শুদ্ধবার্তাটোয়েন্টিফোর: বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ইশতিয়াক হুসাইন গত ১৬ এপ্রিল ৭ হাজার ২৪৫ টাকা জমা দিয়ে জরুরি পাসপোর্ট নবায়নের (রি-ইস্যু) জন্য আবেদন করেন। ২৫ এপ্রিল তার নতুন পাসপোর্ট দেয়ার কথা ছিল। কিন্তু দুই দফা অধিদফতরে গিয়েও তিনি পাসপোর্ট হাতে পাননি। সর্বশেষ ২৯ মে (মঙ্গলবার) পর্যন্তও তিনি এই পাসপোর্ট হাতে পাননি।
একই অবস্থা কাফরুলের মোসাম্মৎ কামরুন্নাহার নামে এক গৃহিণীর। ২৭ শে মার্চ সন্তানসহ পাসপোর্ট নবায়নের আবেদন করেন তিনি। ১৭ এপ্রিল পাসপোর্ট দেয়ার কথা থাকলেও মঙ্গলবার পর্যন্ত অর্থাৎ ২ মাস পরও তিনি পাসপোর্টের জন্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। কবে পাবেন তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরের নিয়ম অনুযায়ী, একটি পাসপোর্ট সাধারণভাবে ইস্যু কিংবা রি-ইস্যু করতে ২১ দিন সময় লাগে আর জরুরি ভিত্তিতে ৭ দিন। তবে বর্তমানে দুই মাসেও হাতে পাওয়া যাচ্ছে না পাসপোর্ট।
সরেজমিনে আগারগাঁওয়ের বাংলাদেশ ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতরে গিয়ে দেখা যায়, আগে যেখানে পাসপোর্টের আবেদনের জন্য যেরকম ভিড় দেখা যেত এখন সেরকম ভিড় বাইরের তথ্য ও অনুসন্ধান কেন্দ্রে। সবার একই প্রশ্ন, ‘পাসপোর্ট কবে পাবো?’
ভুক্তভোগী ইশতিয়াক জাগো নিউজকে বলেন, এক মাস পরেও আমার পাসপোর্ট পাইনি। পাসপোর্ট অধিদফতরের তথ্য অনুসন্ধান রুমে গেলে সেখান থেকে আমাকে জানানো হয়- ‘কারিগরি সমস্যার কারণে পাসপোর্ট প্রদানে দেরি হচ্ছে। পাসপোর্ট প্রস্তুত হলে এসএমএস দেয়া হবে।’ তবে দেড় মাসেও এসএমএস পেলাম না।
অধিদফতরের অনুসন্ধান রুমের বাইরে সালমান ফারসি নামের এক আবেদনকারী জানান, ৩ জুন মাকে নিয়ে ওমরাহ হজ করতে যাওয়া কথা। রি-ইস্যুর জন্য দেড় মাস আগে আবেদন করেছিলাম কিন্তু আজ ২৯ তারিখে (মঙ্গলবার) এসেও পাসপোর্ট পাইনি। কর্মকর্তাদের কাছেও কোনো উত্তর নাই। গত ১২ দিন ধরে শুধু প্রিন্টিং দেখাচ্ছে।
বিলম্বের কারণ হিসেবে জাগো নিউজের অনুসন্ধানে জানা গেছে, ২০০৯ সালে কেনা অধিদফতরের ৩টি প্রিন্টারে নিয়মিতই যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দিচ্ছে। নিয়মিত ত্রুটি সারাতে গিয়ে পাসপোর্ট ছাপানোর কাজটি বিলম্ব হয়। তবে ৩টি প্রিন্টারের কোনোটিই অকেজো নয়। নিয়মিত ত্রুটি সারানোর কারণে প্রিন্টারগুলোর কার্যক্ষমতা কমে গেছে। আগে প্রতিদিন ৩টি প্রিন্টারে ১৮ থেকে ২২ হাজার পাসপোর্ট ছাপা হতো। এখন ছাপতে পারে ১২ হাজার। একজন আবেদনকারী আবেদন ফরম জমা দেয়ার পর ভেরিফিকেশন এবং ক্লিয়ারিংসহ সব তথ্য যাচাইবাছাই শেষে প্রিন্টে পাঠানো হয়। ২০১৪-১৫ সালে প্রিন্টের জন্য পাঠানোর ৩ দিনের মধ্যে পাসপোর্ট প্রিন্ট হয়ে রেডি হতো। তবে বর্তমানে সব ধাপ পেরিয়ে শুধু প্রিন্ট হতে সময় লাগছে ১২ থেকে ১৭ দিন। অর্থাৎ ৫ গুণ সময় বেশি লাগছে।
প্রিন্টিং রুমের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সপ্তাহে একদিন হলেও মেশিন ঠিক করতে হয়। ইলেকট্রনিক মেশিন, কোনো সিগন্যাল না দিয়েই থেমে যায়। ঠিক করতে ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে। নিয়মিত মেরামত করার কারণে এর কার্যক্ষমতা অনেক কমেছে। মেশিনগুলো ধীরগতিতে প্রিন্ট করে।
এদিকে বিলম্বের অন্যতম কারণ হিসেবে অধিদফতরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সম্প্রতি সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে ১৫ ক্যাটাগরিতে বাংলাদেশ থেকে শ্রমিক-কর্মচারী নেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এই ঘোষণার চলতি মাসের মে মাসের শুরু থেকে পাসপোর্টের আবেদনকারীর সংখ্যা প্রায় দেড়গুণ বেড়েছে। এছাড়াও সামনে হজের মৌসুম, অনেকেই হজের জন্য নতুন পাসপোর্ট তৈরি করছেন।
অধিদফতর থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, কুয়ালালামপুর পুলিশের সাঁড়াশি অভিযানের কারণে অবৈধভাবে মালয়েশিয়ায় যাওয়া অনেক শ্রমিক নতুন করে বৈধ হতে পাসপোর্ট তৈরি করছে। পাসপোর্ট অধিদফতরের এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, আগে মালয়েশিয়া দুতাবাস থেকে প্রতিদিন ৩০০ থেকে ৩৫০ শ্রমিক পাসপোর্টের জন্য এখন এই সংখ্যা ১ হাজার ৪০০।
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলা এমনকি বিশ্বের যে প্রান্ত থেকেই বাংলাদেশিরা পাসপোর্টের আবেদন করুক না কেন, এগুলোর ঢাকার আগারগাঁওয়ে হয়। এ কারণেই পুরানো প্রিন্টার নিয়ে একসঙ্গে অনেক পাসপোর্ট প্রিন্ট করা সম্ভব হচ্ছে না।
অধিদফতরের তথ্য ঘেটে দেখা গেছে, ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিদিন গড়ে ১৪ থেকে ১৫ হাজার পাসপোর্টের আবেদন পড়েছে। মে মাসে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২২ হাজার থেকে ২৫ হাজার।
এছাড়াও কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, পাসপোর্ট প্রদানের দীর্ঘসূত্রিতার আরেক কারণ ‘নিয়ম পরিবর্তন’। আগে পাসপোর্ট রি-ইস্যু করার সময় নির্দিষ্ট প্রমাণপত্র দিয়ে নাম-ঠিকানার মতো কিছু তথ্য ঠিক করা যেত। কিন্তু বর্তমানে পুরাতন পাসপোর্টের সঙ্গে নতুন পাসপোর্টের নাম-ঠিকানা, পিতা-মাতার নামসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হুবহু না মিললে স্বয়ংক্রিয়ভাবে পাসপোর্ট আবেদন বাতিল হয়ে যায়।
মঙ্গলবার পাসপোর্ট অফিসে গিয়ে মধ্যবয়সী এক ব্যক্তি সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। দীর্ঘ দিন পাসপোর্ট না পেয়ে অধিদফতরের ৬ তলায় মহাপরিচালকের (ডিজি) রুমের বাইরে তার সঙ্গে দেখা করার অপেক্ষা করছিলেন। সিদ্দিকুর রহমান নামে ওই ব্যক্তি বলেন, আমি ৩ মাস ধরে এমআরপি করার আবেদন দিয়েছি। এখনও পাসপোর্টের কোনো খোঁজ পাইনি। একারণে ডিজির সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
পরে অধিদফতরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, সিদ্দিকুর তার পুরানো এমআরপি প্রদর্শন না করে জন্ম তারিখ পরিবর্তন করে নতুন পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেন। আবেদনের সময় তার আঙ্গুলের ছাপ নেয়ার পর আগের পাসপোর্টের তথ্য চলে আসে। তাই তাকে পাসপোর্ট দেয়া হয়নি। প্রতিদিন প্রায় ১০০ থেকে ১৫০ জন পাসপোর্ট না পেয়ে অধিদফতরে আসছেন যারা নাম বা কোনো না কোনো তথ্য পরিবর্তন করেছেন বলে পাসপোর্ট পাচ্ছেন না।
এদিকে পাসপোর্ট বিলম্বের কারণের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজী হননি অধিদফতরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (এডিজি-পাসপোর্ট ভিসা ও ইমিগ্রেশন) সেলিনা বানু।
অধিদফতরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাসুদ রেজওয়ান বলেন, ‘পাসপোর্ট অফিসের একটি নিয়ম পরিবর্তনের কারণে একটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে। অনেকে নিজের দোষে পাসপোর্ট পাচ্ছেন না আর দোষ দিচ্ছেন আমাদের ঘাড়ে।’
অধিদফতরের প্রিন্টার মেশিনের সমস্যার কথা স্বীকার করে তিনি বলেন, মেশিনগুলো ৯ বছরের পুরানো। এখন আগের মতো সার্ভিস দিচ্ছে না, প্রায়ই ত্রুটি দেখা দিচ্ছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। মেশিনগুলোর প্রিন্টিং ক্যাপাসিটি কমেছে। এছাড়া রোজার মাসে কাজের সময় (অফিস টাইম) কম থাকায় পাসপোর্ট কিছুটা বিলম্বিত হচ্ছে। আমার বিশ্বাস রোজার পর সব ঠিক হয়ে যাবে।
পাসপোর্টের বই সংকট আছে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘বইয়ের কোনো সংকট নেই। বই আমাদের স্টোরে আছে। আরও বই আসবে।’
এদিকে ঢাকার প্রিন্টিং মেশিনের প্রভাব পড়েছে সারাদেশে। বগুড়ার প্রায় দশ হাজার আবেদনকারীর পাসপোর্ট নির্ধারিত সময়ের ২ মাসের মধ্যেও পাওয়া যাচ্ছে না। বগুড়া পাসপোর্ট অফিসের সহকারী পরিচালক (এডি) শরিফুল ইসলাম জাগো নিউজকে বলেন, ‘অতি শিগগিরই সংকট কেটে যাবে বলে আমরা আশা করছি। এখন শুধু জরুরি পাসপোর্টগুলো বিশেষ ব্যবস্থাপনায় দেয়া হচ্ছে।’
একই অবস্থা চট্টগ্রামে। ঢাকায় প্রিন্টার ত্রুটির কারণে প্রায় ১২ হাজার পাসপোর্ট ডেলিভারি দেয়া যাচ্ছে না।
নির্বাহী সম্পাদক