Home » চেতনার মাধ্যম

চেতনার মাধ্যম

নাটক শুধুই অভিনয় নহে। ক্ষেত্রবিশেষে তাহা বাস্তব অভিজ্ঞতার এক জীবন্ত দলিল হইয়া উঠে। পুরুলিয়ার ২১ বৎসরের এক তরুণী বিবাহ-পরবর্তী জীবনে যে হিংসার সাক্ষী হইয়াছেন, সেই অভিজ্ঞতার কিয়দংশ তিনি তুলিয়া ধরিয়াছিলেন সমাজমাধ্যমে। তাহার উপর ভিত্তি করিয়াই লেখা হইবে নাটক। কলেজের ছাত্রছাত্রীদের লইয়া তৈরি এক নাট্যগোষ্ঠীর পরিচালনায় নাটকটি প্রদর্শিত হইবে। মূল চরিত্রে অভিনয় করিবেন নির্যাতিতা স্বয়ং। ঘটনাপরম্পরাটি কেবল অভিনব নহে, সম্ভাবনাময়। এই দেশের বহু গৃহকোণে যে অত্যাচার ঘটিয়া চলে, তাহার অনেকটাই অপ্রকাশ্য থাকিয়া যায়। এমতাবস্থায় নাটকের ন্যায় কোনও জনপ্রিয় মাধ্যমকে বাছিয়া লইলে সেই মর্মান্তিক ঘটনাগুলির ছবি দ্রুত অনেকের নিকট পৌঁছাইতে পারে। ইহাতে সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটি সহজতর হয়।

গার্হস্থ হিংসার ন্যায় জঘন্য সামাজিক অপরাধ দমনে অবশ্যই আইন প্রয়োজনীয়, প্রয়োজন পুলিশ-প্রশাসনের সক্রিয়তাও, কিন্তু তাহার সঙ্গে সঙ্গে এক সার্বিক সচেতনতা গড়িয়া তোলা আবশ্যক। গার্হস্থ হিংসা যে অমার্জনীয় অপরাধ, সেই বোধটি নির্যাতিতা এবং নির্যাতনকারী— উভয়ের মধ্যে জাগ্রত করিবার জন্যই সেই চেতনা জরুরি। নাটক, যাত্রা, পথনাটিকার ন্যায় মাধ্যমগুলি এই সচেতনতা প্রসারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা লইতে পারে। গার্হস্থ হিংসায় ভারতের স্থান বিশ্বের প্রথম সারিতে। ২০১৯ সালে ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস বুরো প্রদত্ত তথ্য অনুযায়ী, ভারতে মেয়েদের উপর সংঘটিত অপরাধের ৩০ শতাংশেরও অধিক নথিভুক্ত হয় ৪৯৮এ ধারার অধীনে। অতিমারি কালে এই চিত্র আরও ভয়ঙ্কর হইয়াছে। গৃহবন্দিত্ব ও আর্থিক অনিশ্চয়তার খাঁড়াটি তীব্র ভাবে নামিয়া আসিতেছে পরিবারের মহিলা ও শিশুদের উপর। কিন্তু এই সমাজে নেশাগ্রস্ত বা কর্মহীন স্বামী স্ত্রী-সন্তানের গায়ে হাত তুলিলে তাহাকে গুরুতর অপরাধ বলিয়া ভাবেন কয় জন? ভাবাইবার জন্য এমন মাধ্যম বাছিয়া লইতে হইবে, যাহা দ্রুত সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছাইতে পারে। যেমন, দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি বিদ্যালয়ে দশম শ্রেণির ইংরেজি পরীক্ষায় পুরুলিয়ার মেয়েটির কথা ‘আনসিন প্যাসেজ’ হিসাবে দেওয়া হইয়াছিল। সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। ছাত্রছাত্রীদের মধ্য দিয়াই তো সচেতনতার পাঠটি শুরু করিতে হইবে।

শুধু পারিবারিক হিংসা নহে, যে কোনও সামাজিক সচেতনতা প্রসারের ক্ষেত্রেই সহজবোধ্য এবং চিত্তাকর্ষক মাধ্যম অতি গুরুত্বপূর্ণ। পূর্বে কলেরার ন্যায় মহামারি ঠেকাইবার নিয়মগুলি পটচিত্রে বর্ণিত হইত। পশ্চিমবঙ্গে নব্বইয়ের দশকে বুজরুকি, কুসংস্কার দূর করিবার লক্ষ্যে নানা সংগঠন বিভিন্ন স্থানে জনসচেতনতা প্রসারের কাজ করিত। সম্প্রতি অতিমারির প্রথমার্ধে দেখা গিয়াছিল, পুলিশকর্মীরা বিভিন্ন পাড়ায় ঘুরিয়া গান গাহিয়া ঘরে থাকিবার প্রয়োজন ব্যাখ্যা করিতেছেন। তাহাতে কিছু কাজও হইয়াছিল। এইরূপে সরকারি বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা এবং প্রয়োজনীয় হেল্পলাইন নম্বরগুলিও যাহাতে সহজে সকলের নিকট পৌঁছানো যায়, তাহা লইয়া ভাবনাচিন্তা করিতে হইবে। আইন নিরাপত্তা বিধান করিবে, অধিকারগুলি সুনিশ্চিত করিবে। কিন্তু সেই আইনি সুবিধার কথা যাহাতে বালিগঞ্জ হইতে বড়ন্তি— সর্বত্র পৌঁছাইতে পারে, তাহার বন্দোবস্তও অত্যাবশ্যক।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *