আস্তে আস্তে নিয়ন্ত্রণে আসছে। ওই এলাকার যেখানে আমরা বিশৃঙ্খলার খবর পাচ্ছি, সঙ্গে সঙ্গে অভিযানে যাচ্ছি। ইতোমধ্যে অনেককে গ্রেফতারও করেছি। তদন্ত করে যারই ওই এলাকার অপরাধের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পাচ্ছি আইনের আওতায় নিয়ে আসছি।’
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, ‘অপরাধ নিয়ন্ত্রণে র্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়ন এলাকাভিত্তিক সক্রিয় রয়েছে। গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অভিযান চালাচ্ছি। যেসব জায়গায় চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই বেশি হচ্ছে সেসব জায়গা শনাক্ত করে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। এসব জায়গায় র্যাবের টহল বাড়ানো হয়েছে। যখনই অপরাধ সংঘটিত করতে দুষ্কৃতকারীরা সংঘবদ্ধ হচ্ছে অনুসন্ধান করে র্যাব সদস্যরা অভিযান চালাচ্ছে।’
সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.) গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘অপরাধী যেই হোক, কোনও অবস্থাতেই তাকে ছাড় দেওয়া হবে না। অপরাধী যত প্রতাপশালী হোক, যে দলেরই হোক ছাড় পাবে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা যারা ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন, তারা অনেকেই ঢাকার অলিগলি চেনেন না। সে জন্য একটু সময় দিতে হবে।’