শিবপ্রিয় দাশগুপ্ত :
২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের কথা মাথায় রেখে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে পূর্ণ শক্তি নিয়ে নেমে পড়েছে। মোদী-শাহ মিথ দেশে ধরে রাখতে পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতায় আসা জরুরি। তাই রেজিমেন্টেড পার্টি বিজেপি দেশের মধ্যে বলতে গেলে বিজেপিকেই প্রথম ও সবচেয়ে বেশি রেজিমেন্টেড পার্টি বলা হয়। রেজিমেন্টেড দলের উদাহরণ দিতে গেলে সবার আগে বিজেপির নাম এসে যায় । এই রেজিমেন্টেশনের সঙ্গে হলে বিজেপির সঙ্গে জুড়েছে পেশাদারিত্ব। এই দুইয়ের মিশেলের ফলে বিজেপি এখন দেশের অন্যতম প্রধান পরিপাটি রাজনৈতিক দল। বিজেপি বাংলার বিধানসভার নির্বাচনে যে ভাবে মনোনিবেশ করেছে তাতে বোঝা যাচ্ছে আগামী চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনের হোম ওয়ার্ক আগাম সেরে নিতে চাইছে বিজেপি। বিজেপি-র টার্গেট আগামী লোকসভা নির্বাচনের আগে রামমন্দিরের দরজা সবার জন্য খুলে দেওয়া। আর সেটা করার আগে বিজেপি চাইছে বাংলাকে নিজেদের দখলে নিতে। তাই প্রধানমন্ত্রী , স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অর্থাৎ দেশের মন্ত্রিসভার কোর টিমটি নেমে পড়েছে বাংলা জয়ে।
আগামী লোকসভা নির্বাচনে পুরোপুরি হিন্দুত্ব তাস খেলতে চাইছে বিজেপি। তাই তার আগে বাংলা জয়ের একটা বড় রকমের সাফল্য হাতে রেখে নিতে চাইছে বিজেপি। সেই লক্ষ্যেই গেরুয়া শিবিরের নজরে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন। গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকেই বাংলা দখলের লক্ষ্যে বিজেপি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এক কথায় ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। বাংলা জয়ের এই স্বপ্ন এখন নিজেদের হাতে চলে এসেছে বলে দাবি করছেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহরা।
পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি-র জয়ের আশা সফল হবে কি না সেটা সময় বলবে। তবে পশ্চিমবঙ্গের পাশাপাশি আরও চারটি রাজ্যে নির্বাচন সদ্য শেষ হয়েছে। এর মধ্যে কেরল এবং তামিলনাড়ুতে বিজেপির জয়ের আশা এক রকম নেই বললেই চলে । পুদুচেরিতে মাত্র তিরিশটি আসন, তবে সেখানে বিজেপির জেতার সম্ভাবনা আছে অনেকটাই।
তবে পুদুচেরিতে কে জিতল বা কে হারল, সেটা নিয়ে রাজনৈতিক মহলের কিছু এসে যায়না। এর পর বাকি থাকল অসম। সেখানে এবার হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেসের। অসম গেরুয়া শিবিরের হাতে থাকবে কি না কিনা, সেটা নিয়ে বড় প্রশ্ন চিহ্ন দেখা দিয়েছে বিজেপি-র অন্দরেই । তাই বিজেপির নজর শুধুই পশ্চিমবঙ্গ।
তাই সর্বশক্তি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গে প্রচার করছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ, বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডার পাশাপাশি অন্যান্য বিজেপি শীর্ষ নেতৃত্ব। রাজ্যে লাগাতার প্রচারে আসছেন বিজেপি শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী বা অন্যান্য পদাধিকারীরা। মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড়, কর্ণাটক, মহারাষ্ট্র, ঝাড়খন্ড, পাঞ্জাব, দিল্লি, ওড়িশা প্রভৃতি রাজ্যের নির্বাচনে বিজেপি সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। পরবর্তীকালে অন্য দল থেকে বিধায়ক ভাঙিয়ে এনে তারা বেশ কয়েকটি রাজ্যে সরকার গড়েছে। এই রাজ্যেও সেই সম্ভাবনা যে আছে সেই ইঙ্গিত দিচ্ছেন খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, “আমি ২০০-র বেশি আসন না পেলে সরকার করতে পারবো না। গদ্দাররা টাকার জন্য চলে যাবে, আগে যেমন গেছে।”
সবচেয়ে বড় কথা বিজেপির ভরকেন্দ্র বলে পরিচিত গুজরাটে গত বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের সঙ্গে তাদের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়। ম্যাজিক সংখ্যার চেয়ে মাত্র সাতটি আসন বেশি পেয়েছিল বিজেপি। দিল্লির বিধানসভা নির্বাচনে মোদী-শাহ জুটি ব্যাপক প্রচার করলেও ভরাডুবি হয়েছে পদ্ম শিবিরের। নির্বাচন পরবর্তী আসন পাওয়ার যে হিসেবে অমিত শাহ দিয়েছিলেন সেটাও মেলেনি। সম্প্রতি পাঞ্জাব, হিমাচল প্রদেশের পুরভোটে খারাপ ফল হয়েছে বিজেপির। রবিবার ত্রিপুরার স্থানীয় নির্বাচনের ফল প্রকাশ হয়েছে। সেখানেও মুখ থুবড়ে পড়েছে গেরুয়া শিবির।
তাই চব্বিশের লোকসভার আগে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচন বিজেপির কাছে সবচেয়ে বড় প্রেস্টিজ ফাইট। এখানে জিততে পারলে দিল্লি রাজনীতিতে অনেকটাই সুবিধাজনক জায়গায় চলে যাবে বিজেপি। সাম্প্রতিক অতীতে বিভিন্ন রাজ্যের ব্যর্থতার কথা দূরে ঠেলে দিয়ে বাংলার সাফল্যের কথা দেশ জুড়ে তখন প্রচার করবেন মোদী-শাহরা।
গত কয়েক বছরে সরাসরি নির্বাচনের মাধ্যমে বিজেপি বড় জয় পেয়েছে উত্তরপ্রদেশ, অসম, হিমাচল প্রদেশ উত্তরাখণ্ডের পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে। এছাড়া গত নভেম্বরে বিহারে বিজেপি তাদের জোট শরিক জেডিইউকে নিয়ে সরকার গঠন করেছে কোনও রকমে। বলা যায় কানঘেঁষে জয় পেয়েছে তারা। অর্থাৎ এটা পরিষ্কার উত্তরপ্রদেশে অভাবনীয় সাফল্য পেলেও বিজেপি নিশ্চিন্তে নেই।
এরইমধ্যে কৃষক বিদ্রোহের একটা বড় প্রভাব দেখা গিয়েছে উত্তরপ্রদেশেও। তবে বিজেপি যদি পশ্চিমবঙ্গে হেরে যায়, তখন জাতীয় রাজনীতিতে বিরোধীরা একজোট হয়ে যাবে। মোদী-শাহকে হারানো সম্ভব, এটা সকলে বিশ্বাস করতে শুরু করবেন। মোদী মিথ ভেঙে যাবে। তার একটা বড় প্রভাব অবশ্যই পড়বে ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে। ঠিক সেই কারণেই বাংলার নির্বাচনে নজরকাড়া প্রচার করছেন নরেন্দ্র মোদী এবং অমিত শাহ।
নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছেন তাঁরা। গত লোকসভা নির্বাচনে বড় সাফল্যের পর কেন্দ্রীয় বিজেপি নেতৃত্ব পাখির চোখ করেছেন বাংলাকে। রাজ্য জুড়ে গেরুয়া ঝড় বইছে বলে বিজেপির দাবি। অর্থাৎ চব্বিশের লোকসভার আগে দিল্লি রাজনীতিতে বাংলার বিধানসভা নির্বাচন যে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে, সেটা নিয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তবে সব সম্ভাবনাই স্পষ্ট হয়ে যাবে ২ মে, ভোটের ফলের দিন।
নির্বাহী সম্পাদক