বড়লেখা উপজেলার তারাদরম গ্রামের কিশোরী আফসানা বেগমের (১৪) অতিরিক্ত রক্তকরণে কারণে স্বজনরা তাকে বড়লেখার একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে ভর্তি করেন। চিকিৎসকরা জানান তাকে বাঁচাতে হলে রাতের মধ্যে ৩-৪ ব্যাগ রক্ত লাগবে। তখন কিশোরীর স্বজনরা বড়লেখা ব্লাড ডোনেট ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সঙ্গে সঙ্গে ক্লাবের তিনজন সদস্য গভীর রাতে ওই ক্লিনিকে গিয়ে ওই কিশোরীকে তিন ব্যাগ রক্ত দান করেন। রক্ত পেয়ে নতুন জীবন ফিরে পান ওই কিশোরী।
উপজেলার হরিনগর গ্রামের সমছ উদ্দিন (৭৮) কিডনি সমস্যায় ভুগছিলেন। কিডনি ডায়ালাইসিস করতে হঠাৎ তার রক্তের প্রয়োজন পড়ে। সমছের নাতি জামাল উদ্দিন যোগাযোগ করেন বড়লেখা ব্লাড ডোনেট ক্লাবের সদস্যদের সঙ্গে। খবর পেয়ে ওই রোগীকে এক ব্যাগ রক্ত দেন ক্লাবের এক সদস্য।
শুধু আফসানা বা সমছ উদ্দিনকে নয়, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এভাবে বিনামূল্যে রক্ত দিয়ে মানুষের প্রাণ বাঁচাতে কাজ করছে মৌলভীবাজারের বড়লেখার ব্লাড ডোনেট ক্লাব। ক্লাবের সদস্যরা এখনও পর্যন্ত ৫ হাজার রোগীকে রক্ত দিয়েছেন। বড়লেখা উপজেলার পাশাপাশি কখনও দূরদূরান্তের কারও রক্তের প্রয়োজন হলে ছুটে যাচ্ছেন ক্লাবের সদস্যরা। বিপদে রক্ত পেয়েও উপকৃত হচ্ছেন মানুষ। এতে অনেকে রক্তদানে উৎসাহীত হয়ে তাদের সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। তবে মাঝেমধ্যে রক্ত দিতে গিয়ে ক্লাবের সদস্যদের তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখিও হচ্ছেন।
শুরুতেই বড়লেখা ক্লাবের ৭ জন সদস্য থাকলেও বর্তমানে এর সংখ্যা ৩ হাজারের উপরে ছাড়িয়েছে। এছাড়া পাশের জুড়ী, কুলাউড়া এবং বিয়ানীবাজার উপজেলায় আরও ১ হাজার সদস্য রয়েছেন। মানুষকে স্বেচ্ছায় রক্তদানে উৎসাহ করতে ক্যা¤েপইন, বিনামূল্যে রক্তের গ্রুপ নির্ণয় সহ নানা কর্মসূচি পালন করছেন ক্লাব সদস্যরা।এছাড়া ক্লাবটি গরীব মেধাবী শিক্ষার্থীদের মাঝে শিক্ষা উপকরণ বিতরণের পাশাপাশি বিভিন্ন সমাজসেবামূলকও কাজ করছে।
ক্লাব সূত্রে জানা গেছে, ২০১০ সালের ঘটনা। মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলার পারভীন বেগম জরায়ু টিউমারের সমস্যায় ভুগছিলেন। তার রক্তের প্রয়োজন পড়ে। পারভীনের স্বজনরা কোথাও রক্ত পাচ্ছিলেন না। পারভীনের ভাই জাবেদ আহমদ পায়েল তার বন্ধু বড়লেখার নুরুল ইসলাম বাবলুর সঙ্গে যোগাযোগ করে বিষয়টি জানান। নুরুল তখন নিজে রক্ত দিতে রাজি হন। পারভীনের রক্তের গ্রুপের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় ওই দিন নুরুল ছুটে যান ঢাকায়। সেখানে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে পারভীনকে রক্ত দেন নুরুল। নুরুলের রক্ত পেয়ে সুস্থ হয়ে উঠেন পারভীন।
এরপর নুরুল ভাবতে থাকেন কখনও কারও রক্তের প্রয়োজন হলে তিনি তাকে রক্ত দেবেন। এরপর তিনি একটি রক্তদাতা সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কয়েকবার কয়েকজন রোগীকে রক্ত দেন। এভাবে রক্তাদাতা হিসেবে পরিচিত বাড়তে থাকে নুরুলের। কখনও কারও রক্তের প্রয়োজন হলে তার কাছে ফোন আসতে থাকে। রক্তের চাহিদা বাড়ায় নুরুল তখন বড়লেখায় একটি রক্তদাতা সংগঠন খোলার চিন্তা করেন। বিষয়টি তিনি তার বন্ধুসহ পরিচিত কয়েকজনকে জানান। এতে তারা সাড়া দেন। এরপর ২০১৪ সালের ১৪ জুন বিশ্ব রক্ত দিবসে নুরুল ইসলাম বাবলুকে সভাপতি ও আছলাম হোসেনকে সাধারণ সম্পাদক এবং মিসবাহ উদ্দিন, কামরুজ্জামান শামীম, বদরুল ইসলাম বদর, কামরুল ইসলাম ও খাইরুল ইসলাম মামুনকে সদস্য করে করে বড়লেখা ব্লাড ডোনেট ক্লাবের যাত্রা শুরু হয়।
এরপর থেকে সংগঠনের সদস্যরা কারও ফোন পেলে রক্ত দিতে ছুটে যাচ্ছেন। বড়লেখা উপজেলা ছাড়াও সিলেট বিভাগের বিভিন্ন জায়গার পাশাপাশি ঢাকায়ও গিয়ে মানুষকে রক্ত দিচ্ছেন ক্লাবের সদস্যরা। তাদের হিসেবমতে, এ পর্যন্ত ক্লাবের সদস্যরা ৫ হাজার রোগীকে রক্ত দিয়েছেন।
তারাদরম গ্রামের ছায়রা বেগম বলেন, অতিরিক্ত রক্তকরণের কারণে আমার মেয়ের অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তাকে হাসপাতালে ভর্তির পর ডাক্তাররা জানান, দ্রুত রাতের মধ্যে কয়েক ব্যাগ রক্ত লাগবে। নাহলে আমার মেয়েকে বাঁচাতে পারব না। পরে বড়লেখা ব্লাড ডোনেট ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা ৩ ব্যাগ রক্ত দিয়ে আমার মেয়ের প্রাণ বাঁচিয়েছেন। তাদের কাছে আমি চির ঋণী।
হরিনগর গ্রামের সমছ উদ্দিনের নাতী জামাল উদ্দিন বলেন, আমার দাদার কিডনি সমস্যা ধরা পড়েছে। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ডায়ালাইসিস করতে হবে। এজন্য রক্তের দরকার। দাদার রক্তের গ্রুপ অ-পজিটিভ। বিষয়টি বড়লেখা ব্লাড ডোনেট ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নুরুল ইসলাম বাবলু ভাইকে জানাই। তিনি পরে নিজে এক ব্যাগ রক্ত দিয়েছেন। রক্ত পেয়ে খুব উপকার হয়েছে। তাদের কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
ক্লাব সদস্য সাইফুল ইসলাম বলেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত। এ পর্যন্ত তিনি ২৮ জন রোগীকে রক্ত দিয়েছেন।
ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি নুরুল ইসলাম বাবলু বলেন, ২০১৪ সালে ১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবসে আমাদের ক্লাবের যাত্রা শুরু হয়। এ পর্যন্ত আমি ৩৩ জনকে রক্ত দিয়েছি। আমাদের ক্লাবের সদস্য সংখ্যা শুরুতে ৭ জন থাকলেও শুধু বড়লেখাতে ৩ হাজারের বেশি আছে। পাশের তিনটা উপজেলায় আরও ১ হাজার সদস্য আছে। তবে অনেক সদস্য আবার বিদেশে পাড়ি দিয়েছেন। বিদেশ থেকে কেউ দেশে এসে রক্ত দিচ্ছেন। রক্ত পেয়ে মানুষ সুস্থ হচ্ছেন। বিষয়টা খুব ভালো লাগে। আর কেউ মারা গেলে খুব কষ্ট লাগে। আমাদের ক্লাবের একেকজন সদস্য ১০-১২ বার রক্ত দিয়েছেন। এ পর্যন্ত আমরা প্রায় ৫ হাজার রোগীকে রক্ত দিয়েছি। এর সংখ্যা আরও বেশি হবে। তবে মাঝেমধ্যে কেউ রক্ত লাগবে বলে আমাদেরকে নিয়ে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেন। তখন খুব কষ্ট লাগে।
তিনি বলেন, প্রতিবার রক্তদানের পর রক্তদাতার অস্থিমজ্জা নতুন রক্ত কণিকা তৈরির জন্য উদ্দীপ্ত হয়। ফলে রক্তদানের দুই সপ্তাহের মধ্যে সে ঘাটতি পূরণ হয়ে যায়। শরীরের রক্ত কণিকা গুলোর মধ্যে লোহিত রক্ত কণিকার আয়ুষ্কাল সর্বোচ্চ ১২০ দিন। তাই ৪ মাস অর্থাৎ ১২০ দিন পর পর রক্তদানে শরীরের কোনো ক্ষতি নেই। রক্তদানে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
বড়লেখা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের ল্যাব টেকনোলজিস্ট মো. সুলতান আহমেদ বর্তমানে ডেপুটেশনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে আইএইচটিতে বিএসসি ইন ল্যাবরেটরী মেডিসিন কোর্সে রয়েছেন। তিনি বলেন, ২০১৪ সালে বড়লেখা হাসপাতালে সিজার বেশি হত। প্রতিটা সিজারের রোগীর জন্য ২-৩ ব্যাগ রক্ত দেওয়ার পাশাপাশি ক্যান্সার ও সাধারণ রোগীদের নিয়মিত রক্ত দিয়েছে ব্লাড ডোনেট ক্লাবের সদস্যরা। শুধু আমার হিসাবমতে, ক্লাবের সদস্যরা আড়াই হাজারের বেশি মানুষকে রক্ত দিয়েছেন। হয়ত এই সংখ্যা এখন আরও বাড়তে পারে।
উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মুহাম্মদ তাজ উদ্দিন বলেন, বড়লেখা ব্লাড ডোনেট ক্লাবের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে মানুষকে বিনামূল্যে রক্ত দিয়ে নি:সন্দেহে মহৎ কাজ করছে। যা প্রসংশার দাবি রাখে। এজন্য আমি তাদের বিভিন্ন পরামর্শ ও সহযোগিতা করি।
সিলেটভিউ২৪ডটকম
নির্বাহী সম্পাদক