রাজধানীর মেরাদিয়ার নোয়াপাড়া এলাকার একটি দ্বিতল বাড়ির নিচতলায় বসবাস করে ১১টি ভাড়াটিয়া পরিবার। একই ঠিকানা ও একই শ্রেণির শিক্ষার্থী হওয়ায় সেখানকার তিন কিশোরী—রুবিনা আক্তার মিম (১৩), রিজুয়ানা রিজু (১৪) ও বর্ষা আক্তারের (১৪) মধ্যে বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। সম্প্রতি তাদের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে যায়। হঠাৎ গত ২৯ জানুয়ারি দুপুরে বাসা থেকে উধাও হয়ে যায় ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া ওই তিন কিশোরী। নিখোঁজের ১০ দিন পর বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাতে খিলগাঁও থানা পুলিশ তাদের খোঁজ পেয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার বিখ্যাত ব্যান্ড বিটিএসের গায়কদের বিয়ে করার স্বপ্ন ছিল পলাতক ওই তিন কিশোরীর।
গাজীপুর জেলার টঙ্গী পশ্চিম থানা এলাকা থেকে ওই তিন কিশোরীকে উদ্ধার করেছে পুলিশ। রাতে উদ্ধারের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন ডিএমপির খিলগাঁও জোনের সহকারী কমিশনার (এসি) মো. মামুন।
তিনি বলেন, ওই তিন কিশোরী খুবই দুরন্ত প্রকৃতির। ঘটনার দিন তারা ঢাকা থেকে গাজীপুরে চলে যায়। একটি বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানেই বসবাস শুরু করে। শুধু তাই নয় কোরিয়ানদের মতো ফিটনেস অর্জনের উদ্দেশ্যে জিমেও ভর্তি হয়। ইন্টারনেট দেখে কোরিয়ানরা কীভাবে খায়, কি খায়—দেশটিতে যাওয়া প্রস্তুতি হিসেবে এসব শেখার চেষ্টা করছিল। তাদের পরিকল্পনা ছিল গার্মেন্টসে চাকরি করে যে টাকা পাবে তা দিয়ে কোরিয়ার বিটিএস ব্যান্ড দলের সদস্যদের কাছে চলে যাবে।
পুলিশের ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিস্তারিত জানার জন্য তাদের আরও জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তাদের মা-বাবাসহ স্বজনদের সামনেই জিজ্ঞাসাবাদ করবো আমরা। এসবের পেছনে অন্য আর কোনও কারণ রয়েছে কি না তখন হয়তো সেগুলো জানা যাবে।
নিখোঁজদের উদ্ধারে শুরু থেকেই মাঠে সক্রিয় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট।
বাংলা ট্রিবিউনের অনুসন্ধানে জানা যায়, নিখোঁজ রুবিনা ও বর্ষা মেরাদিয়ায় আলাদা দুটি মাদ্রাসায় পড়তো, আর রিজুয়ানা পড়তো বনশ্রীর একটি স্কুলে। তারা নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতো। সেখান থেকে ফিরে তিন বান্ধবী একে অপরের বাসায় একসঙ্গে সময় কাটাতো। এসময় রিজুয়ানার হাতে দেখা যেতো তার মায়ের স্মার্ট ফোনটি। বাড়ির মধ্যেই তিন বন্ধুর একসঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটানোর বিষয়টি স্বাভাবিক মনে করে খতিয়ে দেখেনি অভিভাবকরাও।
বাসা ছেড়ে যাওয়ার আগে রিজুয়ানা রিজু তার মাকে চিঠি লিখে যায়। চিঠিটিতে সে লেখে, ‘মা, আমাকে মাফ করে দাও। আমি বিটিএস-এর কাছে যাচ্ছি। সাউথ কোরিয়া যাবো। আর আমি গেলে তোমাদের তো খুব ভালো হবে— তাই না! আমাকে খোঁজার চেষ্টা করবে না। আমি বিটিএস-এর একজন মেম্বারকে বিয়ে করবো। আমি একা না আমার সাথে আরও তিন জন আছে। তোমরা আমার কোনও শখ পূরণ করো না। ভালো লাগে না, এজন্য আমি ঘর ছেড়ে গেলাম।’
সন্তানদের না পেয়ে খোঁজাখুঁজি শুরু করে মা-বাবা ও স্বজনরা। না পেয়ে ওদিনই (২৯ জানুয়ারি) খিলগাঁও মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন নিখোঁজ রুবিনার বাবা মো. রুবেল মিয়া। জিডিতে তিনি রুবিনার সঙ্গে তার দুই বান্ধবীর নিখোঁজের কথাও উল্লেখ করেন।
ওই তিন কিশোরীর স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তাদের সবার পরিবারই নিম্ন আয়ের। ভাড়া তুলনামূলক কম হওয়ায় মেরাদিয়া নোয়াপাড়ার ওই দ্বিতল ভবনের নিচ তলায় বসবাস করে তারা। রুবিনার বাবা রুবেল হোসেন একজন বিদ্যুৎকর্মী এবং মা অন্যের বাসায় কাজ করেন। বর্ষার বাবা মো. বশির রিকশা চালান, তার মা-ও অন্যের বাসায় কাজ করেন। আর রিজুয়ানার বাবা আসাদুজ্জামান রিপন একটি ওষুধ কোম্পানিতে সেলসম্যান হিসেবে কর্মরত ও মা বাসায় দর্জির কাজ করেন।
নিখোঁজ রুবিনার বাবা রুবলে হোসেন বলেন, ‘তারা তিন জন একসঙ্গে প্রতিদিন সময় কাটাতো। তবে স্কুল-মাদ্রাসায় তারা নিয়মিত যেতো। বিটিএস নামে অনলাইনে কী একটা যেন দেখে— বিষয়টি আমরা তেমন গুরুত্ব দেইনি। তবে এর থেকে এমন একটা কিছু হয়ে যাবে— সেটা ভাবতেই পারছি না। নিখোঁজ হওয়ার ৪/৫ সপ্তাহ আগে তারা খাওয়া-ঘুম ছাড়া বাকি সময় একসঙ্গে কাটাতো। রিজুয়ানা মেয়েটির কাছে তার মায়ের একটা ফোন ছিল। এ ফোনটা দিয়ে তারা বিভিন্ন কিছু দেখছে— এমনটাই আমার চোখে পড়েছে।’
রিজুয়ানার বাবা আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘মেয়ে নিখোঁজ হওয়ার আগের দিন বাসার লকারের চাবি হারিয়ে ফেলি। অনেক খোঁজাখুঁজির পরও পাচ্ছিলাম না। লকার থেকে স্বর্ণালংকারসহ চার লাখ নিয়ে যায় রিজুয়ানা।’
সিসিটিভি ফুটেজের বরাত দিয়ে তিনি আরও বলেন, ‘ওইদিন দুপুরে বাসার নিচ থেকে রিকশায় করে বের হয় আমার মেয়ে। রুবিনা আর বর্ষা আগেই চলে যায়। তারপর তারা কোথায় যে গেলো আর খোঁজে পাইনি।’
একমাত্র মেয়েকে না পেয়ে বর্ষার বাবা রিকশাচালক বশির দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। কাজকর্ম বন্ধ করে মেয়ের অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অনলাইন জগতে বেশ পরিচিত একটি নাম বিটিএস। দক্ষিণ কোরিয়ার সাত সদস্যের ‘বয় ব্যান্ড’ এটি। র্যাপ গানের জন্য এরা বিখ্যাত। ব্যান্ডটির একটি বিশাল ফ্যান-ফলোয়ার রয়েছে। এই ফলোয়াররা ‘ফ্যানডম আর্মি’ নামে পরিচিত। নিজেদের মধ্যে এই ফলোয়ারদের অনেক অনলাইন গ্রুপ ও প্ল্যাটফর্ম রয়েছে।
অনলাইনে শিশু-কিশোরদের আসক্তি প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ‘বর্তমানে প্রযুক্তির যে প্রসার ঘটেছে, তা যেমন দৈনন্দিন জীবনে অপরিহার্য— তেমনই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করাটাও প্রয়োজন। করোনাকালে যখন স্কুল-কলেজ বন্ধ ছিল, ওইসময়ে শিশু-কিশোরদের হাতে অনলাইনে পাঠদানের জন্য স্মার্ট ডিভাইস তুলে দেওয়া হয়েছে। আর সেটি প্রান্তিক পর্যায়ে এখনও অনিয়ন্ত্রিত রয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক— এসব প্ল্যাটফর্মে কোনও একটি চরিত্র দেখে নিজেকে আসল হিরো সাজাতে চাচ্ছে অনেক শিশু-কিশোর। সেগুলো বাস্তব জীবনেও প্রতিফলন ঘটাতে চায়।’
তিনি বলেন, ‘অনলাইনের ওইসব চরিত্রের মতো তারা জীবনযাপন করতে চায়। আরও উন্নত জীবন চায়। লেখাপড়া ও অ্যাসাইনমেন্টের নাম করে অনেকে স্মার্ট ফোন ব্যবহার করে। প্রকৃত অর্থে বিভিন্ন বিষয়ে আসক্ত হয়ে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করে ফোনে। এসব বিষয়ে যখন আরও সঙ্গী ও বন্ধু মিলে যায়, তখন তাদের কনফিডেন্স বেড়ে যায়। তখনই কোনও একটি সিদ্ধান্ত নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যায়। তবে এটা যে ঠিক পথ নয় বা স্বাভাবিক জীবন নয়— সেটা তারা বুঝতে পারে না। এমনকি তাদের অভিভাবকরা অনেক ক্ষেত্রে এসব বিষয় ধরতেও পারেন না। বিভিন্ন প্রলোভনে ঘর থেকে বের হয়ে কোনও কোনও ক্ষেত্রে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে, কিংবা অনেক সময় মেরেও ফেলে রাখে।
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে প্রান্তিক পর্যায়ে এবং কিছু উচ্চবিত্ত পরিবারে অভিভাবকরা ছেলে-মেয়েদের স্মার্ট ফোনের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারের কারণে তাদের যথাযথভাবে গাইড করতে পারছেন না। রাষ্ট্র, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সামাজিকভাবে সবাই মিলে এজন্য একটি গাইডলাইন তৈরি করতে হবে। কিশোর-কিশোরীদের বোঝানোর ব্যবস্থা করতে হবে। না হয় ভবিষ্যতে আমাদের জন্য খারাপ ফল বয়ে আনবে।’
বার্তা বিভাগ প্রধান