অপরাধের যেন শেষ নেই টিকটকে। নেট দুনিয়ায় টিকটকসহ নানা নগ্নতার নোংরামিকে ঘিরে দেহব্যবসা এবং কিশোর গ্যাংকে ব্যবহার করে মাদক বাণিজ্য পরিচালনার ভয়ংকর সব তথ্য পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, টিকটকারদের বিরুদ্ধে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে মারামারি, হামলা, চুরি, ভয়ভীতি দেখানো ও হুমকি দেওয়ার অভিযোগ বেশ পুরনো। হালে টিকটককে কেন্দ্র করে ভয়ংকর সব অপরাধের শাখা-প্রশাখার বিস্তৃতি ঘটেছে। মানব পাচার, দেহব্যবসা, যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে মাদক ব্যবসা ও গ্যাং তৈরির প্ল্যাটফরম এখন এই টিকটক। সম্প্রতি ভারতে কয়েকজন মিলে এক বাংলাদেশি তরুণীকে যৌন নির্যাতনের ভিডিও অনলাইনে ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশ ও গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে বেরিয়ে আসে আঁতকে ওঠার মতো অজানা সব কাহিনি।
সূত্রগুলোর মতে, প্রভাবশালী কয়েকটি অপরাধী চক্র এসব অপরাধের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার অংশ হিসেবেই উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের নেট নগ্নতায় জড়ানোর ক্ষেত্রে এবং কিশোর গ্যাংকে পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইন্টারনেটে সংযুক্তির মাধ্যমে বিশ্বমানের জীবনধারা গড়ে তোলার ব্যাপারে এ প্রজন্মের আকাশছোঁয়া স্বপ্নে বিভোর থাকা এক কঠিন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এফবি, জিএফ, বিএফ, টিকটক, ভাইরাল, বিগো লাইভসহ নানা প্রক্রিয়ার ফাঁদে উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা অভাবনীয় সব অপরাধ-অপকর্মে জড়িয়ে নিজেদের জীবনকে তছনছ করে ফেলেছে। নেটের বদলে জুটে যাওয়া অতিমাত্রার ইঁচড়ে পাকা সঙ্গীদের অন্ধ ভক্ত হয়ে কৈশোর না পেরোনো এ প্রজন্মের বড় একটা অংশ সবকিছু খুইয়ে দিশাহারা। পারিবারিক সম্প্রীতি-বন্ধন, শিক্ষা, সভ্যতা, সম্ভ্রম সব হারিয়ে তারা নিজেদের জীবনকে যেমন বিষময় করে তুলেছে, তেমনি ধ্বংস করে দিয়েছে পরিবারের সুখ, শান্তি, স্বাচ্ছন্দ্য। জানা গেছে, ইন্টারনেটে টিকটক অ্যাপস ব্যবহার করে ছোট ছোট অভিনয়ের ভিডিও তৈরির মাধ্যমে হাজার হাজার লাইক সংগ্রহের বিপরীতে রাতারাতি সেলিব্রেটি হওয়ার নেশায় আটকে পড়েছে হাজারো কিশোরী-তরুণী। শুরুতে অভিভাবকদের ফাঁকি দিয়ে চুপিসারে টিকটক স্টাইলের ভিডিওতে অভিনয় করাকালেই বেশির ভাগ মেয়ে নানা রকম প্রতারণার ফাঁদে পড়ে। প্রথমদিকে সেসব ভিডিওর নির্মাতারাই অবুঝ কিশোরীদের নানা ফাঁদে ফেলে যৌন হয়রানি চালায় এবং সেসব নগ্ন দৃশ্য গোপন ভিডিও ক্যামেরায় ধারণ করে তা স্টক হিসেবে বিভিন্ন মেমোরি কার্ডে সংরক্ষণ করে থাকে। প্রতারকদের ভাষায় এসব স্টক শটকে ‘কট শট’ হিসেবেও প্রচার করে থাকে। এ কট শট একবার ভুক্তভোগী মেয়েকে দেখানোর পর থেকেই সে পুরোপুরি জিম্মি হয়ে পড়ে। তখন ভিডিও নির্মাতাদের আদেশ-নির্দেশের ক্রীড়নক হতে বাধ্য হয় তারা। সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, একেকজন ভিডিও নির্মাতার কাছে এক-দেড়শ মেয়ের নগ্ন দৃশ্য-সংবলিত ভিডিওচিত্র স্টক হিসেবে রাখার এন্তার নজির রয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, গত তিন বছরের মধ্যে রাজধানীতে ঘটে যাওয়া আলোচিত হত্যাকান্ডের বেশির ভাগই কিশোর অপরাধীদের দ্বারা সংঘটিত হয়েছে। কিছু দিন ধরে কিশোর গ্যাংগুলো আলাদা আলাদা গডফাদারের পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে তারা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মাদকে জড়িয়ে পড়ছে এবং কোনো কোনো গ্যাং সদস্যদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র তুলে দেওয়ারও তথ্য পাওয়া গেছে। ফলে কিশোর গ্যাংগুলো এখন পেশাদার অপরাধীদের মতোই মারাত্মক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এ কারণে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ, র্যাব ও থানা পুলিশ কিশোর গ্যাংগুলোর পৃথক তালিকা তৈরি করে এরই মধ্যে সর্বত্রই নিয়মিত অভিযান শুরু করেছে বলেও ডিবি সূত্র নিশ্চিত করেছে। এই গ্যাংগুলো তৈরি করা হয় মূলত ইন্টারনেটে বিভিন্ন গ্রুপ তৈরি করে। গোয়েন্দা সূত্র জানায়, কিশোর গ্যাংগুলোতে এখন দুই-তিন স্তরের সদস্য লক্ষ্য করা যায়। একটা শ্রেণির সদস্যরা কেবল আড্ডাবাজি, মারামারি, ইভ টিজিংয়ের মতো অপরাধে জড়িয়ে থাকে। তারা নেতা গোছের সিনিয়র কোনো সদস্যের নির্দেশনা অনুযায়ী যথারীতি হাজিরা দেয় এবং নির্দেশনা অনুযায়ী দলবেঁধে নির্দিষ্ট কাজে হামলে পড়ে। দ্বিতীয় পর্যায়ে অপেক্ষাকৃত কম সদস্যদের টিম সরাসরি মাদক ব্যবসা, চাঁদাবাজি, ছিনতাই, দখলবাজিসহ অর্থ-সম্পদ লুটপাটের ঘটনায় সম্পৃক্ত থাকে। এর ওপরের স্তরের হাতে গোনা দু-চারজন সদস্য মাদক ব্যবসায়ী বা অস্ত্রশস্ত্র প্রদানকারী গডফাদারদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে থাকে।
এক অনুসন্ধানে দেখা যায়, গত বছরের জুন মাস থেকে চলতি মে মাস পর্যন্ত ১১ মাসেই রাজধানী ও সংলগ্ন টঙ্গী, রূপগঞ্জ, সাভার, আশুলিয়া, কেরানীগঞ্জ এলাকায় শুধু টিকটক ভিডিও করার নামে শতাধিক মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ থানা পুলিশ পর্যন্ত গড়িয়েছে এবং সেসব ঘটনার বিচার চেয়ে আন্দোলন, মানববন্ধনসহ ব্যাপক হইচইয়ের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু ধর্ষণসহ নানা নির্মমতার শিকার হয়েও লোকলজ্জা ও নগ্ন ভিডিওর ফাঁদে আটকে থাকায় আরও কয়েকশ কিশোরী-তরুণী মুখ খুলতেও সাহস পায় না। জিম্মি হয়ে পড়া এসব কিশোরী-তরুণীকে পরবর্তী সময়ে নানা ধরনের নির্মমতার শিকার হতে হয়। তাদের নিয়ে দলবেঁধে ভিডিও তৈরির নামে নির্জন বাংলো বাড়ি বা ভাওয়াল গড়ের বিভিন্ন শুটিং স্পটে নিয়ে পর পর কয়েক দিন রাখা হয়। এ সময় ভিডিও নির্মাতারা তাদের পরিচিত মহলের বিভিন্নজনের মনোরঞ্জনে এসব মেয়েকে বাধ্য করে।
গেল বছর ২৭ ডিসেম্বর গাজীপুরের টঙ্গীতে টিকটক তৈরির কথা বলে এক কিশোরীকে দলবেঁধে ধর্ষণের ঘটনায় দুই কিশোরকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, নির্যাতিতা ওই কিশোরী টিকটক ভিডিও তৈরি করত। পরে সে মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে বিভিন্ন স্থানে থাকা বন্ধুদের একসঙ্গে টিকটক তৈরির প্রস্তাব দেয়। এরই সূত্রে ওই কিশোরী নানার বাড়ি যাওয়ার কথা বলে ২৩ ডিসেম্বর বাসা থেকে বের হয়ে নিখোঁজ হয়। পুলিশ আরও জানায়, তিন দিন একটি কক্ষে আটকে রেখে দলবেঁধে ধর্ষণের পর তাকে উদ্ধার করা হয়। ভিডিও তৈরির প্রলোভনে আটকে রেখে টানা ১১ দিন ধরে চার কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে রাজধানীর কুড়িল থেকে রসুল হৃদয় (২৪) নামে এক তরুণকে গ্রেফতার করে পুলিশ। গত বছর ২৮ সেপ্টেম্বর বিকালে ভাটারা থানা পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। গুলশান বিভাগের উপ-কমিশনারের (ডিসি) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এক দল কিশোর-কিশোরীকে নিয়ে অভিযুক্ত হৃদয় টিকটক ও লাইকির জন্য ভিডিও বানাত। তাদের মধ্যে পাঁচ কিশোরী চলতি মাসের ১৬ থেকে ২০ তারিখের মধ্যে হৃদয়ের কুড়িলের বাসায় আসে। এই পাঁচ কিশোরীর মধ্যে চারজনকে একাধিকবার ধর্ষণ করে হৃদয়। পরে এক কিশোরী থানায় মামলা করলে হৃদয়কে গ্রেফতার করে পুলিশ।
ইন্টারনেটে নানা রকম হয়রানির বিষয়ে প্রশাসনিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিতেই গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সাইবার পুলিশ সেন্টারের ফেসবুক পেজে ২৯ হাজার ৪০৩টি অভিযোগ জমা পড়ে। এ ছাড়া ফোনে অভিযোগ করেন আরও ৩৮ হাজার ৬১০ জন ভুক্তভোগী। এর মধ্যে হয়রানির অভিযোগ ৩৬৫টি। এসব ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৮২টি। মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে ১১৮টি। বাকিগুলোর তদন্ত চলছে। সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের কর্মকর্তারা বলছেন, দেশের ৬৮ শতাংশ নারী সাইবার স্পেসে নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। সাইবার বুলিংয়ের শিকার হওয়া এসব নারীর প্রায় সবাই তরুণী।
ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার অপরাধ বিভাগের আরেক পরিসংখ্যান সূত্রে জানা যায়, গত চার বছরে সাইবার ক্রাইম ইউনিটে প্রায় ৫ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে গত ছয় মাসে প্রায় ২ হাজার লিখিত অভিযোগ জমা পড়েছে। এতে তদন্তে নেমে হিমশিম খেতে হচ্ছে পুলিশকে। এর পাশাপাশি প্রতিবছর এ-সংক্রান্ত মামলার সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। শেষ ১০ মাসে সাইবার অপরাধ সংক্রান্ত ১ হাজার ৬৩৫টি মামলা হয় বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
বার্তা বিভাগ প্রধান