বাড়িটির সামনে একটি চালতা গাছ। সময়ের আঘাতে মলিন হয়ে গেছে রঙ। ক্ষয়ে গেছে অনেক কিছু। সেই জীর্ণ বাড়িটিকে যেন দ্বাররক্ষীর মতো পাহারা দিচ্ছে চালতা গাছটি। এই গাছের ছায়ায় হয়তো তিনি দাঁড়াতেন, পাতার ফাঁকে খুঁজতেন পাখির সুর। কারণ একটা জীবন সুরের খেয়া বাইতে বাইতেই যে কাটিয়ে দিলেন।
বাড়ি লাগোয়া সড়ক। বড়জোর বিশ-পঁচিশ হাতের ব্যবধান। সড়কের ওপারেই কবরস্থান। যেখানে আম-কাঁঠালের ছায়ায় শুয়ে আছে শিল্পীর মা-সহ কত কত মানুষ। জীবন থেকে মৃত্যুর দূরত্ব যেন এই একটি সড়ক। আর সাদি মহম্মদ সেই সড়ক পাড়ি দিলেন তানপুরা বাজাতে বাজাতে বুধবারের (১৩ মার্চ) সন্ধ্যায়, সবার অলক্ষ্যে। ইফতার সেরে বসেছিলেন রেয়াজে। কে জানতো, জীবনে শেষবারের মতো তানপুরায় সুর তুলছিলেন তিনি! তানপুরার বিষণ্ণ সুরেই ডুব দিয়েছিলেন অনন্তযাত্রায়। স্বেচ্ছামৃত্যুর হাত ধরে।
বৃহস্পতিবার (১৪ মার্চ) দুপুরে জোহর নামাজের পর জানাজা ও দাফন সম্পন্ন হয়েছে কিংবদন্তি এই শিল্পীর। রাজধানীর মোহাম্মদপুর কেন্দ্রীয় কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়েছে। এ সময় তাকে চিরবিদায় জানাতে ছুটে এসেছিলেন সংগীত অঙ্গনের অনেকে। সংগীতশিল্পী খুরশিদ আলম থেকে শুরু করে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, অণিমা রায়, পীযুষ বড়ুয়া, কবির বকুলসহ অনেককে দেখা গিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের কালজয়ী সাক্ষী ১২/১০, তাজমহল রোডের বাড়িটির সামনে।
জানাজা ও দাফনের জন্য যখন সাদি মহম্মদের মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাস্তার ওপারে মসজিদে; তখন তার বাড়ির সামনে গান ধরেন শিল্পীরা। সাদির সংগীতসঙ্গী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার সঙ্গে কণ্ঠ মেলান রবীন্দ্রসংগীতের আরও কয়েকজন শিল্পী। যিনি আজীবন রবীন্দ্রচর্চায় নিবিষ্ট ছিলেন, তাকে রবির সুরে বিদায় জানানোর চেয়ে সুন্দর কী হতে পারে! সমবেত কণ্ঠে, বিষাদের সুরে তারা গাইলেন ‘তোমারও অসীমে প্রাণমন লয়ে, যত দূরে আমি ধাই/ কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃত্যু, কোথা বিচ্ছেদ নাই’।
সাদি মহম্মদ স্বেচ্ছামৃত্যু বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু কেন? এ প্রশ্ন সকলের মনে। যদিও এর উত্তর কখনও পাওয়া যাবে না। তবে তার এক স্বজনকে বলতে শোনা যায়, গত বছর মায়ের মৃত্যুর পর থেকে একটা হতাশায় ডুবে ছিলেন শিল্পী। তারও বহু আগে, সেই একাত্তরের যুদ্ধের সময় চোখের সামনেই বাবাকে খুন হতে দেখেছিলেন। এসব বিদগ্ধ বেদনা বুকে নিয়েই গানে খুঁজেছিলেন জীবন। বুধবার (১৩ মার্চ) সন্ধ্যায় যখন তার সাড়া না পেয়ে দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করেন স্বজনরা, তখন সাদি ঝুলছিলেন সিলিংয়ে। আর তার তানপুরার প্রতিধ্বনি যেন তখনও বাজছিল ঘরময়।
প্রায় সকলের মুখেই সাদি মহম্মদ সম্পর্কে একটি বাক্য শোনা যায়, ‘তিনি অত্যন্ত সহজ-সরল আর নম্র মানুষ ছিলেন’। তার শেষযাত্রায় এসে জ্যেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পী খুরশিদ আলম বলেন, ‘সাদি যেখানেই থাকুক, শান্তিতে থাকুক, এটাই চাই। শিল্পীরা একটু অভিমানী হয়। তবে সেই অভিমান থেকে নিজেকে এভাবে শেষ করে দেওয়ার মানে হয় না। আমরা একজন কিংবদন্তিকে হারালাম। আগামী একশ বছরেও তার অপূর্ণতা ঘুচবে না। মানুষ হিসেবে সাদি খুব সহজ-সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন। আমার ৭৯ বছর বয়স, এই দীর্ঘ জীবনে তার মতো সহজ মানুষ আমি দেখিনি।’
রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী অণিমা রায়ের কণ্ঠে ছিল আক্ষেপ। তিনি বললেন, ‘আফসোস, যে বটবৃক্ষের ছায়ায় আমরা পথ চলতাম, যার সংগীত অনুরাগ, রবীন্দ্রনাথের প্রতি ভক্তি দেখে আমরা শিখতে শুরু করেছি; তার হৃদয়টা জুড়ে এত হতাশা, এত ক্ষরণ! আমরা কেউ তার খবর রাখিনি! তার শত শত ছাত্র-ছাত্রী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তারাই হয়ত এখন একুশে পদক পাচ্ছেন। অথচ সাদি মহম্মদ স্যার এখনও একটা রাষ্ট্রীয় পদক পাননি। এটা আমাদের লজ্জা!’
উল্লেখ্য, মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডেই সাদি মহম্মদের জন্ম ও বেড়ে ওঠা। রবীন্দ্রসংগীতের ওপর বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছিলেন তিনি। রবিঠাকুরের গানে তার মূল পরিচিতি হলেও আধুনিক গানেও ছিলেন অনন্য। তার কণ্ঠে বহু রবীন্দ্রসংগীতের অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে। তাকে দেখে, শুনে এই সুরের জগতে এসেছেন অসংখ্য শিল্পী। যারা নিজ নিজ পরিচয়ে উজ্জ্বল, সফল। জীবদ্দশায় চ্যানেল আই থেকে আজীবন সম্মাননা ও বাংলা একাডেমি থেকে রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছিলেন এই শিল্পী। কিন্তু কোনও রাষ্ট্রীয় পুরস্কার জোটেনি তার দীর্ঘ, বর্ণাঢ্য সংগীত জীবনে।

বার্তা বিভাগ প্রধান