বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়তে শুরু করেছে। ১৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে যাওয়া এই রিজার্ভ এখন ২১ বিলিয়ন ডলারের ঘরে উন্নীত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নানামুখী তৎপরতার পর এই রিজার্ভ বাড়ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগের সপ্তাহে রিজার্ভ ১৫১ কোটি মার্কিন ডলার বৃদ্ধির পর এই সপ্তাহে নতুন করে আরও ৭৬ কোটি ডলার বেড়েছে। এর ফলে পরপর টানা দুই সপ্তাহে রিজার্ভ বাড়লো ২২৭ কোটি মার্কিন ডলার।
আমদানি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানো উৎসাহিত করতে নানামুখী কার্যক্রম, রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল থেকে দ্রুত ঋণের অর্থ ছাড় এবং সর্বোপরি গৃহীত উদ্যোগের ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সামনের দিকে হাঁটা শুরু করেছে। এতে করে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকটি শক্তিশালী হওয়ার বার্তা দিচ্ছে।
জানা গেছে, আইএমএফের শর্ত অনুযায়ী চলতি ডিসেম্বর শেষে ১৭.৪৮ বিলিয়ন ডলার নিট রিজার্ভ রাখতে হবে।
/বাংলাদেশ ব্যাংকের বৃহস্পতিবার (২৮ ডিসেম্বর) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে গ্রস রিজার্ভের পরিমাণ ২৬ দশমিক ৮২ (২৬ বিলিয়ন) মার্কিন ডলার। আর বিপিএম-৬ (আইএমএফের ব্যালেন্স অব পেমেন্টস এবং ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল ৬ সংস্করণের সাথে সামঞ্জস্য রেখে বাংলাদেশ ব্যাংক গ্রস আন্তর্জাতিক রিজার্ভ সংকলন করেছে, যা বিপিএম-৬ নামে পরিচিত) অনুযায়ী ২১ দশমিক ৪৪ বিলিয়ন ডলার। এটাকে বাংলাদেশ ব্যাংক নেট রিজার্ভ বলে থাকে। যদিও প্রকৃত নেট রিজার্ভের পরিমাণ এখন ১৮ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি যা শুধু মাত্র আইএমএফকে জানায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
এক সপ্তাহ আগে অর্থাৎ ২০ ডিসেম্বর ছিল (বিপিএম৬) ২০ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। তার আগের সপ্তাহে অর্থাৎ ১৩ ডিসেম্বর রিজার্ভ ছিল ১৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।
এক সপ্তাহ আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ), এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণসহ অন্যান্য উৎস থেকে ডলার যোগ হওয়ায় রিজার্ভের এই পরিমাণ বেড়েছে।
উল্লেখ্য, গত ১২ ডিসেম্বর আইএমএফ ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির ৬৮৯ দশমিক ৮৯ মিলিয়ন ডলার অনুমোদন করে। এর দুই দিন পর ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে এ ডলার যোগ হয়। একই দিনে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের ঋণের ৪০০ মিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্টে জমা হয়। অন্যান্য উৎস থেকেও আরও রিজার্ভ জমা হয়।
এদিকে রিজার্ভ বাড়াতে বিভিন্ন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে ডলার কিনছে বাংলাদেশ ব্যাংক। মঙ্গলবার (২৬ ডিসেম্বর) ইসলামী ব্যাংক থেকে ২০০ মিলিয়ন ডলার কিনে রিজার্ভে যোগ করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর বাইরেও অন্যান্য ব্যাংক থেকে গত এক সপ্তাহে আরও ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক ডলার কেনার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, রিজার্ভ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। ধীরে ধীরে এর সুফলও মিলছে।
বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি উল্লেখ করেন, রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রতিনিয়ত ব্যাংকগুলোকে ডলার সাপোর্ট দিচ্ছে। আবার কিছু ব্যাংক থেকে ডলার কিনছেও। চলতি সপ্তাহে কয়েকটি ব্যাংক থেকে ডলার কেনা হয়েছে বলে জানান মুখপাত্র। তিনি বলেন, কোনও ব্যাংকের যদিও বৈদেশিক মুদ্রায় নিট ওপেন পজিশনে সারপ্লাস অবস্থায় থাকে, তখন তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করতে পারে।
উল্লেখ্য, কেন্দ্রীয় ব্যাংক গত তিন বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর কাছে ডলার বিক্রি করছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি করে ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৩.৫৮ বিলিয়ন ডলার এবং চলতি অর্থবছরের এ পর্যন্ত প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
মূলত খাদ্য, জ্বালানি, সারসহ ৫-৬ ধরনের ধরনের পণ্যের আমদানি বিল পরিশোধে এসব ডলার বিক্রি করতে বাধ্য হয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বর্তমানে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রি করছে ১১০ টাকায়। অন্যদিকে ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্স হিসেবে ডলার সংগ্রহ করছে ১০৯.৫০ টাকায়। যদিও এর বাইরে ব্যাংকগুলো নিজেদের ফান্ড থেকে রেমিট্যান্স ডলার সংগ্রহে সর্বোচ্চ ২.৫ শতাংশ প্রণোদনা দিতে পারে।
ব্যাংকাররা জানান, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিকল্পনাতেই ছিল ডিসেম্বরের শেষ দিকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ডলার কেনা হবে। সে পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই বেশ কয়েকটি ইসলামী ধারার ব্যাংক বেশি দাম দিয়ে রেমিট্যান্সের ডলার সংগ্রহ করেছে।
এদিকে ডলার সংকট ও রিজার্ভের চাপ কমাতে বিশ্ব ব্যাংকের কাছে বাড়তি ২৫ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা চাওয়া হয়েছে।
এর আগে সংস্থাটির কাছে মোট ৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চিঠি দিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
অর্থনীতির ধীরগতি কাটানোর মাধ্যমে স্থিতিশীলতা রক্ষা এবং বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতি শক্তিশালী রাখতে ‘সেকেন্ড রিকভারি অ্যান্ড রেসিলিয়েন্স ডেভেলপমেন্ট পলিসি ক্রেডিট’ প্রকল্পের আওতায় এ ঋণ চাওয়া হয়েছে।
এর আগে, গত ১২ ডিসেম্বর এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) বাজেট সহায়তার অংশ হিসেবে ‘ক্লাইমেট রেজিলিয়েন্ট ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম’ (সাবপ্রোগ্রাম-১) এর আওতায় ৪০ কোটি ডলার দিয়েছে। এ অর্থ এরই মধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যুক্ত হয়েছে। গত ১৮ ডিসেম্বর একই প্রকল্পের আওতায় অর্থায়ন করতে দক্ষিণ কোরিয়া ইআরডির সঙ্গে ৯ কোটি ডলারের একটি ক্রস চুক্তি করেছে। ইআরডি কর্মকর্তারা আশা করছেন, এটি দ্রুতই ছাড় হবে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে যুক্ত হবে।
এছাড়া এশীয় অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যাংক (এআইআইবি) বাংলাদেশের জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় একটি প্রকল্পের জন্য ৪০ কোটি ডলার দেবে বলে প্রতিশ্রুত দিয়ে রেখেছে। ওই অর্থও রিজার্ভে যুক্ত করে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
এদিকে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য মানুষের ঘরে থাকা ডলার ব্যাংকে ফেরানোর উদ্যোগের অংশ হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) হিসাবে জমার ওপর এখন থেকে ৭ শতাংশের বেশি সুদ দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। শুধু তাই নয়, বিদেশ ভ্রমণ শেষে দেশে ফিরে খোলা এ ধরনের হিসাব থেকে দেশের বাইরে অর্থ পাঠানো, একাধিক কার্ড ইস্যুসহ বিভিন্ন সুবিধা পাওয়া যাবে।
সম্প্রতি এ সংক্রান্ত এক নির্দেশনা ব্যাংকগুলোকে পাঠিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
উল্লেখ্য, এখন অনেকেই ডলার কিনে ধরে রাখায় বাজারে নগদ ডলারের চরম সংকট তৈরি হয়েছে। এ অবস্থায় ঘরে রাখা ডলার ব্যাংকে আনতে নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, কেউ যেকোনও প্রয়োজনে দেশের বাইরে গিয়ে ফেরার পর আরএফসিডি হিসাব খুলে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত জমা রাখতে পারেন। কেউ হয়তো যাওয়ার সময় ৫০০ ডলার সঙ্গে করে নিয়েছিলেন। ফেরার পর ১০ হাজার ডলার দিয়ে অ্যাকাউন্ট খুললেও কোনও প্রশ্নের মুখে পড়তে হবে না। মূলত মানুষের হাতে থাকা ডলার ব্যাংকে আনতে এমন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া অপর এক নির্দেশনার মাধ্যমে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো রেমিট্যান্সের সুবিধাভোগীর নামেও বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। সুবিধাভোগীর নামে খোলা অ্যাকাউন্টে তিন মাস থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে অর্থ রেখে ৭ থেকে ৯ শতাংশের বেশি সুদ পাওয়া যাবে, অন্যান্য দেশের তুলনায় যা বেশি। প্রবাসীর সুবিধাভোগী ছাড়া অন্য যারা বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খুলতে পারেন, তারাও এ হারে সুদ পাবেন। দেশের বাইরে ধরে রাখা ডলার আনতে এই নির্দেশনা দেওয়া হয়।
এর বাইরে ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম কমাতে বাধ্য করেছে ব্যাংকগুলোকে। ফলে এক মাসের কম সময়ের ব্যবধানে তিন দফায় ডলারের দর কমেছে এক টাকা। অর্থাৎ ধীরে ধীরে বাংলাদেশের টাকার মান বাড়ছে।
এছাড়া রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানোর জন্য আড়াই শতাংশ হারের সঙ্গে ব্যাংকের পক্ষ থেকে আরও আড়াই শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে।
রেমিট্যান্স প্রেরণকারীদের সিআইপি সম্মাননার পাশাপাশি রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সম্প্রসারণ ও সহজীকরণ, অনাবাসী বাংলাদেশিদের জন্য বিনিয়োগ ও গৃহায়ণ অর্থায়ন সুবিধা, ফিনটেক পদ্ধতির আওতায় আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার অপারেটরকে বাংলাদেশের ব্যাংকের সঙ্গে ড্রয়িং ব্যবস্থা স্থাপনে উদ্বুদ্ধকরণ এবং রেমিট্যান্স প্রেরণে ব্যাংক বা এক্সচেঞ্জ হাউসগুলোর চার্জ ফি মওকুফ করা হয়েছে। এমনকি রেমিট্যান্স আয় আনার ক্ষেত্রে ফরম-‘সি’ পূরণ করার শর্ত শিথিল করা হয়েছে। মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসের (এমএফএস) মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর সর্বোচ্চ সীমা বাড়িয়ে আগের চেয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। ফলে এখন থেকে সর্বোচ্চ ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি রেমিট্যান্স সুবিধাভোগীর কাছে পাঠানো যাবে। গত ৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পেমেন্ট সিস্টেম ডিপার্টমেন্ট (পিএসডি) এক সার্কুলারে জানিয়েছে, এখন থেকে প্রবাসীরা বিকাশ, নগদ বা রকেটের মতো এমএফএস অ্যাকাউন্টে সর্বোচ্চ আড়াই লাখ টাকা পাঠাতে পারবেন। সরকার বা ব্যাংকের পক্ষ থেকে দেওয়া প্রণোদনা আলাদাভাবে এমএফএস অ্যাকাউন্টে জমা হবে। রেমিট্যান্স প্রেরকরা এতদিন সর্বোচ্চ ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা পাঠাতে পারতেন।
জানা গেছে, এমএফএস হিসাবের মাধ্যমে প্রতি মাসে গড়ে ৪৫ থেকে ৫০ মিলিয়ন ডলারের মতো রেমিট্যান্স দেশে আসে।
এছাড়া ব্যবসায়ীদের নেওয়া বিদেশি ঋণের সুদের ওপর নির্ধারিত ২০ শতাংশ ট্যাক্স মওকুফ করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘যেভাবেই হোক রিজার্ভের পতন ঠেকানো দরকার। এজন্য উপায় একটাই— তা হলো ডলারের প্রবাহ বাড়াতে হবে। এ এজন্য ডলারের দাম বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ ও রফতানি আয় বাড়াতে হবে।