এমসি কলেজের ফটক থেকে স্বামী-স্ত্রীকে ধরে নিয়ে যান কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতা। তাদের প্রাইভেটকারসহ নিয়ে যাওয়া হয় ছাত্রাবাসের ভেতরে। সেখানে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে (১৯) গাড়ির ভেতরেই ধর্ষণ করেন ছাত্রলীগের ৬ জন। সিলেটসহ সারা দেশে তোলপাড় করা ঘটনাটি ঘটে ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর। কিন্তু এই ৪ বছরেও শুরু হয়নি এই ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার বিচারকাজ।
জানা যায়, ২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বিকালে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার জৈনপুর এলাকার এক যুবক তার নববিবাহিত স্ত্রীকে নিয়ে শাহপরাণ মাজারে ঘুরতে যান। সন্ধ্যার দিকে তারা এমসি কলেজ ক্যাম্পাস ঘুরে দেখার লক্ষ্যে এর প্রধান ফটকের সামনে অবস্থান করছিলেন। এ সময় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতাকর্মী তাদের ঘিরে ধরে। একপর্যায়ে নবদম্পতিকে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে তাদের প্রাইভেটকারে তুলেই কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে প্রাইভেটকারের ভেতরেই ধর্ষণ করেন ছাত্রলীগের ৬ নেতা।
ঘটনার সময়ের বিবরণ দিতে গিয়ে স্থানীয়রা জানান, ওই দিন সন্ধ্যার পর রাতে বেশ কিছুক্ষণ এমসি কলেজের ছাত্রাবাসের ভেতর থেকে চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ শুনতে পাচ্ছিলেন তারা। এক পর্যায়ে নারী কণ্ঠের চিৎকার শুনতে পেয়ে স্থানীয় কয়েকজন ছাত্রাবাস এলাকার ভেতরে প্রবেশ করতে গেলে ছাত্রলীগের নেতারা বাঁধা দেন। এসময় হোস্টেলের পাশের স্টাফ কোয়ার্টার থেকে কর্মচারীরা এবং খবর পেয়ে পুলিশ আসলে নির্যাতিতা স্ত্রীকে নিয়ে তার স্বামী সব খুলে বলেন। ওই রাতেই নির্যাতিতা নববধূকে সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং রাতেই তার স্বামী বাদী হয়ে সিলেট শাহপরাণ থানায় ৬ জনের নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।
ঘটনার পর আসামিরা পালিয়ে গেলেও ৩ দিনের মধ্যে ৬ আসামিসহ আরও ২ জনকে গ্রেফতার করে র্যাব ও পুলিশ। গ্রেফতারকৃতরা ছিলেন- সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়ার তাহিদ মিয়ার ছেলে সাইফুর রহমান (২৮), হবিগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার বাগুনীপাড়ার শাহ জাহাঙ্গীর মিয়ার ছেলে শাহ মো. মাহবুবুর রহমান রনি (২৫), সুনামগঞ্জের শান্তিগঞ্জ উপজেলার উমেদনগরের মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে তারেকুল ইসলাম তারেক (২৮), জকিগঞ্জের আটগ্রামের মৃত অমলেন্দু লস্কর ওরফে কানু লস্করের ছেলে অর্জুন লস্কর (২৬), দিরাই উপজেলার বড়নগদীপুরের দেলোয়ার হোসেনের ছেলে রবিউল ইসলাম (২৫), কানাইঘাট উপজেলার লামা দলইকান্দির (গাছবাড়ী) সালিক আহমদের ছেলে মাহফুজুর রহমান মাসুম (২৫), সিলেট নগরীর গোলাপবাগ আবাসিক এলাকার (বাসা নম্বর-৭৬) মৃত সোনা মিয়ার ছেলে আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল (২৬) ও বিয়ানীবাজার উপজেলার নটেশ্বর গ্রামের মৃত ফয়জুল ইসলামের ছেলে মিজবাউল ইসলাম রাজনকে (২৭)। তারা সবাই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।
ঘটনার দুই মাস ৮ দিন পর- ২০২০ সালের ৩ ডিসেম্বর এই আটজনকে অভিযুক্ত করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলার ১৭ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা শাহপরাণ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইন্দ্রনীল ভট্টাচার্য। এতে বলা হয়- আসামিদের মধ্যে সাইফুর রহমান, শাহ মাহবুবুর রহমান রনি, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর, মিজবাহুল ইসলাম রাজন ও আইনুদ্দিন ওরফে আইনুল সেদিন ওই নারীকে সরাসরি ধর্ষণ করেন। আর রবিউল ইসলাম ও মাহফুজুর রহমান মাসুম ধর্ষণকারীদের সহযোগিতা করেন।
গ্রেফতারের পর আট আসামির সবাই আদালতে ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। পরে ৮ জনের ডিএনএ নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সিলেট ওসমানী মেডিকেলের ওসিসির মাধ্যমে ডিএনএ সংগ্রহ করে ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে পাঠায় পুলিশ। নমুনা সংগ্রহের প্রায় দুই মাস পর ডিএনএ রিপোর্ট আসে। রিপোর্টে ছাত্রলীগ কর্মী সাইফুর রহমান, তারেকুল ইসলাম তারেক, অর্জুন লস্কর ও মাহবুবুর রহমান রনির ডিএনএ ‘ম্যাচিং’ পাওয়া যায়। আট আসামি বর্তমানে কারাগারে আছেন। মামলায় ৫২ জনকে সাক্ষী রাখা হয়।
এক পর্যায়ে দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য গঠিত জেলা মনিটরিং কমিটি ধর্ষণ মামলা দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু কোনো পদক্ষেপ না থাকায় ধর্ষিতার স্বামী হাইকোর্টে রিট করেন। ২০২২ সালেল ১৫ ডিসেম্বর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে স্থানান্তর করতে আদেশ দেন হাইকোর্ট। কিন্তু মামলা স্থানান্তর করতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে গেজেট প্রকাশ করে প্রজ্ঞাপন জারি করার নিয়ম। কিন্তু এখন পর্যন্ত সেটি করা হয়নি।
বাদীপক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী বলেন, মামলার কোনো অগ্রগতি নেই। বাদীপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত ২০২২ সালের ১৫ ডিসেম্বর মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে প্রেরণের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তবে মামলা স্থানান্তরের ক্ষেত্রে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করতে হয়। এখন পর্যন্ত সেটি না হওয়ায় মামলাটির স্থানান্তর প্রক্রিয়া থমকে আছে।
তিনি আরও বলেন- এর মধ্যে উচ্চ আদালতের এ আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে সরকারের পক্ষে ‘অ্যাডভোকেট অন রেকর্ড’ হরিপদ পাল কর্তৃক লিভ টু আপিল করা হয় বলে মামলার বাদিকে নোটিশ করা হয়। নোটিশ গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে আমরা পাই। এই বিষয়েও কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি আদালত।
অ্যাডভোকেট শহীদুজ্জামান চৌধুরী একপ্রকার অভিযোগের স্বরে বলেন- জানাতে পেরেছি, মামলার বাদীকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা চলছে। মনে হচ্ছে- তাকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। বাদী এখন আমার সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দিয়েছেন।
সার্বিক বিষয়ে জানতে মামলার বাদীর মুঠোফোনে বার বার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।
মামলার বিচারকাজ নিয়ে সিলেট নারী ও শিশু ট্রাইব্যুনালের এপিপি ইশতিয়াক আহমদ চৌধুরী বলেন- প্রজ্ঞাপনটি দ্রুততম সময়ের মধ্যে দেওয়ার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে দুই বার লিখিতভাবে আবদেন করা হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রজ্ঞাপনটি জারি করা হয়নি। ফলে মামলাও দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে যাচ্ছে না, বিচারকাজও শুরু হচ্ছে না।