লেখক মো. মঈন উদ্দিন : প্রাণঘাতী করোনা থেকে বাঁচতে হলে সংক্রমণ ব্যাধি করোনার সংক্রমণ চক্র ভাঙতে হবে। করোনার সংক্রমণ চক্র ভাঙতে না পারলে সংক্রমণ ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পাবে। সংক্রমণ অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি পেলে মৃত্যুও পাল্লা দিয়ে বাড়বে। আমরা সবাই জানি করোনার মৃত্যু হার বা কেস ফ্যাটালিটি শতকরা প্রায় ২ ভাগ। কেস ফ্যাটালিটির সহজ অর্থ হলো আক্রান্ত মানুষের মধ্যে মৃত্যুবরণকারী মানুষের সংখ্যা। করোনার ওয়ার্ল্ডোমিটারে দেখা যাবে—যে দেশে করোনায় যত বেশি মানুষ আক্রান্ত হয়েছে সে দেশে মৃত্যুর সংখ্যাও তত বেশি। তাই সংক্রমণ হ্রাস করতে পারলে মৃত্যুর সংখ্যা হ্রাস করা সম্ভব হবে। সংক্রমণ চক্র পরিপূর্ণ অনুসরণ ছাড়া কোন জীবাণু অর্থাত্ ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া কোনোভাবে সংক্রামক রোগ ছড়াতে পারে না।
রোগ বিস্তার বা মহামারি সংক্রান্ত বিজ্ঞান (ইপিডেমিওলজি) সংক্রমণ চক্রকে সুস্পষ্টভাবে চিহ্নিত করেছে। অনেক সংক্রমণ ব্যাধি বা মহামারির ক্ষেত্রে বিশেষ করে এটি যদি ভাইরাস বাহিত হয়, তাহলে ভাইরাস নির্মূল করে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সুস্থ্য করার কোনো কার্যকর ওষুধ নেই। কেবল সংক্রমণের কারণে সৃষ্ট শারীরিক সমস্যার লক্ষণ অনুযায়ী চিকিত্সা প্রদান করা হয়। করোনা ভাইরাস বাহিত কোভিড-১৯ মহামারি চিকিত্সার মাধ্যমে নির্মূল করা সম্ভব নয়। এই মহামারিকে নির্মূল করতে হলে এই ভাইরাসটির সংক্রমণ চক্র ভালোভাবে জানতে হবে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ চক্র যে কোনো পর্যায়ে ভাঙতে পারলে সংক্রমণ বন্ধ হবে এবং মৃত্যুর মিছিল থেকে মানুষ বেঁচে যাবে।
কোনো সংক্রমণ চক্রে একটি জীবাণু (যেমন—ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, পরজীবী) কোনো হোস্ট/রিজার্ভারে (যেমন-মানুষ, প্রাণি, মাটি, পানি) বাস করে সংক্রমণের ক্ষমতা বাড়ায়। হোস্ট থেকে নির্গমণ পথ (যেমন—মুখ, নাক, প্রস্রাব, মল) দিয়ে বের হয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে (যেমন—বাতাস, হাত বা শারীরিক সম্পর্ক) কম রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন হোস্টের (যেমন—মানুষ, প্রাণী) শরীরের বিভিন্ন প্রবেশ পথ (যেমন—নাক, মুখ, চোখ) দিয়ে প্রবেশ করে রোগের সৃষ্টি করে। রোগ বিস্তারের এই প্রক্রিয়া বা চক্রকে সংক্রামক রোগের সংক্রমণ চক্র বা চেইন অব ইনফেকশন বলা হয়। যে কোনো একটি পর্যায়ে চক্রটিকে ভাঙতে পারলে সংক্রমণ রোধ করে মহামারিকে পরাজিত করা যায়। কোভিড-১৯ বা বর্তমান করোনা মহামারির জীবাণু হলো করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাসের হোস্ট বা রিজার্ভার হলো মানুষ। আক্রান্ত মানুষের হাঁচি, কাশি, কথা, গান ইত্যাদির মাধ্যমে ভাইরাসটি বাতাসে ছড়ায়। এই ভাইরাস তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ভাইরাসের চেয়ে একটু বড় হওয়ায় আক্রান্ত ব্যক্তির নির্গমন পথ দিয়ে বের হয়ে ছোট জলকণা হিসাবে ৬ ফুট পর্যন্ত ভেসে থাকতে পারে। এই দূরত্বে মাস্কবিহীন কোনো ব্যক্তি থাকলে সরাসরি ভাইরাসটি এই ব্যক্তির নাক বা মুখ দিয়ে প্রবেশ করে তার দেহে সংক্রমণ ঘটায়। কোন সমাবেশ, বদ্ধঘর বা গণপরিবহনে এক বা দুুজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে এই ভাইরাস উপস্থিত সবার শরীরে সংক্রমণ ঘটাতে সক্ষম। এছাড়া ভাইরাসটি আক্রান্ত ব্যক্তির কথা, হাঁচি, কাশি, গান ইত্যাদির মাধ্যমে টেবিল, চেয়ার বা অন্য কোনো জায়গায় পড়ে বেশ কিছুদিন সক্রিয়ভাবে বেঁচে থাকে। এই সকল জায়গায় হাতের স্পর্শ লাগলে হাতে ভাইরাসটি লেগে যায়। ভাইরাসযুক্ত হাত দিয়ে চোখ, মুখ ও নাক স্পর্শ করলে সহজেই এই ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করে ব্যাপকভাবে সংখ্যা বৃদ্ধির মাধ্যমে রোগের সৃষ্টি করে। সঠিকভাবে স্বাস্থ্যবিধি মানলে এই মারাত্মক ভাইরাসকে কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করা সম্ভব। এই ভাইরাসটির সংক্রমণ চক্র ভাঙার জন্য সঠিকভাবে সবাইকে মাস্ক পরিধান করতে হবে। যে কোনো ধরনের সাবান দিয়ে দিনে প্রয়োজন অনুযায়ী ৮-১০ বার ২০ সেকেন্ড ব্যাপী হাত ধুলে ভাইরাসটির বাইরের চর্বির আবরণ গলে ধ্বংস হয়ে যায়। হাত ধোয়ার ব্যবস্থা না থাকলে বাজারে প্রচলিত স্যানিটাইজার দিয়ে হাত ভাইরাসমুক্ত করা যায়।
বাতাসে বা শরীরের বাইরে থাকাকালে এই দুর্বল ভাইরাসটিকে বর্ণিত সহজ পদ্ধতিতে প্রতিরোধ করতে না পারলে শরীরে প্রবেশ করে ভাইরাসটি লক্ষ-কোটিতে বংশ বৃদ্ধি করে প্রবল শক্তি নিয়ে মানুষের ফুসফুসে আক্রমণ করে ফুসফুসকে অকার্যকর করে দেয়। ফলে অক্সিজেন নির্ভর শরীরের গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অঙ্গ বিকল হয়ে মানুষ দ্রুত মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
বাঁচতে হলে এবং এই মহামারিকে পরাজিত করতে হলে মানুষকে অবশ্যই এই ভাইরাসের সংক্রমণ চক্র ভাঙতে হবে। মানুষের অবহেলা, গাফিলতি এবং নানান অজুহাতের কারণে এই সংক্রমণ চক্র ভাঙা সম্ভব হয় না। তাই দেশে দেশে লকডাউন এমনকি কারফিউ দিয়ে জোরপূর্বক সংক্রমণ চক্র ভেঙে ভয়াবহ সংক্রমণ ও গণমৃত্যু রোধ করতে হয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে স্বাস্থ্য বিধি না মানলে লকডাউন বা কারফিউ-এর মাধ্যমে জোরপূর্বক স্বাস্থ্যবিধির প্রয়োগ অপরিহার্য।
লেখক : সাবেক অতিরিক্ত সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।