ঘূর্ণিঝড় ইয়াস-এর প্রভাবে মাঠপর্যায়ের ক্ষতি নিরুপণের কাজ শুরু করছে সরকার। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবধানে মাঠে কাজ করছে দেশের নয়টি জেলা ও ২৭টি উপজেলা প্রশাসন।
শুরুতে তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতির তথ্য তুলে আনবেন তারা। একইসঙ্গে ঘূর্ণিঝড় ইয়াস-এর প্রভাবে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়ক্ষতির তথ্যও সংগ্রহ করবেন। তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়ক্ষতি কাটাতে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করবে সরকার। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
ইয়াস চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যেসব তথ্য পাওয়া গেছে তাতে দেখা গেছে, দেশের নয়টি জেলার ২৭টি উপজেলায় এর প্রভাব পড়েছে। এসব অঞ্চলের বিভিন্ন স্থানে ট্রলারডুবি, কাঁচা ঘর ভেঙে যাওয়া, গবাদিপশু মারা যাওয়া, বাঁধ ভেঙে যাওয়া, মাছের ঘের ও সবজি বাগান তলিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ইয়াস আঘাত হানার অনেক আগেই মাছ ধরার ট্রলারগুলোকে নিরাপদ স্থানে চলে আসার জন্য বলা হয়েছিল। নির্দেশ অমান্য করে ট্রলারে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার ডুবে একজন মারা গেছে বলে জানা গেছে। উপকূলীয় অঞ্চলের দুর্গম চরে প্রায় ২৫০টি কাঁচা বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং জোয়ারের পানিতে ৯০০ গরু-মহিষ ভেসে গেছে বলে খবর পাওয়া গেছে।
ইয়াস ও পূর্ণিমার যৌথ প্রভাবে জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট বেশি বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন এলাকার বেড়িবাঁধ ভেঙে জোয়ারের পানি প্রবেশ করেছে। এতেও অনেক নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। বাঁধ ভেঙে পানি প্রবেশ করায় উপকূলীয় জেলাগুলোর ১০ থেকে ১২টি মাছের ঘের এবং কয়েক একর সবজি বাগান তলিয়ে গেছে। প্লাবিত হয়েছে ২০-২১টি গ্রাম।
এদিকে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়েছে, ইয়াস-এর প্রভাবে দেশের উপকূলীয় সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট, পিরোজপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, নোয়াখালী ও লক্ষ্মীপুর এই নয় জেলা ও এসব জেলার আওতাধীন শ্যামনগর, আশাশুনি, কয়রা, দাকোপ, পাইকগাছা, শরণখোলা, মোংলা, মোড়েলগঞ্জ, মঠবাড়ীয়া, বরগুনা সদর, পাথরঘাটা, আমতলী, পটুয়াখালী সদর, গলাচিপা, রাঙ্গাবালী, দশমিনা, মির্জাগঞ্জ, কলাপাড়া, চরফ্যাশন, মনপুরা, তজুমদ্দিন, দৌলতখান, বোরহানউদ্দিন, ভোলা সদর, হাতিয়া, রামগতি ও কমলনগর এই ২৭টি উপজেলার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
এসব এলাকার ক্ষতিগ্রস্তদের মানবিক সহায়তা দিতে সাড়ে ১৬ হাজার শুকনো ও অন্যান্য খাবারের প্যাকেট সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ‘ঘূর্ণিঝড় ইয়াস ভারতের উপকূল অতিক্রম করেছে। বাংলাদেশ এখন ঝুঁকিমুক্ত।
মন্ত্রণালয় সূত্র আরও জানিয়েছে, তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত বেড়িবাঁধগুলো মেরামতের কাজ শুরু হয়ে গেছে। কাজ শুরু হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাট মেরামতেরও। একইসঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত মাছচাষীদের আবারও ঘেরের কাজ শুরুর জন্য পোনা ও নগদ অর্থ সহায়তার কাজও চলছে। জেলা ও উপজেলা প্রশাসন স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করছে।
জানতে চাইলে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, উপকূলীয় জেলা, উপজেলাগুলোয় ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির তথ্য আদান-প্রদানে কাজ শুরু হয়েছে। সরকারের নিয়ন্ত্রণকক্ষগুলোয় এসবের তথ্য আসছে। এর বাইরেও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের এনডিআরসিসি (জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্র) ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ ও আদান-প্রদানে সার্বক্ষণিক কাজ করেছে।
মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, পটুয়াখালীতে জোয়ারের পানি বেড়ে যাওয়ায় জেলার ১৭২টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় ১৪ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছিল। এ জেলায় কোনও ক্ষয়ক্ষতির সংবাদ পাওয়া যায়নি। সাতক্ষীরায় জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ৩ থেকে ৬ ফুট বেশি হওয়ায় বিভিন্ন স্থানের বেড়িবাঁধ উপচে পানি প্রবেশ করেছে। জেলায় এক হাজার ২৯২টি আশ্রয়কেন্দ্র্রে ২৮০ জন আশ্রয় নিয়েছিল।
বরগুনায় জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট বেশি হওয়ায় বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। পিরোজপুর জেলার মঠবাড়ীয়া উপজেলার মাঝের চর এলাকার ১০-১২টি মাছের ঘের এবং কয়েক একর সবজি বাগান তলিয়ে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
ভোলায় জোয়ারের পানি স্বাভাবিকের চেয়ে ২-৩ ফুট উপরে উঠেছিল। এতে দুর্গম চরটির প্রায় ২৫০টি কাঁচা ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভেসে গেছে প্রায় ৯০০টি গরু-মহিষ।
বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ, শরণখোলা ও মোংলা উপজেলার ২০-২১টি গ্রামে পানি প্রবেশ করেছে। এতে দুই হাজার ৭০০ লোক ক্ষতির শিকার হয়েছে। লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি, কমলগঞ্জ উপজেলার নিচু এলাকায় সামান্য জোয়ারের পানি উঠেছে। এতে রাস্তাঘাট ও সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফেনী জেলায় নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মাছ ধরতে গিয়ে ট্রলার ডুবে একজন মারা গেছে।
জানতে চাইলে পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক মতিউল ইসলাম চৌধুরী জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে কোথায় কী ক্ষতি হয়েছে তা নিরুপণে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে জনপ্রতিনিধিরাও কাজ করছেন। তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি সমাধানে কাজ শুরু হয়েছে। সে বরাদ্দ আছে। তবে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণে সময় লাগবে। জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে তথ্য পেতেই মূলত সময় লাগছে বেশি।
দুর্যোগ ব্যবস্থপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমান জানিয়েছেন, তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ ও তা সমাধানে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ ও নির্দেশনা দেওয়া আছে। জেলা প্রশাসন কাজ করছে। তবে সামগ্রিক তথ্য পেতে মাসখানেক সময় লাগবে।
বার্তা বিভাগ প্রধান