Home » ঈদযাত্রায় যানজটের নেপথ্যে ‘খামখেয়ালিপনা’

ঈদযাত্রায় যানজটের নেপথ্যে ‘খামখেয়ালিপনা’

কোরবানির পশুবাহী ট্রাক, পিকআপ ও যাত্রীবাহী যানবাহনের চাপে রাজধানীর প্রধান সড়কগুলো যানজটে স্থির হয়ে থাকছে। তার প্রভাব পড়ছে অলিগলির সড়কেও। সমন্বিত ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার ফলেই এই অবস্থা তৈরি হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন। তবে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ঈদযাত্রীর চাপ বেড়ে যাওয়া ও কোরবানির পশু পরিবহনের ফলে যানজটের তীব্রতা দেখা দিয়েছে।

ঈদযাত্রীদের চাপে আজ সোমবার (১৯ জুলাই) রাজধানীর প্রধান প্রবেশপথগুলো অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে যানজটে। বিশেষ করে মহাখালী থেকে আব্দুল্লাহপুর অংশের অবস্থা সবচেয়ে সঙ্গীন ছিল। বাস ও অন্যান্য যানবাহনে যাত্রীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকে থাকেন যানজটে। সকাল সাতটায় মহাখালী থেকে মোটরসাইকেলে রওনা দিয়ে শফিকুল আজিম আব্দুল্লাহপুর পার হন বেলা একটায়।

তিনি বলেন, সকালে তীব্র যানজটের ফলে যান চলাচল বন্ধ ছিল কিছু সময়। স্টার্ট বন্ধ করে করে বসে থাকতে হয়েছে। একজন মোটরসাইকেল চালকের এই হাল হলে অন্যদের কী অবস্থা হয়েছে তা নিজেই বুঝে নেন। ট্রাফিক পুলিশ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারেনি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

আজ সোমবার (১৯ জুলাই) সকাল থেকে সায়েদাবাদ-যাত্রাবাড়ী-কাঁচপুর, গাবতলী-আমিন বাজার, যাত্রাবাড়ী-বাবু বাজার ব্রিজ, রামপুরা-ডেমরা, গুলিস্তান-সদরঘাট, মালিবাগ-প্রগতি সরণি-কুড়িল, মিরপুর রোডসহ প্রধান সড়কগুলোয় যানজট ছিল অতিরিক্ত। আগের দিন রোববারও রাজধানীজুড়ে যানজট ছিল।

সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সমন্বয় না থাকায় এবার এই বিপর্যয় হয়েছে। খামখেয়ালিপনা এড়িয়ে যানজট এড়াতে বাস্তবসম্মত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করলে ভোগান্তি অনেক কমত।

জানা গেছে, ঈদুল আজহা উপলক্ষে গত ২৯ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় মহাসড়ক, সড়ক ও শহর এলাকায় যানজট নিরসনে জন্য গুরুত্বপূর্ণ রাস্তার মোড়ে মহাসড়ক পুলিশ ও ব্যাটালিয়ান পুলিশ মোতায়নের সিদ্ধান্ত হয়েছিল। এছাড়া যানজটপ্রবণ স্থানগুলোয় ওয়াচ টাওয়ারের মাধ্যমে যানজটের কারণ চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এসব সিদ্ধান্ত শতভাগ বাস্তবায়ন হতে দেখা যায়নি বলে মন্তব্য করছেন পরিবহন খাত সংশ্লিষ্ট ও ভুক্তভোগীরা।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী বলেন, সরকারের সিদ্ধান্ত কাগজে থাকে, বাস্তবায়ন হয় না। ঢাকার বিমানবন্দর সড়ক হয়ে গাজীপুর অংশে গত ঈদের মৌসুমের চেয়েও এবার ভয়াবহতর অবস্থা চলছে। সকাল থেকেই যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। যানজটের ফলে ঢাকা থেকে বাস বের হতেই লাগছে তিন-চার ঘণ্টা। আর যাত্রীদের দুর্ভোগ তো আছেই। এবার যানজট নিরসন, সড়ক সংস্কার- কোনো বিষয়েই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। আমার নিজের বাড়ি গাজীপুরে। কিন্তু আমি গাজীপুরে যাব না। আমি মাফও চাই, দোয়াও চাই। বিমানবন্দর সড়ক থেকে গাজীপুর পর্যন্ত বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট বিআরটি প্রকল্পের কাজ বছরের পর বছর ধরে শেষ হচ্ছে না। রাস্তার পাশে নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা হয়েছে। আমি নিজের প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিদের বিষয়টি অবহিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেছি। ফল হয়নি।

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, এবার বিধিনিষেধ শিথিল করার পর গত ১৫ জুলাই থেকে ঈদযাত্রা শুরু হয়েছে। রোববার থেকে ঈদযাত্রীর চাপ সড়কে বেশি পড়ছে। এই অবস্থা থেকে যাত্রী দুর্ভোগ কমানোর জন্য সব সংস্থার সমন্বয়ে ব্যবস্থাপনা আমরা এবার দেখিনি। করোনাকালের আগে ঈদযাত্রার ব্যবস্থাপনা ভালো ছিল। এরপর তা ভেঙে পড়েছে।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, ঈদযাত্রা সুসমন্বিত ও সঠিক ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে সম্পন্ন করা উচিত। যাত্রীর চাপ যতোই থাকুক না কেন সুব্যবস্থাপনা থাকলে তার সুরাহা সম্ভব।

ট্রাফিক পুলিশ কর্মকর্তারা যা বললেন 

ডিএমপির ট্রাফিকের ওয়ারী বিভাগের (যাত্রাবাড়ী জোনের) সহকারী পুলিশ কমিশনার তারিকুল ইসলাম মাসুদ বলেন, ঈদযাত্রার পিক টাইম চলছে এখন। তাই রাস্তায় প্রচুর যানজট। আজ এই যানজট ছিল যাত্রাবাড়ী এলাকায়ও। আগামীকাল থেকে আশা করা যাচ্ছে রাস্তায় গাড়ির এত চাপ থাকবে না। কেননা, ঘরমুখো মানুষের চাপ অনেকটাই কমে যাবে।

ডিএমপির ট্রাফিক মিরপুর বিভাগের (দারুস সালাম জোন) সহকারী পুলিশ কমিশনার ইফতেখারুল ইসলাম বলেন, গাবতলীতে রাজধানী ঢাকার অন্যতম বড় একটি পশুর হাট রয়েছে। ঈদুল আজহা উপলক্ষে সারাদেশের খামারিরা ট্রাকে করে গরু নিয়ে গাবতলী হাটে প্রবেশ করছেন। এছাড়া ঈদকে কেন্দ্র করে রাজধানী ছেড়ে যাচ্ছেন ঘরমুখো মানুষ। এসব কারণে গাবতলী এলাকায় যানবাহনের চাপ তীব্র। যানজট সৃষ্টি হলেও গাড়ি চলছে। তবে কোরবানির পশুর হাট যতদিন পর্যন্ত চলবে গাবতলী এলাকার অবস্থা তেমন একটা পরিবর্তন হবে না। অবশ্য ঘরমুখো মানুষের চাপ কিছুটা কমে গেলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে বলে আশা করছি।

ডিএমপির ট্রাফিকের উত্তরা বিভাগের সহকারী পুলিশ কমিশনার (উত্তরা পশ্চিম জোন) সাইফুল মালিক জানান, ঈদযাত্রার চাপ শেষ পর্যায়ে আছে। মানুষজন এখন দলবেঁধে রাজধানী ছেড়ে নিজ নিজ গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছে। এই সময়ে এসে একটু যানজট হবে- এটাই স্বাভাবিক। তবে আজকের ঈদযাত্রায় গাড়ির চাপে অত্যধিক বেশি ছিল। টঙ্গীর যানজট খিলক্ষেত ছাড়িয়ে গেছে।

যানজট তীব্র

সোমবার দুপুরে রাজধানীর কুড়িল উড়ালসেতুর নিচে শত-শত গাড়ির চাকা স্থির হয়ে ছিল। মোটরসাইকেল চালকরাও সামনে এগোতে পারছিলেন না। বিমানবন্দর সড়ক হয়ে গাজীপুর ও বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন জেলার উদ্দেশে রওনা হওয়া যাত্রীরা বাস ও অন্যান্য পরিবহনে আটকে পড়েছিলেন। এই দৃশ্য দেখা গেছে মহাখালী, বনানীসহ বিমানবন্দর সড়কের বিভিন্ন অংশে। সকাল আটটা থেকে যানজট সৃষ্টি হলেও তা বিকেলেও দেখা যায়। বিমানবন্দর সড়কের যানজটের প্রভাব পড়ে কুড়িল-বিশ্বরোড ও প্রগতি সরণির সড়কে। বিকেল চারটায় প্রগতি সরণি থেকে কুড়িল অভিমুখী যানবাহনের জট তীব্র।

মিরপুর থেকে বিমানবন্দর সড়ক হয়ে চলতে গিয়ে বিপুল সংখ্যক যানবাহন স্থানে স্থানে আটকে পড়ে। সকাল থেকে শুরু হয়ে এই অবস্থা ধীরে ধীরে প্রকট হতে থাকে। ইসিবি চত্বর থেকে জিল্লুর রহমান উড়ালসেতু হয়ে বিমানবন্দর সড়কে উঠতেই স্বাধীন শেখ নামের এক প্রাইভেটকার চালকের চলে যায় প্রায় ৪০ মিনিট।

তিনি জানান, বিমানবন্দর সড়কে সারি সারি গাড়ি থেমে ছিল। জিল্লুর রহমান উড়ালসেতু থেকে বিমানবন্দর সড়কে উঠতে পারলেও কুড়িল উড়ালসেতুতে উঠতেই লাগে ২৫ মিনিট। মিরপুর চিড়িয়াখানা থেকে প্রাইভেটকারে বেলা পৌনে দুটায় রওনা দিয়ে স্বাধীন শেখ বারিধারায় পৌঁছান বিকেল সাড়ে তিনটায়।

বিমানে চড়ে সিলেট যাবার জন্য পল্লবীর বাসা থেকে বের হয়ে নাজিম উদ্দিন প্রাইভেটকারে জিল্লুর রহমান উড়াল সেতুতে ওঠার পরই তীব্র যানজটের মুখে পড়েন। নাজিম উদ্দিন জানান, মহাখালী থেকে বিমানবন্দর, উত্তরা হয়ে এই যানজট দীর্ঘ হয়েছে। সকালে অতিরিক্ত গাড়ির চাপে কুড়িল বিশ্বরোড থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত যান চলাচল বন্ধ ছিল কিছু সময়ের জন্য।

সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত যানজটের অবস্থা 

গাবতলী সিগন্যাল পেরোতেই লাগছে দেড় ঘণ্টা : সোমবার (১৯ জুলাই) সন্ধ্যায় সরেজমিনে দেখা যায়, যানবাহনের জটলা গাবতলী সিগনাল থেকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে পর্যন্ত গিয়ে ঠেকেছে। কিছুক্ষণ পরপরই হাটে পশু বোঝাই গাড়ি প্রবেশ করছে। আবার কিছুক্ষণ পর পর বের হচ্ছে।

একদিকে কোরবানির পশুর হাট, অন্যদিকে ঘরমুখো মানুষের চাপ। দুইয়ে মিলে গাবতলী সিগন্যাল যেন যানের সমুদ্রে রূপ নিয়েছে। এ সমুদ্র পাড়ি দিতেই কেটে যাচ্ছে দেড় ঘণ্টারও বেশি সময়।

টঙ্গীমুখী যাত্রীর চাপে খিলক্ষেতে যানজট : রাজধানীর বনানী ও খিলক্ষেত হয়ে বিমানবন্দর এলাকা দিয়ে যেসব গাড়ি টঙ্গী ও গাজীপুরে প্রবেশ করছে সেসব গাড়ির যাত্রীদের পোহাতে হচ্ছে সীমাহীন দুর্ভোগ। এ সড়কে সকাল ৮টা থেকে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়েছে। যানজট রয়েছে সন্ধ্যা ৭টায়ও। ঘণ্টার পর ঘণ্টা একই জায়গায় গাড়িতে বসে থাকতে হচ্ছে যাত্রীদের।

অন্যদিকে বিমানবন্দরের এ যানজটের প্রভাব পড়েছে কুড়িল-বিশ্বরোড ও প্রগতি সরণির রাস্তায়ও। সকাল থেকে প্রগতি সরণি এলাকায় হালকা যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। যা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তীব্র যানজটে রূপ নেয়।

ভোগান্তিতে রামপুরা হয়ে যাত্রাবাড়ী-সদরঘাটগামী যাত্রীরা : একদিকে ভ্যাপসা গরম, অন্যদিকে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। রাস্তায় যানজট। ফলে ভোগান্তিতে পড়েছেন রামপুরা হয়ে যাত্রাবাড়ী ও সদরঘাটগামী যাত্রীরাও। সন্ধ্যা ৭টায়ও এপথে যানজট রয়েছে।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *