জয়ন্ত ঘোষাল:
২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন ধীরে ধীরে অনেকটাই হয়ে গেল। সবথেকে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল, আট দফায় ভোট হওয়ায় সবচেয়ে বেশি সময় নিয়ে ভোট হচ্ছে এই পশ্চিমবঙ্গে। এদিকে আবার করোনার দ্বিতীয় ঝড় উঠেছে! হাজার হাজার মানুষআক্রান্ত হচ্ছেন। জনসভায় রাজনৈতিক নেতারা যখন ভোট প্রচারে ব্যস্ত তখন দেখাযাচ্ছে, তাঁর চারপাশের মানুষেরা অধিকাংশই মাস্ক ছাড়া ঘোরাঘুরি করছেন। টানা দু’মাসধরে পশ্চিমবঙ্গের জেলায় জেলায় ঘুরে, করোনা সচেতনতার কোনও পরিচয় অন্তত আমার চোখে পড়ল না।
বারবার বলছি, এবারের নির্বাচন একটা অভূতপূর্ব নির্বাচন! এককথায় বলা যায়, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে এর চেয়ে কঠিন নির্বাচন এর আগে কখনও আসেনি। তাঁর জন্যে এটা একটা মস্ত বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ কেন্দ্রের ক্ষমতায় বিজেপি থাকার ফলে, শুধু তো কেন্দ্রের সরকার নয়, নির্বাচন কমিশন, সব রাজ্যের সংবাদ মাধ্যম, গোয়েন্দা এজেন্সি এবং অন্যান্য সমস্ত পরিকাঠামো বিজেপির পক্ষে থাকে।
এবারে যে লড়াইটা হচ্ছে, সেটা কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম দিলীপ ঘোষ বা রাজ্য বিজেপি নয়। কারণ, রাজ্য বিজেপির সেই শক্তি, সেই সাংগঠনিক ক্ষমতা, এখনও পর্যন্ত সেইভাবে গড়ে ওঠেনি। শুধুমাত্র দিল্লির প্রবল উৎসাহে, প্রবল সক্রিয়তায় এবং দীর্ঘদিন ধরে রণকৌশল নেওয়ার ফলে, আরএসএস বা সঙ্ঘ পরিবারের সাহায্যে পশ্চমবঙ্গে বিজেপির রাজনৈতিক প্রতিপত্তি অনেকটাই বাড়াতে সক্ষম হয়েছে। কাজেই, আজ বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে দ্বিতীয় বৃহত্তম বিরোধী দলে পরিণত হয়েছে।
সেই কারণে, এখন লড়াইটা হচ্ছে মমতা বনাম মোদির। এককথায় বলা যেতে পারে,মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটা অসম যুদ্ধের শিকার। এই যুদ্ধ সমানে সমানে হচ্ছে না। কেননা, বিজেপির অর্থ বল, বাহু বল সবদিক থেকেই যা এখন দেখা যাচ্ছে, তা আগে কখনো দেখা যায়নি। বাজপেয়ী-আডবাণীর সময় থেকে আমি বিজেপি কভার করেছি। একবার আমি অটল বিহারী বাজপেয়ীর সঙ্গে কালকা মেইলে করে কলকাতা গিয়েছিলাম। কালকা মেইলে বসে একটা সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, আমাদের রাজনৈতিক দলের একটা লক্ষ্য, কবে আমরা ক্ষমতায় আসবো?
সেইসময় বামফ্রন্ট শাসন চলছে। জ্যোতি বসু তখন মুখ্যমন্ত্রী। সময় কতো বদলে গেছে! পরিস্থিতি বদলে গেছে! বাজপেয়ী-আডবাণীর পরে এসেছে মোদি এবং অমিত শাহের যুগ। মোদি এবং অমিত শাহের এই যুগে রাজনৈতিক রণকৌশলটাও বদলে গেছে। ভোট করার জন্য নরেন্দ্র মোদি যেভাবে সর্বশক্তি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গের আসরে নেমেছেন, তা এককথায় অভূতপূর্ব! নরেন্দ্র মোদিকেও প্রশংসা করতেই হবে যে, তিনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েও তিনি যেন একটা ইলেকশনের মেশিন এবং তিনি হলেন ইঞ্জিন। তার সঙ্গে তাঁর সহকারী অমিত শাহের তো কোনও তুলনাই হয় না, যেভাবে তিনি আক্রমণাত্মক রাজনীতিটা করেন!
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মনোবল ভেঙে দেওয়ার জন্য মনোস্তাত্ত্বিক লড়াইতেও বিজেপি অসম্ভব পটু। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে যেভাবে মতুয়া ভোট, হিন্দু- মুসলমান ভোট, গোর্খা ভোট, আদিবাসী ভোট নিয়ে যা হচ্ছে, এটা কিন্তু আগে কখনও হয়নি। এটা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক! আপনি বলবেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কী করেন নি? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এমন কিছু করেছেন, যাতে সিপিএম-কে নাকানি-চোবানি খেতে হয়েছিল। শ্যামল চক্রবর্তীর মতো সিপিএম নেতা বলেছেন, মমতা’দির মতুয়া রাজনীতিতে আমরা একেবারে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছি। এখন আমাদের মতুয়া প্রার্থী খুঁজতে ঘুরে বেড়াতে হচ্ছে। আমরা শ্রেণী রাজনীতি করেছি। মতুয়াদের যে আলাদা ভোটব্যাঙ্ক হতে পারে, তা ভাবিনি। মমতা সেটা করেছেন। এখন ওঁর থেকেও বেশি করে শুরু করেছে
বিজেপি।
আমাকে আমার এক প্রবীণ সম্পাদক বলেছিলেন, পুঁজিবাদের নিয়ম, বাজার অর্থনীতির নিয়ম কি জানো? আমার জানা ছিল না। তিনি বললেন, ‘ধরো, পাড়ায় একটা ছবির স্টুডিও হয়েছে। তার পাশেই যদি একটা স্টুডিও হয়, তাহলে কি করে চালাবে? যেটা করতে হবে, তা হল, পাশের পুরনো দোকানটার চেয়ে আমার দোকানটাকে আরো ভালো করতে হবে। সেখানে যাতে আরো ভালো ছবি তৈরি হয় সেই চেষ্টা করতে হবে, ছবির গুণগত মান বাড়াতে হবে এবং দাম কমাতে হবে। দরকার হলে ব্যবসায়ী বুদ্ধি দিয়ে পুরনো দোকানটাকে তুলে দেওয়ার ব্যবস্হা করতে হবে। একেই বলে গণতন্ত্রের ‘পুঁজিবাদী অর্থনীতি’। আমার মনে হচ্ছে, ভোটের ক্ষেত্রেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যা যা করেছেন, বিজেপি ঠিক সেইগুলোকেই আরো আক্রমণাত্মকভাবে করছে। সিপিএম যা যা
করেছিল, মমতা একটা সময় পাল্টা করেছিলেন, এখন মমতার পাল্টা করছেন মোদি। সন্দেহ নেই, মমতা কিন্তু এই কঠিন পরিস্থিতির সঙ্গে মোকাবিলা করছেন।
এরপরেও যদি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভালো ফল করতে পারেন তবে এটা হবে তাঁর বিরাট একটা জয়! যদি মোদিকে পরাস্ত করতে পারেন তবে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে, সর্বভারতীয় রাজনীতিতেও মমতা কয়েকধাপ এগিয়ে যাবেন। এছাড়া তিনি পশ্চিমবঙ্গে রাজনীতিকে তো সুসংহত করবেনই, দিল্লিতেও আগামী দিনে একজন নেতা হিসেবে উঠে আসবেন। যদি হেরে যান তাহলে মোদির পক্ষে সুবিধে হবে এবং ২০২৪টা অনেক সহজ হয়ে যাবে। তিনি পশ্চিমবঙ্গ জয়টাকে মূলধন করে হই হই করে আরও জয়যাত্রা চালাবেন। সমস্ত অর্থনৈতিক সমস্যা, করোনার সমস্যা, সবকিছুকে ভুলিয়ে দিয়ে এই জয়টাকে তিনি তুলে ধরতে চাইবেন।
সবশেষে একটা কথা বলব, এবারের ভোটে মমতার জন্য আরো বেশি কঠিন চ্যালেঞ্জ এইজন্য যে, বিজেপি কিন্তু ক্ষমতায় নেই। বিজেপির জন্য ভালো বিজেপি যদি জিততে পারে তাহলে খুব ভালো, যদি জিততে না পেরে, ভালো ফল করতে পারে তাহলেও খুব ভালো। কেননা, বিজেপি এই মুহূর্তে বিধানসভায় এমএলএ আছেন তিনজন। লোকসভায় ১৮টা হওয়াতে উচ্চাশা বেড়েছে। তিন থেকে যদি একশো হয় তাহলে সেটা
কিন্তু কিছু কম নয়। বিজেপির জন্য সেটাতো ভয়ঙ্কর সফলতা! মমতার জন্য কিন্তু চিন্তার বিষয় অনেকটাই এইজন্য যে, মমতা ক্ষমতায় আছেন। তিনি যদি ক্ষমতাচ্যুত হন তাহলে তাঁর দশ বছরের শাসনের অবসান হওয়া শুধু নয়, তৃণমূল কংগ্রেসের জন্য সেটা হবে এক মস্ত বড় ধাক্কা! এই কারণে পশ্চিমবঙ্গের এইবারের ভোটটাতে শুধু গোটা দেশ নয়, দুনিয়ার মানুষ তাকিয়ে রয়েছেন পশ্চিমবঙ্গে কী হয়, সেটা দেখার জন্য।
নির্বাহী সম্পাদক