কলকাতা :
মৃণাল সেনের কোনও কাজের সম্মান , স্মৃতিই আর বাংলায় থাকবে না। থাকবে সুদূর আমেরিকায়। মৃণাল সেনের পুত্র কুনাল সেন সেই কথাই জানিয়েছেন তাঁর সোশ্যাল মাধ্যমে। দীর্ঘদিন আমেরিকাতেই থাকেন তাঁর পুত্র। তিনিই ঠিক করেছেন, বিখ্যাত চিত্র পরিচালকের লেখা চিত্রনাট্য থেকে পুরস্কার সবই দান স্থান পাবে শিকাগোর লাইব্রেরিতে।
কুণাল তাঁর সোশ্যাল মাধ্যমে লিখেছেন, ‘শেষমেশ বাবার স্মৃতিগুলোকে আর্কাইভ করার জন্য শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের হাতে তুলে দিলাম৷ তবে মাত্র তিনটে বাক্স, তা দেখে কিছুটা হতবাক আমি৷ আসলে বাবা কখনই স্মৃতিকে আঁকড়ে ধরায় বিশ্বাসী ছিলেন না৷ বরং চিত্রনাট্য, ছবি অগোছালোই থাকত৷ তার মধ্যেই এই কিছু জিনিস পেলাম৷ যা অল্প হলেও স্মৃতি৷’। তাঁর কথায় , ‘শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের সংরক্ষণগার আমি দেখেছি। অত্যন্ত ভালো। সেখানে এগুলো সংরক্ষণ হলে তা সত্যিই ভালো।’ ১৯৫৫ সালে মৃণাল সেনের প্রথম পরিচালিত ছবি রাত-ভোর মুক্তি পায়। এই ছবিটি বেশি সাফল্য পায় নি। তার দ্বিতীয় ছবি নীল আকাশের নিচে তাকে স্থানীয় পরিচিতি এনে দেয়। তার তৃতীয় ছবি বাইশে শ্রাবণ থেকে তিনি আন্তর্জাতিক পরিচিতি পান।
১৯৬৯ সালে তার পরিচালিত ছবি ভুবন সোম মুক্তি পায়। এই ছবিতে বিখ্যাত অভিনেতা উৎপল দত্ত অভিনয় করেছিলেন। এই ছবিটি অনেকের মতে মৃণাল সেনের শ্রেষ্ঠ ছবি। তার কলকাতা ট্রিলোজি অর্থাৎ ইন্টারভিউ (১৯৭১), কলকাতা ৭১ (১৯৭২) এবং পদাতিক (১৯৭৩) ছবি তিনটির মাধ্যমে তিনি তৎকালীন কলকাতার অস্থির অবস্থাকে তুলে ধরেছিলেন। মধ্যবিত্ত সমাজের নীতিবোধকে মৃণাল সেন তুলে ধরেন তার খুবই প্রশংসিত দুটি ছবি এক দিন প্রতিদিন (১৯৭৯) এবং খারিজ (১৯৮২) এর মাধ্যমে। খারিজ ১৯৮৩ সালের কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার পেয়েছিল। ১৯৮০ সালের চলচ্চিত্র আকালের সন্ধানে। এই ছবিতে দেখানো হয়েছিল একটি চলচ্চিত্র কলাকুশলীদলের একটি গ্রামে গিয়ে ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের দুর্ভিক্ষের উপর একটি চলচ্চিত্র তৈরির কাহিনী। কিভাবে ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষের কাল্পনিক কাহিনী মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় সেই গ্রামের সাধারণ মানুষদের সাথে সেটাই ছিল এই চলচ্চিত্রের সারমর্ম। আকালের সন্ধানে ১৯৮১ সালের বার্লিন আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ জুরি পুরস্কার হিসাবে রুপোর ভালুক জয় করে। মৃণাল সেনের পরবর্তীকালের ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য মহাপৃথিবী (১৯৯২) এবং অন্তরীন (১৯৯৪)। এখনও অবধি তার শেষ ছবি আমার ভুবন মুক্তি পায় ২০০২ সালে।
মৃণাল সেন বাংলা ভাষা ছাড়াও হিন্দি, ওড়িয়া ও তেলেগু ভাষায় চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। ১৯৬৬ সালে ওড়িয়া ভাষায় নির্মাণ করেন মাটির মনীষ, যা কালীন্দিচরণ পাণিগ্রাহীর গল্প অবলম্বনে নির্মিত হয়। ১৯৬৯ এ বনফুলের কাহিনী অবলম্বনে হিন্দি ভাষায় নির্মাণ করে ভুবন সোম। ১৯৭৭ সালে প্রেম চন্দের গল্প অবলম্বনে তেলেগু ভাষায় নির্মাণ করেন ওকা উরি কথা। ১৯৮৫ সালে নির্মাণ করেন জেনেসিস, যা হিন্দি, ফরাসি ও ইংরেজি তিনটি ভাষায় তৈরি হয়। মৃণাল সেন পরিচালিত চলচ্চিত্রগুলি প্রায় সবকটি বড় চলচ্চিত্র উৎসব থেকে পুরস্কার জয় করেছে। ভারত এবং ভারতের বাইরের অনেক বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সাম্মানিক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করেছে। তিনি ইন্টারন্যাশন্যাল ফেডারেশন অফ দি ফিল্ম সোসাইটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৮১ সালে তিনি ভারত সরকার দ্বারা পদ্মভূষণ পুরস্কার লাভ করেন। ২০০৫ সালে তিনি দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার পান। তিনি ১৯৯৮ থেকে ২০০৩ অবধি ভারতীয় সংসদের সাম্মানিক সদস্যপদ লাভ করেন। ফরাসি সরকার তাকে কম্যান্ডার অফ দি অর্ডার অফ আর্টস অ্যান্ড লেটারস সম্মানে সম্মানিত করেন। এই সম্মান ফ্রান্সের সর্বোচ্চ নাগরিক সম্মান। ২০০০ সালে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তাকে অর্ডার অফ ফ্রেন্ডশিপ সম্মানে ভূষিত করেন। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর নিজ বাসভবনে ৯৫ বছর বয়সে মৃত্যু হয় তাঁর।

নির্বাহী সম্পাদক