কানাডার ডাক্তাররা গত কিছুদিন ধরে এমন কিছু রোগী পাচ্ছিলেন যাদের লক্ষণ মিলে যাচ্ছে মস্তিস্কের এক বিরল রোগের সঙ্গে, যেটি ‘ক্রয়েটসফেল্ট ইয়াকপ রোগ’ (সিজেডি) নামে পরিচিত। কিন্তু তারা আরও ভালোভাবে এসব রোগীকে পরীক্ষা করে যা দেখলেন, তাতে হতবাক হয়ে গেলেন।
প্রায় দু’বছর আগে রজার এলিস তার ৪০তম বিয়েবার্ষিকীতে বাড়িতে হঠাৎ খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে গেলেন।
মি. এলিসের জন্ম নিউ ব্রান্সউইকের গ্রামীন সৌন্দর্য্যমন্ডিত আকাডিয়ান উপদ্বীপ এলাকায়। বেড়ে উঠেছেন সেখানেই। তাঁর বয়স মাত্র ষাট পেরিয়েছে তখন, সেবছরের জুন মাসেও তিনি বেশ সুস্থ-সবল একজন মানুষ। কয়েক দশক ধরে তিনি কাজ করেছেন শিল্প-কারখানার মেকানিক হিসেবে। তারপর কাজ থেকে অবসর নিয়ে তার সময়টা ভালোই কাটছিল।
রজার এলিসের ছেলে স্টিভ এলিস জানান, যেদিন তার বাবা এভাবে খিঁচুনিতে আক্রান্ত হয়ে পড়ে গেলেন, সেদিন থেকে দ্রুত তাঁর স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে লাগলো।
“তিনি দৃষ্টিবিভ্রম এবং অলীক কল্পনায় ভুগতে লাগলেন, তার ওজন কমে যেতে শুরু করলো। মেজাজ খিটখিটে হয়ে গেল। একই কথা বার বার বলতে শুরু করলেন,” বলছিলেন তিনি।
“এক পর্যায়ে তিনি তো হাঁটতেই পারছিলেন না। মাত্র তিন মাসের মধ্যে তার অবস্থার এতটাই অবনতি ঘটলো যে আমাদের হাসপাতালে ডেকে নিয়ে ওরা বললো, তাদের বিশ্বাস আমার বাবা মারা যাচ্ছেন – কিন্তু তারা বুঝতে পারছেন না, কি রোগে।”
রজার এলিসের ডাক্তাররা প্রথমে সন্দেহ করেছিলেন তিনি হয়তো ‘ক্রয়েটসফেল্ট ইয়াকপ’ বা সিজেডি রোগে আক্রান্ত হয়েছেন। এটি একধরণের হিউম্যান প্রিয়ন রোগ। প্রিয়ন হচ্ছে এক ধরণের প্রোটিন, যা মস্তিস্কের স্বাভাবিক প্রোটিনকে আক্রমণ করে। সিজেডি খুবই বিরল এবং মারাত্মক এক রোগ। এটি মস্তিস্কের কর্মক্ষমতা হ্রাস করতে থাকে। আক্রান্ত লোকের স্মৃতি লোপ পেতে থাকে, ব্যবহার বদলে যায় এবং তারা চলা-ফেরা, কাজে-কর্মে আর কোন ভারসাম্য বজায় রাখতে পারে না।
সিজেডির অনেক ধরণের মধ্যে একটির সম্পর্ক আছে ম্যাড কাউ ডিজিজের সঙ্গে। ম্যাড কাউ ডিজিজে আক্রান্ত পশুর মাংস কেউ খেলে, এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে। রোগ হিসেবে সিজেডি-কে সেই শ্রেনীভুক্ত করা হয়, যার মধ্যে আরও আছে আলঝাইমার বা পারকিনসন্সের মতো রোগ। এরকম রোগে যখন কেউ আক্রান্ত হয়, তাদের স্নায়ুতন্ত্রের প্রোটিনগুলো বিকৃতভাবে ভাঁজ হতে থাকে।
কিন্তু ডাক্তাররা পরীক্ষা করে দেখলেন রজার এলিসের আসলে সিজেডি হয় নি। তার পরীক্ষার ফল নেগেটিভ আসলো। ডাক্তাররা আরও নানা রকম পরীক্ষা চালালেন। সেগুলোতেও তাদের সন্দেহ অমূলক বলে প্রমানিত হলো। কোনভাবেই তারা নিশ্চিত হতে পারলেন না, মিস্টার এলিসের অসুস্থতার কারণ আসলে কী।
তাঁর ছেলে জানান, ডাক্তাররা সাধ্যমত চেষ্টা করেছেন তার বাবার নানা রকমের উপসর্গ উপশমের জন্য। কিন্তু একটা রহস্য থেকেই গেল- কেন মি. এলিসের স্বাস্থ্য এত দ্রুত পড়ে গেল?
মংকটন শহরে কিছু লোকের মধ্যে এই রোগ দেখা দিয়েছে
ছবির উৎস,GETTY IMAGES
ছবির ক্যাপশান,
মংকটন শহরে কিছু লোকের মধ্যে এই রোগ দেখা দিয়েছে
এ বছরের মার্চ মাসে স্টিভ এলিস এই রহস্যের একটা সম্ভাব্য বা আংশিক জবাব পেলেন।
কানাডার সরকারি মালিকানাধীন রেডিও কানাডা জানালো, জনস্বাস্থ্য বিষয়ক এমন একটি নির্দেশ তাদের হাতে এসেছে, যেটি প্রদেশের স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়েছিল। এতে সবাইকে এই বলে সতর্ক করে দেয়া হয়েছিল যে, একটি এলাকায় এমন কিছু রোগী পাওয়া যাচ্ছে, যারা মস্তিস্কের এক অজানা রোগে আক্রান্ত, যেটি মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা ধ্বংস করে।
স্টিভ এলিস বলেন, “এটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো, আমার বাবার তো এটাই হয়েছে।”
ধারণা করা হচ্ছে রজার এলিস এই অজানা রোগে আক্রান্তদের একজন। তিনি ডাঃ এলিয়ের মারেরোর অধীনে চিকিৎসাধীন।
ডাঃ মারেরো একজন নিউরোলজিস্ট। কাজ করেন মংকটন শহরের জর্জেস এল-ডুমন্ট ইউনিভার্সিটি হাসপাতাল সেন্টারে।
তিনি জানান, ডাক্তাররা প্রথম এই রহস্যজনক রোগের সন্ধান পান ২০১৫ সালে। তখন মাত্র একজন রোগীর মধ্যে তারা এটি দেখেছিলেন, কাজেই এটা একেবারেই বিচ্ছিন্ন এবং অস্বাভাবিক একটি কেস হিসেবে ধরা হয়েছিল।
কিন্তু তারপর এরকম আরও অনেক কেস দেখা যেতে লাগলো। এখন এত বেশি মানুষের মধ্যে এই নতুন রোগ দেখা গেছে যে ডাক্তাররা এখন এটিকে একটি স্বতন্ত্র ধরণের রোগ বলে ধরে নিয়েছেন। তবে তারা এটিকে চিহ্ণিত করছেন “আগে দেখা যায়নি” এমন ধরণের এক রোগ হিসেবে।
প্রদেশের স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা বলছেন, তারা বতর্মানে ৪৮ টি কেসের ওপর নজর রাখছেন, এর মধ্যে ২৪ জন পুরুষ, ২৪ জন নারী। তাদের বয়স ১৮ হতে ৮৫ বছরের মধ্যে। এদের সবাই নিউ ব্রান্সউইকের আকাডিয়ান উপদ্বীপ বা মংকটন এলাকার বাসিন্দা। এই ৪৮ জনের মধ্যে ৬ জন মারা গেছেন।
নিউ ব্রান্সউইক এবং আকাডিয়ান উপদ্বীপ
বেশিরভাগ রোগীর উপসর্গ দেখা দিয়েছে সম্প্রতি, ২০১৮ সাল হতে। তবে এদের একজনের মধ্যে এটির লক্ষণ দেখা দেয় ২০১৩ সালে।
ডাঃ মারোরো জানান, এই রোগের লক্ষণ অনেক রকমের এবং রোগীভেদে লক্ষণ নানা রকম হতে পারে।
প্রথম দিকে রোগীদের মধ্যে কিছু আচরণগত পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা, বিষন্নতা এবং মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া। এরপর শরীরে এমন ধরণের ব্যাথা-বেদনা শুরু হয়, যার কোন ব্যাখ্যা নেই। একেবারে পুরোপুরি সুস্থ-সবল ছিলেন এমন মানুষদেরও তখন মাংসপেশির ব্যাথা এবং খিঁচুনি শুরু হয়।
রোগীদের মধ্যে ঘুম নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়- অনিদ্রা বা মারাত্মক অনিদ্রায় ভুগতে শুরু করেন তারা। এরপর শুরু হয় স্মৃতি লোপ পাওয়ার সমস্যা। এরপর খুব দ্রুতই দেখা দেয় কথা বলার সমস্যা। তারা নিজেদের মনের ভাব প্রকাশে সমস্যায় পড়েন। স্বাভাবিকভাবে কথা বলতে পারেন না। তাদের মধ্যে তোতলানোর সমস্যা দেখা দেয়, কিংবা একই শব্দ তারা বারে বারে বলতে থাকেন।
আরেকটা লক্ষণ হচ্ছে দ্রুত ওজন কমে যাওয়া। পেশি দুর্বল হতে শুরু করে, এর সঙ্গে দেখা দেয় দৃষ্টিশক্তির সমস্যা। চলাফেরায় সমস্যা তৈরি হয়। মাংসপেশিতে কোন কারণ ছাড়াই টান পড়তে থাকে। এরপর অনেক রোগীকেই হয় হুইলচেয়ার ব্যবহার করতে হয়, নয়তো চলাফেরার জন্য অন্য কারও সাহায্যের দরকার হয়।
অনেকে হ্যালুসিনেশনে ভুগতে থাকেন। বা এমন ধরণের স্বপ্ন থেকে জেগে উঠেন, যেটাকে তারা সত্য বলে ধরে নেন।
বার্তা বিভাগ প্রধান