Home » চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের ভেতর-বাহির

চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডের ভেতর-বাহির

চলচ্চিত্রকর্মীদের দীর্ঘদিনের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড বাতিল করে গঠিত হয়েছে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড। গত ২২ সেপ্টেম্বর এ সম্পর্কিত একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন আইন, ২০২৩’র ধারা ৩-এর উপধারা (১)-এ প্রদত্ত বিধি মোতাবেক এই সার্টিফিকেশন বোর্ড গঠিত হয়।

অন্য ইন্ডাস্ট্রিতে সার্টিফিকেশন বোর্ড যেমন
গৃহীত নীতিমালার ভিত্তিতে একটি চলচ্চিত্রকে প্রদর্শনযোগ্য হিসেবে ছাড়পত্র দেয় সেন্সর সার্টিফিকেশন বোর্ড। যেখানে উল্লেখ থাকে কোন সিনেমা কোন বয়সের দর্শকরা দেখতে পারবেন।

গ্রেডিং বা রেটিং পদ্ধতির ক্ষেত্রে বিশেষ চিহ্নের সাহায্যে বাধ্যবাধকতা আরোপ করে ছাড়পত্র বা সেন্সর সনদপত্র প্রদান করা হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এমন পদ্ধতি রয়েছে। মোশন পিকচার অ্যাসোসিয়েশনের বিধিমালা অনুযায়ী, ‘জি’ চিহ্ন মানে ‘জেনারেল’। এই ক্যাটাগরির চলচ্চিত্র সবার জন্য উন্মুক্ত। ‘পিজি’ মানে ‘প্যারেন্টাল গাইডেন্স’। এই ধরনের চলচ্চিত্র একজন প্রাপ্তবয়স্কের সান্নিধ্যে কম বয়সীদের জন্য দর্শনযোগ্য। ‘আর’ মানে ‘রেস্ট্রিক্টেড’, যা ১৭ বছরের কম বয়সীরা তাদের বাবা-মায়ের সঙ্গে দেখতে পারবে। তবে সিনেমাটিতে প্রাপ্ত বয়স্ক কনটেন্ট কতটা রয়েছে, সে সম্পর্কেও খোঁজ-খবর নিতে বলা হয় নির্দেশনায়। ‌‘এনসি ১৬’ মানে ‘নট ফর চিল্ড্রেন আন্ডার সিক্সটিন’। এ চলচ্চিত্রগুলোয় কিছুটা নগ্নতা ও সহিংসতা থাকায় ১৬ বছরের নিচে কেউ এটা দেখতে পারবে না। ‘ব্যান্ড’ মানে সব ধরনের দর্শকের জন্য এটি প্রদর্শন অযোগ্য। এ ছাড়া ‘এক্স’ দ্বারা বোঝানো হয় এটি ১৭ বছরের কম বয়সীদের জন্য নিষিদ্ধ। কেননা এক্স এতদিনে পর্নোগ্রাফিকে বোঝানো শুরু হয়ে।

অন্যদিকে, ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব ফিল্ম সার্টিফিকেশন নীতিমালা অনুযায়ী, চার ক্যাটাগরির রেটিং রয়েছে। এগুলো হলো—ইউ, ইউএ, এ ও এস। এখানে ‘ইউ’ মানে ‘আনরেস্ট্রিক্টেড’, যা সবার জন্য প্রদর্শনযোগ্য। ‘ইউএ’ মানে সবাই দেখতে পারবে, কিন্তু ১২ বছরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে অভিভাবকের প্রতি কিছু সতর্কতামূলক পরামর্শ দেওয়া থাকে। ‘এ’ মানে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য। ‘এস’ মানে একমাত্র বিশেষ শ্রেণির দর্শকের জন্য প্রযোজ্য।

ইনডিপেনডেন্ট ডিজিটালকে নির্মাতা শিহাব শাহীন বলেন, ‘আমি খুবই আশাবাদী, আমি এটাই চাই। বিশেষ করে দর্শকের বয়স অনুযায়ী যে ক্লাসিফিকেশন (শ্রেণিবিন্যাস), সেটাই আমাকে বেশি আকৃষ্ট করছে। যেমন, ইউ/ এ/ টুয়েলভ প্লাস/ সিক্সটিন প্লাস—এই ক্যাটাগরিগুলো দর্শককে জানিয়ে দেয়ার এবং একটা নির্দিষ্ট বয়স অনুযায়ী গ্রণযোগ্যতার বিষয়টি। আমি মনে করি, এটা কাটো, এটা বন্ধ করর চেয়ে এটাই ভালো হবে।’

আমাদের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বলতে পারি যে, ভারতে যে ধরনের সেন্সর সার্টিফিকেশন সিস্টেম আছে—সেটা আমাদের জন্য অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হবে। সংস্কৃতিগতভাবে (দর্শকের রুচি, দর্শকের সহনশীলতার মাত্রা, সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ) অনেক বেশি মিল থাকার কারণে সেখানে যে ধরনের সার্টিফিকেশন সিস্টেম আছে, আমরা সেটা অনেকখানি ফলো করতে পারি। কারণ, সেটা যেহেতু এত বছর ধরে চলছে, পরীক্ষিত এবং কার্যকর। রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কিছু, দেশের স্বার্থবিরোধী, কোনো সম্প্রদায়কে আঘাত করে, জাতীয় পতাকা, দেশের বিদ্যমান আইন পরিপন্থী, মানুষে মানুষে বিভক্তি তৈরি করে, মানে রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, জনমানুষের ক্ষতি করে—এ ধরনের কিছু করা যাবে না। —শিহাব শাহীন

সার্টিফিকেশন বোর্ডের বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন নির্মাতা অমিতাভ রেজাও। ইনডিপেনডেন্ট ডিজিটালকে তিনি বললেন, ‘নতুন করে কিছু হবে, যেটা এমনভাবে হবে যাতে যেকোনো নির্মাতা স্বাধীনভাবে তার চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারে। এইসব এক কথায় বলা মুশকিল। এই নিয়ে অবশ্যই বিশিষ্টজনরা বসে জাতীয় চলচ্চিত্রে নীতিমালা প্রণয়ন করবে। সেন্সর থেকেও চলচ্চিত্রের আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ বাকি আছে।’

পরিবর্তন আসবে কতটা
সার্টিফিকেশন বোর্ড ঘোষণার পর প্রথমবারের মতো একটি যৌথ সভায় বসতে যাচ্ছেন কমিটির সদস্যরা। বৃহস্পতিবার (২৬ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সেগুনবাগিচার কার্যালয়ে এই সভা অনুষ্ঠিত হবে।

সদ্য ঘোষিত চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড কেমন কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছে— এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রথম সভায় সকল সদস্যরা মিলে যে আলোচনা হবে, তারপরই এ বিষয়ে মন্তব্য করতে চাইলেন বোর্ডের সদস্য নির্মাতা খিজির হায়াত খান।

তবে তিনি পরিবর্তনের ব্যাপারে আশাবাদী। ব্যক্তিগত অভিমত তুলে ধরে বললেন, ‌‘আমি চাই সার্টিফিকেশন বোর্ডের নামকরণের সার্থকতা যেন হয়। আমরা যেন বিদ্যমান আইন (২০২৩) যেটা আছে, সেটাকে যুগোপযোগী করতে পারি, সংস্কার করতে পারি এবং সঠিক বিধিমালা নির্ণয় করতে পারি, যা বাংলাদেশের সিনেমাকে বর্হিবিশ্বে বা আন্তর্জাতিক অঙ্গনের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে চলতে সাহায্য করবে। বিদ্যমান আইনকে সংস্কার করে সিনেমাবান্ধব করাটাই হবে আমার মূল চাওয়া। এবং এর পাশাপাশি যে সিনেমাগুলো আটকে আছে, সেগুলো যেন আমরা ছাড়তে পারি। অন্যদিকে সেন্সরের যে গঠনপ্রণালী রয়েছে, সেগুলো নিয়েও কথা বলব। একটি সিনেমা সেন্সরে জমা দেওয়ার যে সিস্টেম রয়েছে, সেটাও যেন যুগোপযোগী করতে পারি—এগুলো আমার চাওয়ার মধ্যে থাকবে।’

অন্যদিকে, একই বিষয়ে জানতে চাইলে আগামীকালের সভার পর মন্তব্য করতে চেয়েছেন বোর্ডের আরেক সদস্য অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ। ইনডিপেনডেন্ট ডিজিটালকে বললেন, ‘আমি যেহেতু একজন মঞ্চকর্মী, থিয়েটার করি, তাই টিম স্পিরিটে বিশ্বাসী। আগামীকালের সভা শেষে সবার অভিমত কেমন হবে, কর্মপরিকল্পনা কী—সেসব বিষয়ে জানতে পারব।’

চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে নতুন সদস্য যাঁরাচলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডে নতুন সদস্য যাঁরা
চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড যেমন ছিল
দেশ স্বাধীনের পর ১৯৭৭ সালে ‘সেন্সরশিপ অব ফিল্মস রুলস’ অনুসারে চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড গঠিত হয়েছিল। এরপর থেকে এটি পরিচালিত হয়ে আসছিল একই বছরের সেন্সরশিপ বিধি এবং তারও আগে ১৯৬৩ সালের চলচ্চিত্র সেন্সরশিপ আইনের ভিত্তিতে। পরবর্তী সময়ে ১৯৮৫ সালে সেন্সর বোর্ড আবারও নতুন কিছু নীতিমালা প্রণয়ন করে।

যেখানে সেন্সরশিপ অব ফিল্মস রুলস নীতিমালার ১৩নং অনুচ্ছেদে বর্ণিত বিধি অনুসারে সমাজ ও রাষ্ট্রের নিরাপত্তা বা আইন-শৃঙ্খলা, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, ধর্মীয় অনুভূতি, অনৈতিক বা অশ্লীলতা, বীভৎসতা, অপরাধ, নকল প্রভৃতি দিক বিবেচনা করে একটি চলচ্চিত্রকে ছাড়পত্র প্রদান করার কথা উল্লেখ করা হয়।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *