ঘনিয়ে আসছে নির্বাচন। বাড়ছে হার্টবিট। কারা হচ্ছেন সিলেটের ভাগ্যবান ৬ জন? যারা যাচ্ছেন সংসদে! আলোচনা বাড়ছে। চায়ের কাপে ঝড় তুঙ্গে। এগিয়ে আসছে ঝড় থেমে যাবার দিন। ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছে সম্ভাবনার প্রার্থীর তালিকা। এখন চলছে আলোচনা, বিশ্লেষণ। মূলত কোন দুজনের মধ্যে হবে লড়াই- এই তর্ক সর্বত্র। জমে উঠছে সবখানে।
বিএনপিসহ কিছু দল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিলেও থেমে নেই ভোট নিয়ে উচ্ছ্বাস-উত্তেজনা। নানান শঙ্কার মধ্যেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে সরকার দল আওয়ামী লীগসহ ছোট কয়েকটি দল। ভোটের মাঠে তাদের প্রার্থীরা আওয়ামী লীগের কাছে ‘পাত্তা’ পাবার কথা না থাকলেও সেই তারাই বড় ফ্যাক্টর হয়ে ভোটযুদ্ধে নেমেছেন। জয়ে বাধা হয়ে আছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা।
তাদের বেশিসংখ্যকই দলের ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’। যাদের বিদ্রোহের বৈধতা এবং অধিকার দিয়েছে আওয়ামী লীগ। দলীয় নেতাকর্মীদেরও পছন্দের প্রার্থীর হয়ে কাজের সুযোগ দেয়া হয়েছে। মূলত একটি ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’ হিসেবে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে প্রতিষ্ঠা করার স্বার্থে নির্বাচনে প্রার্থীদের অংশগ্রহণ এবং ভোটকেন্দ্রে ভোটারের উপস্থিতি বাড়ানোর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এ নীতিতে গিয়েছে সরকারি দল। ফলে বেশিরভাগ আসনে আওয়ামী লীগের মূল প্রতিদ্বন্দ্বি প্রার্থী হয়ে ওঠেছেন নিজেদের লোকই। সিলেটেও তাই হচ্ছে। তাদের মধ্যেই হচ্ছে সংসদে পৌঁছার লড়াই। তবে স্বতন্ত্র প্রার্থীদের মধ্যে কয়েকজন আছেন যারা আওয়ামী লীগ ঘরনার নন, তারাও উঠে এসেছেন আলোচনায়।
আওয়ামী লীগের বাইরে বড় কোনো দল নির্বাচনে না থাকায় সিলেট জেলার ৬টি আসনে নিজেদের প্রার্থী জয়ী হওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সেই সুযোগ নিচ্ছে না আওয়ামী লীগ। আসনগুলো থেকে প্রত্যেককেই নিজেদের যোগ্যতায় বেরিয়ে আসার সুযোগ ও নির্দেশনা দিয়েছে দলটি। তবে রাজনৈতিক সূত্র মতে, নির্বাচন পরবর্তী সরকারের স্বার্থে দলের বাইরে থেকে কয়েকজনকে সংসদে আসার পথ সুগম করে দেবে তারা।
সিলেট থেকে অন্তত ৫ টি আসনে দলীয় প্রার্থীকে না বসিয়ে অন্য দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীকে মৌন সমর্থন দিয়ে তাদেরকে বের করে আনতে পারে। একটি আসনে আওয়ামী লীগ কোনো প্রার্থীও দেয়নি। এরই মধ্যে এরকম কয়েকটি আসনে আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থী থাকার পরও ছাত্রলীগ, যুবলীগকে নামানো হয়েছে অন্য প্রার্থীর পক্ষে। তারা ‘উপরের নিদের্শে’ মাঠে নেমেছেন বলে একাধিক সূত্রকে জানিয়েছেন।
এছাড়াও কয়েকজন প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা ‘ইশারা’ পেয়েই নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন বা মাঠে লড়াইয়ে নেমেছেন এমন ইঙ্গিত দিয়েছেন। সিলেটে এরকম ১জন প্রার্থী আছেন যিনি গায়েবানা ভোটের স্বপ্ন দেখছেন। তিনি আছেন অনেকটা অটো-পাসের অপেক্ষায়। মাঠে তার খুব একটা তৎপরতা নেই। অনেকে মনে করছেন, কোনো সম্ভাবনা না থাকলেও তিনি শেষমেষ বৈতরণি পার হয়েও আসতে পারেন।
মিথ আছে, সিলেট-১ আসন যার, সরকার তার। অতীতে সবসময়ই এই মিথ বাস্তব হয়েছে। ফলে সঙ্গত কারণে এ আসনের গুরুত্ব অনেক বেশি। সিলেট-১ এ এবার বলতে গেলে আর কোনো প্রার্থীই নির্বাচনী মাঠে নেই। একাই আছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী একে আব্দুল মোমেন। তিনি নির্ভার। নৌকা ছাড়া সিলেট-১ আসনে অন্য কোনো প্রার্থীর পোস্টার-লিফলেট নেই। প্রচারণাও নেই। এ আসনে তার জয় এখন সময়ের অপেক্ষা মাত্র।
সিলেট-২ আসনে মাটি কামড়ে পড়ে আছেন গণফোরামের মোকাব্বির খান। সূর্য প্রতীক নিয়ে চষে বেড়াচ্ছেন পুরো সিলেট-২। অথচ তিনি জানেন তার ভোট ব্যাংক ‘শূণ্য’। গেলবার বিএনপির সমর্থন পেয়ে এবং ‘ইলিয়াস আলী’ আবেগ কাজে লাগিয়ে জয় পেয়েছিলেন। এবার সেই সুযোগও নেই। তারপরও মাঠ ছাড়ছেন না। গণফোরামের সাথে সরকারের শেষমেশ দেনদরবারে কোনো ‘ইশারা’-‘ইঙ্গিত’ এলে যদি লাভ হয়, সেই আশায় মাঠ ছাড়ছেন না।
একই অবস্থা সাবেক আরেক সংসদ সদস্য ইয়াহিয়া চৌধুরীর বেলায়ও। তিনি ‘ইলিয়াস আলী’ আবেগকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। অপেক্ষা করছেন জাপার সাথে সরকারের নতুন কোনো কৌশলে তার লাভবান হওয়ার সুযোগ তৈরি হয় কি-না। এরকম কিছু না হলে এ আসন থেকে খুব সহজে বেরিয়ে আসবেন নৌকার প্রার্থী, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাবেক সংসদ সদস্য, ক্লিনম্যান হিসেবে পরিচিত শফিকুর রহমান চৌধুরী। তবে কিছুটা ভোট টানতে পারেন বিশ্বনাথ পৌরসভার মেয়র মুহিবুর রহমান। আর এই ভোট হবে নৌকার। যদিও নানান সমালোচনা, উপজেলা চেয়ারম্যান থাকাকালিন সময়ে বিতর্কিত কর্মকান্ডে জড়িয়ে পড়া এবং মানুষের সাথে সুসম্পর্কের অভাবের কারণে ইমেজ সংকটে ভোগছেন তিনি। শফিক চৌধুরীর জয়ের বেলায় শেষমেষ তিনিও কোনোরকম বাধা হতে পারবেন না- এমনটিই মনে করছেন স্থানীয়রা। এ আসনে ইয়াহিয়া চৌধুরী এবং শফিক চৌধুরীর মধ্যেই হবে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। স্থানীয় সূত্র মতে, আওয়ামী লীগের একটি অংশ ইয়াহিয়া চৌধুরী ও মুহিবুর রহমানের হয়ে কাজ করছে। এটি শফিক চৌধুরীর গলার কাটা না হলে তার বেরিয়ে আসার সম্ভাবনাই বেশি।
সিলেট-৩ আসনে ডা. এহতেশামুল হক চৌধুরী দুলাল ‘নৌকা’ চেয়েও পাননি। পেয়েছেন বর্তমান তরুণ এমপি হাবিবুর রহমান। ফলে ডা. দুলাল আর ভোটে দাঁড়াবেন না- এরকম সিদ্ধান্ত নিয়েই বসে গিয়েছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত দাঁড়িয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, সরকার দল থেকে ‘ইশারা’ পেয়েই তিনি প্রার্থী হয়েছেন।
পারিবারিক অবস্থান, নিজের গ্রহণযোগ্যতা, শিক্ষা- সব মিলিয়ে একটি সম্ভ্রান্ত সমাজের প্রতিনিধি তিনি। বাংলাদেশের চিকিৎসকদের প্রভাবশালী ও মাদার সংগঠন ‘বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশন-বিএমএ’-এর মহাসচিব ডা. দুলাল। এলাকায় তার গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি। দলীয় ভোট ছাড়া হাবিবুর রহমানের ‘নিজস্ব’ কোনো ভোট এলাকায় নেই বললেই চলে। অনেকে মনে করছেন, প্রভাবমুক্ত ও সুষ্ঠু ভোট হলে বা কোনো অঘটন না ঘটলে ট্রাক মার্কা নিয়ে এ আসন থেকে বেরিয়ে আসবেন দুলাল। তবে হাবিবুর রহমানের জয়ের সম্ভাবনাকেও খাটো করে দেখছেন না কেউই।
সিলেট-৪ আসনে প্রায় একাই ধাপিয়ে বেড়াচ্ছেন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রী ইমরান আহমদ। উল্লেখ করার মত তার আসনে কোনো প্রার্থী নেই। ফলে তিনি নির্ভার থেকে জয়ের অপেক্ষায় দিনক্ষণ গুণছেন এখন।
সিলেট-৫ আসনে শেষ পর্যন্ত লড়াই থেকে হারিয়ে যেতে পারে ‘নৌকা’ প্রতীক। ইতোমধ্যে এর কিছু ইশারাও মিলেছে। উপজেলা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ‘কেটলি মার্কা’র পক্ষে নেমেছে। স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে কেটলি প্রতীকে লড়ছেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেম, ওলীয়ে কামেল আল্লামা ফুলতলী ছাহেব কিবলার (রহ.) এর ছোট ছেলে, আঞ্জুমানে আল ইসলাহ’র সভাপতি মাওলানা হুসাম উদ্দিন চৌধুরী ফুলতলী।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সরকার যেভাবেই হোক মাওলানা হুছামুদ্দীন চৌধুরী ফুলতলীর মত আলেম বা গ্রহণযোগ্য কাউকে এই রাজনৈতিক ও ইমেজের খরার মৌসুমে কাছে পাবার সুযোগ হাতছাড়া করবে না। প্রধানমন্ত্রীর সব সময়ের গুডবুকে, শ্রদ্ধার খাতায় লিখা ফুলতলী সাহেবের পরিবারের নাম।
এছাড়া কিছুদিন আগে শেখ হাসিনা মাওলানা হুসাম উদ্দিন চৌধুরীকে ডেকে নেন গণভবনে। তার পরামর্শে তিনি নির্বাচনে দাঁড়িয়েছেন। তবে রাজনীতি নয়, ব্যক্তি ও পারিবারিক ইমেজের কারণে ভোটের মাঠে তিনি এগিয়ে রয়েছেন। এ আসনে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি মাসুক উদ্দিন আহমদ দল ও দলের বাইরে নানান সংকটে ঘুরপাক খাচ্ছেন। আছেন ইমেজ সংকটেও।
ট্রাক প্রতীক নিয়ে এ আসনে জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতা ড. আহমদ আল কবির। এনজিও প্রতিষ্ঠান সীমান্তিকের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে এলাকায় তার গ্রহণযোগ্যতাও রয়েছে। আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশ পক্ষ নিয়েছে তার। ফলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মাসুক উদ্দিন আহমদ হলেও মাওলানা হুসাম উদ্দিন চৌধুরীর সাথে মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তার এমটিই মনে করছেন ভোটার ও স্থানীয় রাজনীতিকরা।
সিলেটের দুটি আলোচিত আসনের একটি সিলেট-৬। ৪ হেভিয়েট প্রার্থী নেমেছেন প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমান সংসদ সদস্য নুরুল ইসলাম নাহিদ লড়ছেন নৌকা নিয়ে। সরকারের নির্বাচনী শরিক দল তৃণমূল বিএনপির সভাপতি ও সাবেক জাদরেল কূটনীতিক শমসের মুবিন চৌধুরী আছেন সোনালি আঁশ প্রতীক নিয়ে। আছেন জাপার সাবেক সাংসদ ও বিরোধী দলিয় হুইপ সেলিম উদ্দিনও। তবে ক্লিন ইমেজ ও গ্রহণযোগ্যতার বিচারে সবচেয়ে আলোচিত মুখ হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কানাডা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি সরওয়ার হোসেন। রাজনৈতিক সমঝোতার স্বার্থে সরকার দল নাহিদকে পাশ কাটিয়ে অটো-পাসের আশায় থাকা শমসের মুবিন চৌধুরীর দিকে ঝুঁকতে পারে- এমন একটি বাতাস ছড়িয়ে পড়ছে সবখানে। দলের ভেতরেও এ নিয়ে নানা গুঞ্জন।
এটি ইতিবাচক হয়ে উঠছে ‘ঈগল’ প্রতীকে স্বতন্ত্র সরওয়ার হোসেনের জন্য। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের একটি বড় অংশই ভিড়েছে তার দিকে। তিনি জনসম্পৃক্ত নেতা হিসেবে এলাকায় সমাদৃত। ফলে ভোটের মাঠের গণজোয়ার এখন তার দিকে। শেষ পর্যন্ত নাহিদ-শমসের এরক কোনো দুটান শুরু হলে গোলাপগঞ্জ ও বিয়ানীবাজারের নৌকার বড় একটি ভোটের অংশ ঝুঁকতে পারে তার দিকে। এরকম হলে লাভ হবে তারই। এ আসনে তিনি বেরিয়ে আসতে পারেন। [সূত্রঃ শুভ প্রতিদিন]
প্রতিনিধি