ভোরের আলো মাত্র ফুটে উঠছে ১৫ আগস্ট ১৯৭৫। অদূরে মসজিদের মিনার হতে ভেসে আসছে মুয়াজ্জিনের দরদমাখা গলায় আযানের ধ্বনি। ঠিক তখনই বেতারে মেজর ডালিমের ঘোষণা—জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সপরিবারের নিহত হওয়ার খবর। খবরটি তখনও কারোর কাছে বিশ্বাস হয়নি। এ খবরে প্রথম প্রতিবাদী হয়ে উঠে কিশোরগঞ্জের প্রগতিশীল যুবকরাা।
এরই মাঝে মানুষের মুখে মুখে রটে যায় বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। সঙ্গীদের একত্রিত করে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নিলেন তারা। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শহরের গৌরাঙ্গ বাজারের রঙমহল সিনেমা হলের পাশে ছাত্র ইউনিয়নের কার্যালয়ে একে একে করে সবাই জড়ো হলেন। সকাল সাড়ে নয়টা। ইতোমধ্যে সেখানে উপস্থিত হলেন ২০-২৫ জন যুবক।
সারাদেশের মতোই কিশোরগঞ্জের অবস্থা তখন থমথমে থাকায় সময়ক্ষেপণ না করে ইতিহাসের সবচেয়ে বর্বরোচিত-নৃশংস হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল বের করেন। শহরের আখড়াবাজার মোড় হয়ে প্রতিবাদ মিছিলটি শহরের পুরান থানা, বড়বাজার, গৌরাঙ্গ বাজার, রথখলা, কালীবাড়ি প্রদক্ষিণ করে ছাত্র ইউনিয়ন কার্যালয়ে এসে শেষ হয়। ছাত্র তরুণদের এই মিছিলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, কমিউনিস্ট ও ন্যাপের কর্মীরাও যোগ দেন।
ঐতিহাসিক প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন কমিউনিস্ট নেতা আমিরুল ইসলাম, সাইদুর রহমান মানিক, ভূপেন্দ্র ভৌমিক দোলন, অশোক সরকার, এনামুল হক ইদ্রিস, আলী আসগর স্বপন, হাবিবুর রহমান মুক্ত, গোলাম হায়দার চৌধুরী, পীযুষ কান্তি সরকার, অলক ভৌমিক, অরুণ কুমার রাউত, নির্মলেন্দু চক্রবর্তী, সেকান্দর আলী ভূঞা, হালিম দাদ খান রেজওয়ান,আব্দুল আহাদ, রফিকউদ্দিন পনির, গোপাল দাস, আকবর হোসেন খান, নূরুল হোসেন সবুজ, সৈয়দ লিয়াকত আলী বুলবুলসহ আরও অনেকেই।
তারা সেদিন কারফিউ ভেঙে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার বদলা নিতে। ‘মুজিব হত্যার পরিনাম, বাংলা হবে ভিয়েতনাম’ এই স্লোগানে মুখর হয় রাজপথ। আরও বলা হয়, ‘মেজর ডালিমের ঘোষণা মানি না, মানব না’, ‘মুজিব হত্যার বদলা নেব, বাংলাদেশের মাটিতে’, ‘সামরিক আইন তুলে নাও, গণতন্ত্র ফিরিয়ে দাও’—এসব স্লোগানে প্রকম্পিত হয় কিশোরগঞ্জ শহরের আকাশ।
মিছিল শেষে একটি চা স্টলে বসে মিছিলকারীরা যখন চা পান করছিলেন, তখন তাদের গ্রেফতার করতে এক ট্রাক পুলিশ সেখানে আসে। সঙ্গে সঙ্গেই প্রতিবাদকারীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে আত্মগোপন করেন।
মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন কিশোরগঞ্জ জেলার গণতন্ত্রী পার্টির সভাপতি, তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা অ্যাডভোকেট ভুপেন্দ্র ভৌমিক দোলন বলেন, ঘুম থেকে উঠেই যখন বেতারে বঙ্গবন্ধু হত্যার খবর শুনতে পাই, তখন কিছুক্ষণের জন্যে কিংকর্তব্যবিমুঢ় হয়ে পড়ি। এ হত্যার বদলা নিতে প্রতিবাদ মিছিল বের করার জন্যে দৌঁড়ে একেক জনের সঙ্গে গোপনে সাক্ষাৎ করে গৌরাঙ্গ বাজারের রঙমহল সিনেমা হলের পাশে অবস্থিত ছাত্র ইউনিয়নের জেলা কার্যালয়ের সামনে উপস্থিত হওয়ার অনুরোধ করি। এরপর আমরা ১৫-২০ জন মিলে সকাল সাড়ে নয়টায় প্রতিবাদ মিছিল শুরু করি। প্রতিবাদ মিছিল করাটা সেদিন এতো সহজ বিষয় ছিলো না।
তৎকালীন ছাত্রনেতা অ্যাডভোকেট অশোক সরকার বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মিছিল করা তো দূরের কথা একটা পাখি পর্যন্ত আকাশে উড়তে দেয়নি তৎকালীন সেনাবাহিনী ও তার দোসররা। শহরের সর্বত্র আতঙ্ক বিরাজ করছিলো, সেদিন ভয়ে কেউ ঘর থেকে বের হয়নি। আমরা জীবনবাজি রেখে বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করার সিদ্ধান্ত নেই। পরিবারের বাধা সত্ত্বেও সেদিন মিছিলে অংশগ্রহণ করি। মিছিলের পর থেকে আমি আর নিজ ঘরে ঘুমাতে পারিনি, পুলিশের মামলা-হামলার ভয়ে ফেরারি জীবন কাটতে হয়েছে পরবর্তী কয়েক বছর।
হাবিবুর রহমান মুক্তু সেদিনের মিছিলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সেদিন আমরা গুটিকয়েকজন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, ভয়ভীতি তোয়াক্কা না করে যত বাধাই আসুক আমরা প্রতিবাদ মিছিল করবোই। আমরা ওই প্রতিবাদ মিছিলটি স্বতস্ফুর্তভাবে অংশগ্রহণ করে স্বার্থক করেছিলাম। আর আমাদের ওই প্রতিবাদ মিছিলটিই ছিলো বঙ্গবন্ধুকে হত্যার প্রতিবাদে সারাদেশের প্রথম প্রতিবাদ মিছিল।
মিছিলে অংশগ্রহণকারী ডা. এনামুল হক ইদ্রিস সান্ত্বনা খোঁজে পান আদালতের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায়। তবে যারা এখনো বিদেশে পালিয়ে রয়েছে, তাদের অনতিবিলম্বে দেশে ফেরত এনে ফাঁসি কার্যকর করতে প্রধানমন্ত্রীর প্রতি আহ্বান জানান।
নির্বাহী সম্পাদক