শস্যভান্ডার আর সবজি চাষের জন্য খ্যাত রংপুরসহ উত্তরাঞ্চলে চাল-সবজিসহ সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। কাঁচা মরিচ ৪০০ টাকা, আলু ৮০ টাকার ওপরে বিক্রি হচ্ছে। টমেটো ২৮০, ঢ্যাঁড়স ৯০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ফলে মধ্য ও নিম্নবিত্তের মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকারের কোনও বাস্তবমুখী পদক্ষেপ না থাকায় চরমভাবে বিক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ।
কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই মৌসুমে সবজিসহ কাঁচা মরিচের দাম কোনও অবস্থাতেই এত বেশি হওয়ার কথা নয়। কারণ সব ধরনের সবজি রংপুর অঞ্চলে ব্যাপকভাবে চাষ হয়, যা এ অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলায়ও যায়।
অন্যদিকে, খুচরা ব্যবসায়ীরা আড়তদারদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করে বলেছেন, তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করে দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছেন কোটি কোটি টাকা।
সবজি উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত রংপুরের মিঠাপুকুর উপজেলার বলদীপুকুর, শঠিবাড়ি, গঙ্গাচড়া এলাকার চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা হাটবাজারে পাইকারি কাঁচা মরিচ দেড়শ থেকে ২০০ টাকা দামে বিক্রি করেন। সব ধরনের সবজি ৩০ থেকে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেন। সেগুলো শহরের বাজারে কী করে দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রি হয় তা তাদের ধারণার মধ্যে নেই। এটি আড়তদার ও ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেটের কারসাজি বলে অভিযোগ তাদের।
বলদীপুকুর পাইকারি সবজি বাজার ঘুরে চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবার অসময়ে বৃষ্টির কারণে মরিচের ক্ষেত কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তারপরও তারা দেড়শ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছেন।
সবজি চাষি শাহাদাত বলেন, এবার তিনি ১০ শতক জমিতে কাঁচা মরিচ চাষ করে গত তিন মাসে ৭০ হাজার টাকার বিক্রি করেছেন।
রংপুরের পালিচড়া এলাকার কৃষক সাদেক আলী জানান, পাইকাররা জমি থেকেই কিনে নিয়ে যান কাঁচা মরিচ। সেই মরিচ কীভাবে শহরে ৪০০ টাকা দাম হয়, কল্পনাও করতে পারেন না তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমরা চাষ করে বিক্রি করি দেড়শ থেকে ২০০ টাকা। আর পাইকাররা ৪০০ টাকা দরে বিক্রি করে দ্বিগুণ লাভ করে।’
চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে রংপুর অঞ্চলে মরিচের চাষ কম হতো। বেশির ভাগ চাষ হতো বগুড়া অঞ্চলে। এখন রংপুরের বিভিন্ন এলাকা ছাড়াও তিস্তা নদীর চরাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ কাঁচা মরিচ চাষ হয়, যা রংপুর অঞ্চলের চাহিদা মিটিয়েও অন্য জেলায় বিক্রি হয়।
বিভাগীয় নগরী রংপুরের সিটি বাজারে রয়েছে এই অঞ্চলের অন্যতম বৃহৎ সবজি ও চালের মোকাম। এখান থেকে সবজি ও চালসহ নিত্যপণ্য উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার পাইকার আর আড়তদাররা কিনে নিয়ে যান। এখানে গত দুই মাস ধরে লাগাতারভাবে সব ধরনের সবজির দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
শুক্রবার এখানকার পাইকারি চাল ও সবজি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি কেজি আদা ২৫০ রসুন ৩০০ থেকে ৩০০, কাঁচা মরিচ ৪০০, আলু ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। পটল প্রতি কেজি ৮০, ঢ্যাঁড়স ৯০, মুলা ৭০, চিচিংগা ৯০, বেগুন ১০০, শসা ৯০, ছোট লাউ ৭০ থেকে ৮০, শিম ১০০, ফুল কপি ১২০, ধনেপাতা ২০০, কচু ৮০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। অর্থাৎ সব ধরনের সবজির দাম অস্বাভাবিক। শুধু কাঁচা পেঁপে ৩০ টাকা।
সবজি ব্যবসায়ীরা বলছেন, খারাপ আবহাওয়া এবং বন্যায় সবজিক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় দাম বেড়েছে।
সবজির পাইকারি আড়তদার মোতালেব খান জানান, কিছুদিন আগেও এ সময় আদা, রসুন, কাঁচা মরিচের দাম এত বেশি ছিল না। কিন্তু এখন চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কম থাকায় আদার দাম অনেক বেড়েছে। একইভাবে রসুনের দামও বেড়েছে।
কাঁচা মরিচের দাম আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করলেন আড়তদার দবির উদ্দিন। তিনি বলেন, কি‘ছু দিন আগে অবিরাম বৃষ্টিতে মরিচের ক্ষেত তলিয়ে গেছে, অনেকের ক্ষেতের মরিচ নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে মরিচের দাম আরও বাড়বে।’
আলুর দাম ৭০ থেকে ৮০ টাকা হওয়ার কারণ জানতে চাইলে আড়তদার আফতাব মিয়া বলেন, ‘রংপুরের হিমাগারগুলোতে বিপুল পরিমাণ আলু আছে। কিন্তু ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু ছাড়তে চাইছেন না। মূলত আলুর বড় বড় পাইকার আর কোল্ড স্টোরেজে রাখা আলু ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রাখায় এই অবস্থা।’
তিনি আরও বলেন, ‘২৫ বছর ধরে সবজির ব্যবসা করছি, আলুর এমন দাম আর দেখিনি।’
এদিকে উত্তরাঞ্চলের অন্যতম চালের বৃহৎ মোকাম সিটি বাজারে চালের বাজার ঘুরে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সব ধরনের চালের দাম কেজিতে ৫ থেকে ৮ টাকা বেড়েছে। ৩৮ টাকা কেজির মোটা চাল ৪৪, বিআর ২৮ চাল যেখানে ৪৬ টাকা কেজি ছিল সেটি এখন ৫২, বিআর ২৯ চাল ৪৭ টাকার স্থলে ৫৪, মিনিকেট ৬৫ টাকার স্থলে ৭০, নাজিরশাইল ৭৫ থেকে ৭৮ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। হঠাৎ চালের দাম বৃদ্ধি পাওয়ার কোনও কারণ দেখছেন না আড়তদাররা।
তারা জানান, রংপুর অঞ্চলে গত বোরো মৌসুমে বাম্পার ফলন হয়েছে। ইতোমধ্যে আমন ধান কাটা মাড়াই শুরু হয়েছে। কিন্তু হঠাৎ ধানের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে।
চালের আড়তদার শামসুর রহমান জানান, দিনাজপুর, নাটোর ও রংপুরের মাহিগঞ্জ মোকামে লাখ লাখ বস্তা চাল মজুত আছে। তারা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করার ফলে চালের দাম বেড়েছে। সহসাই দাম কমবে বলে মনে হয় না।
এদিকে চালসহ নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়ে যাওয়ার কারণে মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন। তাদের আয় না বাড়লেও জিনিসের দাম বেড়েই চলছে।
প্রশাসনের নজরদারি না থাকায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ভোক্তারা বলছেন, আমরা চাহিদার চার ভাগের তিন ভাগ কিনতাম- এখন অর্ধেক কিনছি। যা দিয়ে কোনোভাবেই পরিবার পরিজন নিয়ে তিন বেলা চলছে না। বাজারে প্রচুর সামগ্রী থাকলেও দাম কেন কমছে না তার কোন জবাবদিহিতা নেই। ফলে ভোক্তারা এখন জিম্মি হয়ে পড়েছে।
চাকরিজীবী তাহমিনা আশরাফ জানান, তিনি যে বেতন পান তা দিয়ে এখন ১৫ দিনেও সংসার চলছে না। তিনি বলেন, আমাদের বেতন তো মাসে মাসে বাড়ে না। কিন্তু নিত্যপণ্যের দাম প্রতি সপ্তাহেই বাড়ছে। ফলে আমাদের পক্ষে সংসার চালানো আর তিন বেলা খাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়েছে।
বেসরকারি চাকরিজীবী নজরুল ইসলাম বলেন, প্রতিনিয়ত জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে- এভাবে সম্ভব না। বাধ্য হয়ে এক কেজির পরিবর্তে এখন আধা কেজি কিনতে হচ্ছে- কেননা হিসাবতো মিলছে না। আমাদের পরিবার পরিজন নিয়ে চলা মুশকিল হয়ে পড়েছে।
দোকান কর্মচারী সফিক বলেন, পেঁয়াজ, আদা-রসুন, কাঁচা মরিচসহ সব ধরনের সবজির দাম বেড়েছে। তিনি বলেন, চার জনের সংসার আর সামলানো যাচ্ছে না। নিত্যপণ্যের দামের লাগাম টানতে কেন সরকার পারছে না- কোথায় তাদের দুর্বলতা বুঝি না।
এদিকে মাংস আগের দামে বিক্রি হলেও ডিম এখন ভোক্তাদের নাগালের বাইরে। ডিম এখন প্রতি পিস ১৫ টাকা। ব্যবসায়ীরা বলেন, বড় বড় সিন্ডিকেট চক্র এখন ডিমের বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে- সে কারণে দাম কমছে না।
এদিকে নিত্যপণ্যের লাগাম টেনে ধরতে প্রশাসনের কঠোর নজরদারি বাড়ানো দরকার বলে সাধারণ মানুষের দাবি।