Home » গণঅভ্যুত্থানে সর্বশক্তি দিয়ে রাজপথে ছিল বিএনপি, নিহত ৪২২ নেতাকর্মী

গণঅভ্যুত্থানে সর্বশক্তি দিয়ে রাজপথে ছিল বিএনপি, নিহত ৪২২ নেতাকর্মী

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে কমপক্ষে বিএনপির ৪২২ জন নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন জানিয়ে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে গণঅভ্যুত্থানে সর্বশক্তি দিয়ে রাজপথে নেমে আসে বিএনপি ও এর সব অঙ্গ-সহযোগী সংগঠন। আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল নয়, বিএনপির উদ্দেশ্য ছিল সর্বস্তরের নেতাকর্মী-সমর্থকদের অংশগ্রহণে গণঅভ্যুত্থানে সাংগঠনিকভাবে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখে ফ্যাসিবাদের পতনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা।

রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর গুলশানের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত বিএনপির স্থায়ী কমিটির সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা বলেন তিনি।

আন্দোলনে অংশগ্রহণের প্রসঙ্গে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বিএনপির যে ৬০ লাখ সদস্যের নামে মিথ্যা মামলা হয়েছে, তার সুবিশাল অংশ সাধারণ মানুষের পাশে থেকে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ষড়যন্ত্র ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে রুখে দাঁড়ায়। এতে যার-যার অবস্থান থেকে জনগণের কাতারে নেমে আসে বিএনপি ও সমমনা সব রাজনৈতিক দল।’

‘গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের পথযাত্রায় বিএনপির ভূমিকা, অবদান ও প্রত্যাশা’ শীর্ষক লিখিত বক্তব্যে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘আজ আন্তর্জাতিক গণতন্ত্র দিবস। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের জনগণকে বারবার ত্যাগ শিকার করতে হয়েছে, রক্ত দিতে হয়েছে। এ দেশের স্বাধীনতাকে যখনই গ্রাস করেছে স্বৈরতন্ত্র, প্রতিবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করেছে বিএনপি।’

তিনি উল্লেখ করেন, ‘১৬ বছরের স্বৈরাচারী দুঃশাসনকে চূর্ণ করে গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণ আবারও মুক্তির স্বাদ পায়, গণতন্ত্রের পথ সুগম করে। অসংখ্য ব্যক্তি ও পরিবার রয়েছে, বছরের পর বছর ধরে যাদের ত্যাগের মধ্য দিয়ে আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, জুলাই গণহত্যায় ১৩ আগস্ট পর্যন্ত সারা দেশে শহীদ হন ৮৭৫ জন। এর মাঝে কমপক্ষে ৪২২ জন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দেশজুড়ে শহীদ হওয়া সব শ্রেণি-পেশা-রাজনীতির মানুষগুলোর এ বিশাল অংশ যে বিএনপিরই নেতাকর্মী– এটি কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং আমাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের অনিবার্য ফল।’

‘পোশাকশ্রমিক কিংবা রিকশাচালক; পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র; বাম কিংবা ডান আদর্শের অনুসারী; সব মত ও পথের রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক ব্যক্তি হতাহতের পরিচয় যাই হোক না কেন, প্রতিটি প্রাণের মূল্য ও রক্তের মর্যাদা সমান। সমান গুরুত্বের সঙ্গেই প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের তালিকা তৈরি ও সুবিচার নিশ্চিত করতে হবে। শেখ হাসিনার পদত্যাগের জন্য যে জাতীয় ঐকমত্য আমরা দেখতে পাই, তা কিন্তু হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। এটি মূলত অবৈধ সরকারের অত্যাচার-অবিচার, দুর্নীতি-দুঃশাসন, বঞ্চনা-অবজ্ঞা এবং শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।’ যোগ করেন বিএনপি মহাসচিব।

আবু সাঈদের মৃত্যুর দিন ছাত্রদলের ওয়াসিমও প্রাণ হারান

মির্জা ফখরুল জানান, ১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে হত্যা করে পুলিশ। একই দিন চট্টগ্রামে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরামকেও হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডগুলোতে সমগ্র বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, বেগবান হয় আন্দোলন।

তিনি বলেন, ‘১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় আন্দোলনে পানি বিতরণ করতে গিয়ে, পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ছাত্র মীর মুগ্ধ। একই দিন যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রদল নেতা ইরফান ভূঁইয়া ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্রদল নেতা ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির।’

তিনি আরও বলেন, ‘১৭ জুলাই বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ডিবি পুলিশের অভিযানের নামে মঞ্চায়িত হয় সাজানো নাটক, বলপূর্বক বন্ধ করা হয় কার্যালয়ের কার্যক্রম। বাসায়-বাসায় অভিযান চালিয়ে, বিএনপির অর্ধশত প্রথম সারির নেতাসহ ৩ হাজারের বেশি নেতাকর্মীকে স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, এবং কেন্দ্রীয় নেতা রুহুল কবির রিজভী, জহিরউদ্দিন স্বপন, শহীদ উদ্দিন এ্যানী, শিমুল বিশ্বাস, আমান উল্লাহ আমান, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, ডা. রফিকুল ইসলাম, নাসিরউদ্দিন অসীম, সাইফুল ইসলাম নীরব, আমিনুল হক, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মীর নেওয়াজ, নিপুণ রায় চৌধুরী, ডা. শাখাওয়াত শায়ন্তসহ আরও অনেক সক্রিয় নেতা।’

ফখরুলের মন্তব্য, ‘ওই গণগ্রেফতার প্রমাণ করে, স্বৈরাচারের পতন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ বরাবরের মতোই বিএনপিকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে। আন্দোলনকে দমন করতে নিপীড়নের মাত্রা বাড়ায়। বহুমাত্রিক নিপীড়ন মোকাবিলা করেই বিএনপি নিরবচ্ছিন্নভাবে রাজপথের অগ্রভাগে ছিল। বিশেষত, আগস্টের ৪ ও ৫ তারিখে জীবন দেন ঢাকা মহানগর পূর্ব ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুর রহমান রাসেল, জালাল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসিফ হোসেন, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা রাসেল মাহমুদ, যশোর জেলা ছাত্রদল নেতা সাকিবুল হাসান মাহি প্রমুখ। এভাবে শুধু ছাত্রদল থেকেই, একে-একে কমপক্ষে ১১৩ জন প্রাণ হারান এই অভ্যুত্থানে।’

দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছেন বিএনপি শতাধিক নেতাকর্মী

বিএনপি মহাসচিব বলেন, ‘সাভারের আশুলিয়ায় গুলি করে হত্যার পর, লাশগুলো ভ্যানে স্তূপ করে গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে পুলিশ, যার মধ্যে জাতীয়তাবাদী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন সজলও ছিলেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে এ ধরনের বর্বরতা কেবল কিছু জীবনকে নিঃশেষ করা নয় বরং মানবতার ওপর একটি গভীর আঘাত। শুধু তাই নয়, গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের গুলিতে শতাধিক বিএনপি নেতাকর্মী দৃষ্টিশক্তি হারান। এর মধ্যে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলাতেই তুষার, হারেস, শাহজালালসহ ছয় জন ছিলেন।’

তিনি বলেন, ‘জুলাই-আগস্টে সারা দেশের এক দফা দাবি আর বিএনপির ত্যাগের পটভূমি সৃষ্টি হয়েছে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। উত্তাল রাজপথে এ পুরোটা সময় গুম-খুন, হামলা-মামলা, দমন-দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়েও, জনগণের প্রতিবাদের প্রতিনিধি হিসেবে সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে বিএনপি।’

তিনি আরও বলেন, ‘রাজনৈতিক হয়রানির অংশ হিসেবে, গায়েবি মামলায় সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা, হত্যা, নাশকতা, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতিসহ নানা বানোয়াট ও মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়। প্রহসনের মামলা ও সাজানো রায়ের মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আটক করে শেখ হাসিনা। অন্যায়ভাবে তার বাড়ি কেড়ে নিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়। নির্জন পরিত্যক্ত কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে রেখে প্রাপ্য চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয় তাকে।’

সংবাদ সম্মেলনে আরও ছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মির্জা আব্বাস, নজরুল ইসলাম খান, ড. আবদুল মঈন খান, সালাউদ্দিন আহমেদ।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *