রাত ৩টা। দাবানলের মতো সিলেটজুড়ে ছড়িয়ে পড়লো একটি বিষাদখবর, তিনি নেই। ভোর রাতেই কেঁদে উঠলেন সিলেটের মানুষ। এমন দু:সংবাদের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউ। নিয়তির অমোঘ নিয়মে তবু তা শুনতে হলো।
তাঁকে আর পাশে পাওয়া যাবে না সুখে-দু:খে, এই পাথুরে অনুভূতি নিয়ে একটি সকাল আছড়ে পড়লো নগরবাসীর আঙ্গিনায়। ঘটনা গত বছরের এই দিনের।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। গত বছরের ১৫ জুন রাত পৌনে ৩টার সময় ঢাকার সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) স্ত্রী-সন্তান, আত্মীয়-স্বজন, রাজনৈতিক বন্ধু-বান্ধব, নেতাকর্মী ও প্রিয় নগরবাসীকে কাঁদিয়ে চলে যান না ফেরার দেশে।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরান ছিলেন আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির অন্যতম সদস্য। প্রাণঘাতি মহামারি কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া এই নেতা ছিলেন দল-মত নির্বিশেষে সিলেটে সবার প্রিয়।
কেউ বলতেন- জনতার কামরান। কেউ বলতেন- গণমানুষের নেতা। আবার কেউ বলতেন- রাজনীতির অভিভাবক। সবকিছু পেছনে ফেলে গত বছরের ১৫ জুন ভোররাতে পরপারে পাড়ি জমান সিলেটের সাবেক মেয়র ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। তার প্রস্থানে শোকে কাতর হয় সিলেট।
বদর উদ্দিন আহমদ কামরান সিলেটের রাজনীতি ও জনপ্রতিনিধির ইতিহাসের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। দীর্ঘ ৩৩ বছর জনপ্রতিনিধি হয়ে মানুষের সেবা করেছেন। তাঁর বাড়ির দরজা জনতার জন্য সবসময়ই থাকতো খোলা। তাঁর বাসার ড্রয়িং রুম প্রায় ২৪ ঘণ্টাই থাকতো সরব। আওয়ামী লীগের সাধারণ কর্মী থেকে হয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতা। এক জীবনে অনেক প্রাপ্তি ছিল কামরানের।
করোনাকালের শুরু থেকেই জনগণের কামরান জনগণের পাশেই ছিলেন। গত বছরের মার্চ মাসে লন্ডন থেকে সিলেটে ফিরেন তিনি। এরপর থাকে ১৪ দিনের হোম কোয়ারেন্টিনে। কোয়ারেন্টিন থেকে বেরিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েন মানবসেবায়। নিজ উদ্যোগে লকডাউনে ঘরবন্দি মানুষের দুয়ারে পৌঁছে দেন খাদ্যসামগ্রী। প্রায় প্রতিদিনই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় খাদ্যসামগ্রী নিয়ে ছুটে যেতেন তিনি। কখনো কখনো বাসায়ও আয়োজন করতেন ত্রাণ বিতরণের।
রমজান আসার পর আরো বেশি সক্রিয় হন কামরান। নিজের উদ্যোগে ত্রাণ বিতরণ ছাড়াও শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে পুরো রজমান মাসেই ইফতারসামগ্রী বিতরণ করেন। পাশাপাশি তিনি দলীয় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রমেও সক্রিয় ছিলেন। ঈদের দিনও নিজ বাসাতে সেমাই, লাচ্ছি রান্না করে গরিবদের মধ্যে বিতরণ করেন।
ঈদের পরপরই কামরানের পরিবার বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। এক সঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়েন কামরান ও তার স্ত্রী আসমা কামরান। দু’জনেই সর্দি-জ্বরে আক্রান্ত হন। করোনা টেস্টের জন্য ২৬ মে দুজনের একই সঙ্গে শরীরে নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরদিন (২৭ মে) কামরানের শরীরে করোনা ধরা না পড়লেও আসমা কামরানের রিপোর্ট পজেটিভ আসে।
স্ত্রী করোনা আক্রান্ত হওয়ায় মুষড়ে পড়েন কামরান। রাতে স্ত্রীর পাশেই জায়নামাজে বসে স্রষ্টার কাছ প্রার্থনা করতেন সহধর্মীনীর রোগমুক্তির। স্ত্রীকে এভাবে সঙ্গ দিতে গিয়ে নিজেই করোনায় আক্রান্ত হন কামরান।
৫ জুন কামরানেরও করোনা রিপোর্ট আসে পজেটিভ। খবর শুনেই ভেঙে পড়েন কামরান। রাতেই তার শারীরিক অবস্থার অবনতি হয়। বড় ছেলে ডা. আরমান আহমদ শিপলু বাসায় অক্সিজেন দেয়ার ব্যবস্থা করেন। এতে কামরানের শরীরের উন্নতি না হওয়ায় পরদিন (৬ জুন) তাঁকে ভর্তি করা হয় সিলেটের শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে। সেখানে ভর্তি করা হলেও শারীরিক অবস্থার উন্নতি হয়নি। বরং শরীরে নানা রোগ-ব্যাধির উপসর্গ আরো প্রকট হয়।
বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে কথা বলেন আসমা কামরান। এরপর প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে এয়ার এম্বুলেন্সযোগে ৭ জুন ঢাকার সিএমএইচ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এই জীবিত অবস্থায় তাঁর শেষ সিলেট দেখা। ওইদিন বিকেলে শামসুদ্দিন হাসপতাল থেকে অ্যাম্পুলেন্সযোগে সিলেট এয়াপোর্টে নিয়ে যাওয়ার সময় সেখানে এক হৃদয়বিদাক দৃশ্যের অবতরণা হয়। হুইল চেয়ারে বসা কামরান, মুখে অক্সিজেন মাস্ক। নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ঢাকায়, এ দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে কান্নায় ভেঙে পড়েন কামরানের পরিবার-পরিজন ও রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা। এসময় কামরান তাদের ভেঙে না পড়ে তাঁর জন্য দোয়া করতে হাত তুলে দেখান।
সিলেট থেকে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সযোগে ঢাকায় নিয়ে গিয়ে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) ভর্তি করানো হয় কামরানকে। সেখানে ভর্তির পরদিন তাঁর শরীরে প্লাজমা থেরাপি দেয়া হয়। এতে কিছুটা সুস্থ অনুভব করেন কামরান। ভালোর দিকে ছিল তার শারীরিক অবস্থা। ১৪ জুন বিকাল পর্যন্ত তার শারীরিক অবস্থা ভালোই ছিল।
কিন্তু ওই দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ করে কামরানের মাইল হার্ট স্ট্রোক হয়। ডাক্তাররা এসে দেখে চিকিৎসা দেন। এতে কিছুটা সুস্থ বোধ করেন। রাত দুইটার দিকে আবারো তার হার্ট অ্যাটাক হয়। ডাক্তাররা ছুটে এসে আপ্রাণ চেষ্টা করলেও আর কাজ হয়নি। সবাইকে শোক-সাগরে ভাসিয়ে রাত পৌনে ৩ টার দিকে মারা যান কামরান।
তার মৃত্যুর খবর সিলেটে এসে পৌঁছলে ভোর রাতেই কেঁদে উঠেন সিলেটের মানুষ। এমন মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত ছিলেন না কেউ। ফজরের নামাজের পর সিলেট শহরের প্রায় প্রতিটি মসজিদে কামরানের রুহের মাগফেরাত কামনা করে বিশেষ মোনাজাত করা হয়। এরপর নগরীর প্রায় প্রতিটি মসজিদে মৃত্যুর খবর জানিয়ে ঘোষণা দেয়া হয়।
শোকের আবহে ১৫ জুন সকালে ঘুম থেকে জেগে উঠে সিলেটের মানুষ। কামরানের শোকে পুরো সিলেট তখন স্তব্ধ। সব মত, সব পথের মানুষ এক সঙ্গে আহাজারি করে ওঠেন সেদিন। সিলেটের রাজনীতির ইতিহাসে এ এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়। অতীতে এভাবে কোনো রাজনৈতিক নেতার মৃত্যুতে সবাই এক কাতারে ঐক্যবদ্ধ হননি।
এদিকে সিএমএইচ-এ সকল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে সকাল ৭টার দিকে কামরানের লাশ নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সযোগে সিলেটের পথে রওনা দেন ছেলে আরমান আহমদ শিপলু। বাসায় করোনা আক্রান্ত স্ত্রী আসমা কামরান স্বামীর মৃত্যুর খবরে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। চিৎকার দিয়ে কাঁদতে থাকেন। সঙ্গে কাঁদেন স্বজনরা। বড় মেয়ে আশা পিতার জন্য আকুল ছিলেন। পিতার মৃত্যুতে ভেঙে পড়েন তিনি।
১৫ জুন সকাল ৯টায় সিলেট আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা রেড ক্রিসেন্টে বৈঠক করেন। ছিলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও। ওখানে বসেই সংক্রমণ বিধি মোতাবেক লাশ দাফনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। সকাল সাড়ে ৯টায় কামরানের বাসায় ছুটে যান সিলেটের বর্তমান মেয়র ও কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা আরিফুল হক চৌধুরী। তিনি সেখানে কামরানের স্বজনদের ধরে কান্না করেন।
দুপুরের দিকে কামরানের মরদেহ নগরীর ছড়ারপাড়স্থ বাসায় এসে পৌঁছলে কান্নার রোল পড়ে। লাশ দেখে হাউমাউ করে কাঁদেন সবাই। বড় ছেলে শিপলু লাশ নিয়ে বাড়িতে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। আগে থেকে সবকিছু ঠিক থাকার কারণে কামরানের মরদেহ নিজ বাড়ির উঠোনেই গোসল করানো হয়। এরপর কাফন পরিয়ে বাড়ির আঙ্গিনায় রাখা হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন স্ত্রী আসমা কামরানসহ পরিবারের স্বজনরা।
জোহরের আজানের সময় কামরানের মরদেহ নিয়ে আসা হয় পার্শ্ববর্তী ছড়ারপাড়স্থ মসজিদে। সেখানে প্রথম জানাজায় পরিবারের লোকজন ও এলাকার সীমিত সংখ্যক মানুষ অংশ নেন। সেখান থেকে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় নগরীর মানিকপীর (রহ.) গোরস্থানের মাঠে। দলীয় নেতাকর্মী, প্রশাসনের কর্মকর্তারাসহ অল্প কয়েকজন মূল মাঠে জানাজায় অংশ নেন। তবে পুলিশি বাধা উপেক্ষা করে কামরানের ঘনিষ্ঠ মানুষেরা পাশের রাস্তায় দাঁড়িয়ে জানাজায় অংশ নেন।
জানাযার পর সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা শফিউল আলম চৌধুরী নাদেল, অ্যাডভোকেট মিসবাহ উদ্দিন সিরাজ, আসাদ উদ্দিন আহমদ, নাসির উদ্দিন খানসহ সিনিয়র নেতারা একে একে কামরানের কফিনে ফুলের তোড়া দিয়ে শ্রদ্ধা জানান।
এ সময় পিতার লাশের পাশে দাঁড়িয়ে আব্বু আব্বু বলে আর্তনাদ করছিলেন বড় ছেলে ডা. আরমান আহমদ শিপলু। বার বার বলছিলেন- ‘আব্বু তুমি একা থাকতে ভয় পাও। এখন থাকবা কীভাবে। আমি বাসায় গিয়ে কারে আব্বা ডাকবো’ তার এমন আর্তনাদে উপস্থিত সবার গণ্ডদেশ বেয়ে গড়ায় ব্যথার রুধির।
কামরানের ইচ্ছা ছিলো- পিতা-মাতার পাশেই তাঁর কবর হবে। অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী কামরানকে মানিকপীর (রহ.) গোরস্থানেই তাঁর মাতা-পিতার পাশে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।
মৃত্যুর আগে বদর উদ্দিন আহমদ কামরান আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে নির্বাহী সদস্য ছিলেন। সিলেট সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে প্রথম নির্বাচনে মেয়র হয়েছিলেন তিনি। পরের দফায়ও একই পদে কারাগার থেকে নির্বাচিত হন কামরান। নিজের জীবনের প্রায় দুই ভাগ সময়ই (৪১ বছর) তিনি জনপ্রতিনিধি হিসেবে কাটিয়েছেন।
১৯৫৩ সালে জন্ম নেয়া বদর উদ্দিন আহমদ কামরান মাত্র ১৯ বছর বয়সে ১৯৭২ সালে তৎকালীন সিলেট পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। এরপর কমিশনার থেকে হন পৌরসভার চেয়ারম্যান। পৌর চেয়ারম্যান থেকে দু’বারের সিটি মেয়রও ছিলেন তিনি।
বার্তা বিভাগ প্রধান