সকাল, দুপুর বা সন্ধ্যায় ঘরের ভেতরে-বাইরে, যেখানে-সেখানে জ্বলে উঠছে আগুন। হঠাৎ জ্বলে ওঠা এ আগুনে পুড়ছে খড়ের গাদা, ঘরের ভেতরের আসবাব, বিছানা, খাদ্যশস্যের বস্তা এমনকি পোশাকপরিচ্ছদও। আগুনের উৎস খুঁজে বের করতে রাত-দিন চলছে পাহারা। লেগে যাওয়া আগুন সহজে নেভানোর জন্য স্থাপন করা হয়েছে কয়েকটি পানির পাম্প। উঠানে উঠানে নানা পাত্রে জমিয়ে রাখা হয়েছে পানি। কয়েক দিন ধরে এমন আগুন আতঙ্কে আছেন ওই গ্রামের লোকজন। উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজন গ্রামে গিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে বুঝে উঠতে পারছেন না।
রোববার বেলা সাড়ে ১০টার দিকে সরেজমিন ওই গ্রামে দেখা গেছে, এখানে-ওখানে মানুষের জটলা। নারী ও শিশুরা ঘরের বারান্দায় বসে আছে। পাশেই কাপড়চোপড়ের স্তূপ। আর উঠানে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে আধপোড়া বালিশ, তোশক ও নানা কাপড়। বাড়ির উঠানে পাতিল ও বালতিতে জমিয়ে রাখা হয়েছে পানি।
এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা বলেন, ২৫ দিন আগে হঠাৎই দিনের বেলায় গ্রামের বাসিন্দা মুসলিম উদ্দিনের (৪৮) খড়ের ঘরে প্রথমে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন এসে আগুন নেভান। সে সময় মো. সিরাজউদ্দিনের (৬৫) বাড়িতে খড় সংরক্ষণের ঘরে আগুন লাগে। ফায়ার সার্ভিসের লোকজন সেই আগুনও নেভান।
কয়েক দিন পর বাবুল হোসেন (৩৭) ও আবদুস সালামের (৩৮) বাড়ির খড়ে আগুন লাগে। এরপর থেকে প্রতিদিনই ওই গ্রামের দেলোয়ার হোসেন (৪১), মকসেদুল ইসলাম (৪১), মেরিনা বেগম (৪৬) ও মো. সাইফুল্লাহর (৩৬) মধ্যে কারও না কারও খড়ের গাদা, ঘরের বারান্দা ও ভেতরে থাকা খাট, তোশক, আলনা, আলনায় থাকা শাড়ি, লুঙ্গি, বিছানার চাদর ও ঘরে রাখা গমের বস্তা, খাবারের কনটেইনারসহ আসবাবে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে।
মকসেদুল ইসলাম বলেন, মাসখানেক ধরে চার-পাঁচটি পরিবারের মধ্যে কারও না কারও ঘরে আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। কখনো এক বাড়িতে একাধিকবার ঘটেছে। সব মিলিয়ে ৫০ বারের বেশি আগুন ধরার ঘটনা ঘটেছে। তবে তিন-চার দিন ধরে আগুন ধরার ঘটনা বেড়ে গেছে। গত শুক্র ও শনিবার আট-নয়বার আগুন ধরেছে। তবে সকাল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে ঘটনা ঘটছে বেশি।
আবদুল্লাহ আল মারুফ (১৯) বলেন, ‘রোববার সকাল ছয়টার দিকে দেলোয়ারের ঘরের বারান্দায় গুঁজে রাখা কয়েকটি দাওয়াত কার্ডে আগুন লাগে। সেই আগুন নেভানোর পর আমার ঘরের বিছানায় আগুন লাগে। পরে তিনি তাঁদের ঘরে পোড়া যাওয়া জিনিসপত্র দেখাতে নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যান। সেখানে তিনি একটি খাবার রাখার কনটেইনার দেখিয়ে বলেন, এই কৌটার ভেতরে খাবার ছিল। তার মধ্যেও আগুন লেগেছে। তাঁর বাড়ির গমের বস্তা ও ড্রামের ভেতর আগুন লাগে।’
গ্রামের বাসিন্দা আমেনা বেগম (৫০) বলেন, আগুনে পুড়ে যাওয়ার ভয়ে এসব বাড়ির কেউ ঘরের আলনায় কাপড় রাখছেন না। কয়েকবারের আগুনে তাঁর পরিবারের অনেকের শাড়ি, লুঙ্গি, জামা, তোশক পুড়ে গেছে।
মো. সিরাজউদ্দিন বলেন, গ্রামের নারী-পুরুষ সবাই সপ্তাহ দুয়েক ধরে আগুন লাগার আতঙ্কে ঘুমাতে পারেন না। রাত-দিন পালা করে আগুনের ধোঁয়া খুঁজে বেড়ান। তাঁর সঙ্গে কথা বলতে বলতে দুপুর পৌনে ১২টার দিকে ‘আগুন লেগেছে আগুন লেগেছে’ বলে চেঁচামেচি শুরু হয়। গ্রামের নারী-পুরুষ-শিশুরা পানিভর্তি পাত্র নিয়ে দেলোয়ারের খড়ের গাদার দিকে ছুটে গেলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে ওই আগুন নিভে গেল।
সিরাজউদ্দিন একটি পানির পাম্প দেখিয়ে বললেন, ‘যেখানে-সেখানে ধরা আগুন থেকে রক্ষায় আমরা চারটি পাম্প বসিয়েছি। এরপরও বাড়ির উঠানের আশপাশে পাতিল-বালতি ভরে পানি রাখছি। বিষয়টি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান, পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিসের লোকজনকে জানালে তাঁরাও গ্রামে এসে ঘটনা দেখে গেছেন।’
গ্রামের বাসিন্দা মো. সামসুজ্জোহা (৪৮) বলেন, ‘এ রকম আজব ঘটনা আগে কখনো দেখিনি। হঠাৎ যেখানে-সেখানে আগুন ধরে যাওয়ায় গোটা গ্রামে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। রাত-দিন পাহারা দিচ্ছি। কিন্তু আগুনের উৎস কী, তা খুঁজে পাচ্ছি না।’
মেরিনা বেগম বলেন, ‘ভয়ে রাতে ঘুমাতে পারি না। কখন সব পুড়ে যায় কে জানে।’ ঘটনা শুনে ওই গ্রামে অনেকবার গিয়েছেন চাড়োল ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান দিলীপ কুমার চ্যাটার্জী। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘গ্রামের বাসিন্দারা আগুনে পুড়ে যাওয়া খড়ের স্তূপ, আসবাব, কাপড়চোপড় দেখিয়েছেন। সান্ত্বনা দিয়েও তাঁদের মধ্যে আতঙ্ক কাটাতে পারিনি।’
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের টিম লিডার শফিউল্লাহ বসুনিয়া বলেন, ‘প্রথম আগুন লাগার দিনে আমি ওই গ্রামে গিয়েছিলাম। একটি আগুন নেভানোর পর আরেকটি জায়গায় আগুন লাগে, সেটাও নেভাই। শুনেছি এরপর সেখানে কাপড়চোপড় ও ঘরের জিনিসে বারবার আগুন লাগছে। কী কারণে এমন ঘটছে, আমরা বলতে পারছি না।’
জানতে চাইলে বালিয়াডাঙ্গী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহা. যোবায়ের হোসেন বলেন, ‘আমরা শুনেছি ছোট সিঙ্গিয়া মুন্সিপাড়ার বাড়িঘরে হঠাৎ আগুন ধরে যাচ্ছে। আমি ওই গ্রাম পরিদর্শন করেছি। এর কারণ উদ্ঘাটনের জন্য আমরা ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের কর্মকর্তাকে বলেছি। রাসায়নিক বিষয় নিয়ে যেসব দপ্তর কাজ করে, তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করছি। আশা করছি দ্রুত এ ঘটনার সুরাহা হবে।’
বার্তা বিভাগ প্রধান