আলাপচারিতায় বীর মুক্তিযোদ্ধা ভবতোষ রায় বর্মণ
‘আমি যুদ্ধ দেখেছি। যুদ্ধের বীভৎসতা দেখেছি। আর কোনো জাতি যেন যুদ্ধে না জড়ায়।’ বললেন ভবতোষ রায় বর্মন। একাত্তরের বীর মুক্তিযোদ্ধা। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে প্লাটুন কমান্ডারের দায়িত্বে ছিলেন। সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের কমান্ডারের দায়িত্বেও ছিলেন তিনি।
একটি সশস্ত্র যুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ এবং যুদ্ধের বীভৎসতা দেখে ভবতোষের উপলব্দি এই ‘আর কোনো জাতি যেন যুদ্ধে না জড়ায়। যুদ্ধের চেয়ে খারাপ কিছু হয় না।’
গত বুধবার রাতে নগরের তোপখানা এলাকায় ভবতোষ রায় বর্মনের বাসায় কথা হয় তার সঙ্গে। একাত্তরের সেই তরুণ এখন বার্ধক্যে পৌঁছেছেন। তবু তারুণ্য টগবগ করে তার কথায়।
পঞ্চাশ বছর আগের সেই মার্চের স্মৃতিচারণ দিয়ে শুরু হয় আলাপ। মুক্তিযুদ্ধ আর বর্তমান বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলেন তিনি। দীর্ঘ আলাপচারিতায় কখনও শহীদ সহযোদ্ধার কথা মনে পড়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন, আবার কখনও ক্ষোভে তার চোখজোড়া জ্বলজ্বল করে ওঠে। দুই হাজার একুশের প্রবীণ ভবতোষ নন, একাত্তরের তরুণ ভবতোষ ফিরে আসেন তার কথায়।
একাত্তরে তরুণ ভবতোষ রায় বর্মন কাজ করতেন সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগে। পাকিস্তান সরকারের চাকরি করেও মার্চের আগে থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে বিভিন্ন আন্দোলনে যুক্ত হন।
ভবতোষ বর্মনের মা বিখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী চন্দ্রাবতী রায় বর্মন। বাবা সরকারি চাকরিজীবী। তিনিও শিল্পী। ফলে ঘরেই পেয়েছেন একটি শিল্পিত, স্বাধীনচেতা ও অসাম্প্রদায়িক পরিবেশ।
সিলেট নগরের আম্বরখানা এলাকায় সরকারি কোয়ার্টারে মা-ভাই-বোন নিয়ে থাকতেন ভবতোষ রায় বর্মন। বাবা চাকরির সুবাধে থাকতেন মৌলভীবাজারে।
মার্চ থেকেই যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করে। ২৫ মার্চ ভবতোষ রায় বর্মন দেখতে পান হাজার হাজার মানুষ গ্রাম থেকে শহরে চলে এসেছে। তাদের সবার হাতে লাঠি। সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিতে স্লোগান দিয়ে মিছিল করছে। ভবতোষও অংশ নেন এই মিছিলে। এরপর সন্ধ্যা হতেই বদলে যায় পরিস্থিতি। বিভিন্ন জায়গা থেকে খবর আসে শহরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নেমেছে। দিনের জনারণ্য শহর সন্ধ্যা হতেই পুরো ফাঁকা হয়ে যায়।
ভবতোষ তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে যান নগরের ইলেকট্রিক সাপ্লাই এলাকায়। সেখানে সড়কে ব্যারিকেড তৈরি করেন। তবে সেনাবাহিনীর গাড়ির শব্দ শুনেই সবাই দৌড়ে চলে যান যার যার বাসায়। এরপর কিছুদিন ঘরেই বন্দি ছিলেন। কারফিউ জারি হয়েছে। শহরে থমথমে অবস্থা। থেমে থেমে গুলির শব্দ। শহরের বেশিরভাগ মানুষই ঘরবন্দি। কেউ জানালা খোলারও সাহস করেন না। ভয়ে শিশুরাও কান্না ভুলে যায়।
এতদিন একপক্ষের গুলির শব্দ শুনলেও ৬ এপ্রিল প্রথমবারের মতো পাল্টাপাল্টি গুলির শব্দ শোনেন ভবতোষ। নগরের মিরের ময়দান এলাকায় পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো প্রতিরোধ গড়ে তোলেন বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তবে এই প্রতিরোধ বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি।
৬ এপ্রিল মাইকিং করে সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে যাওয়ার জন্য বলা হয়। ঘরে মা, যুবতী দুই বোন আর ছোট দুই ভাই। তাদের নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন ভবতোষ। ওই দিনই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে নগরের শাহজালাল দরগাহ এলাকার শহিদুল চৌধুরী নামের এক বন্ধুর বাসায় আশ্রয় নেন। এরপর ৮ এপ্রিল নৌপথে মৌলভীবাজারের শেরপুর, হবিগঞ্জের মার্কুলি হয়ে আশ্রয় নেন সুনামগঞ্জের দিরাইয়ে। ৯ এপ্রিল সিলেট শহরে তাণ্ডবলীলা চালায় পাকিস্তানি বাহিনী। অসংখ্য মানুষকে হত্যা করে। ওই দিনই সিলেট হাসপাতালে (বর্তমানে শহীদ ডা. শামসুদ্দিন হাসপাতাল) কর্মরত অবস্থায় অধ্যাপক ডা. শামসুদ্দিনকে হত্যা করে হানাদারেরা।
এরপর সুনামগঞ্জ থেকে ২৬ এপ্রিল ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বালাটে মামার বাড়িতে সপরিবারে আশ্রয় নেন ভবতোষ।
সেখানে থেকেই যোগাযোগ হয় মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে। বালাটের মাইলম সীমান্তে ক্যাম্প গড়েছিলেন মুক্তিযোদ্ধারা। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে তাদের সঙ্গে যুক্ত হন ভবতোষ।
এরপর বালাট থেকে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় শিলংয়ে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাম্পে। সেখান থেকে মেঘালয়ের চেরাপুঞ্জির কাছাকাছি জারিয়ান প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে। টানা ৩৫ দিন সেখানে একসঙ্গে ১২ শ মুক্তিযোদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়।
স্মৃতি আওড়ে ভবতোষ বলেন, এই ক্যাম্পে শুরুর দিকে বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আব্দুল হামিদও ছিলেন। পরে তিনি অন্যত্র চলে যান।
প্রশিক্ষণ শিবিরের ভয়ঙ্কর দিনগুলোর বর্ণনা দিয়ে ভবতোষ বলেন, ‘চেরাপুঞ্জি সবচেয়ে বৃষ্টিপ্রবণ এলাকা। প্রশিক্ষণকালীন ৩৫ দিনের ৩২ দিনই ছিল তুমুল বৃষ্টি। আমরা বৃষ্টিতে ভিজেই প্রশিক্ষণ নিতাম। আবার ভেজা কাপড়েই ঘুমাতে যেতাম। পাহাড়ের উপরের ওই প্রশিক্ষণ শিবিরে ছিল জোঁকের উপদ্রব। এ যেন জোঁকের রাজ্য।’
তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রশিক্ষণ শুরুর আগে জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো। তখন পুরো জাতীয় সংগীত কেউ পারত না। তবে দুয়েক লাইন গাওয়াও সম্ভব হতো না। ‘আমার সোনার বাংলা’ বলার পরই প্রশিক্ষণার্থী সবাই হাউমাউ করে কেঁদে উঠত। একেবারে শিশুর মতো কান্না।
সেই সব দিনের স্মৃতিচারণ করে ভবতোষ বলেন, ‘অনেকে বলে আমাদের মধ্যে দেশপ্রেম নেই। এটা ভুল কথা। আমি একাত্তরে দেশপ্রেম দেখেছি। দেশের প্রতি গভীর প্রেম না থাকলে জাতীয় সংগীত শুনে কেউ এভাবে কাঁদত না। প্রেম না থাকলে মাত্র ১ লাখ ২০ হাজার প্রশিক্ষণহীন, অর্ধ-প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা একটি প্রশিক্ষিত বাহিনীকে হারিয়ে দিতে পারত না।’
ট্রেনিং শেষে ৫ নং সেক্টরের ৪ নং সাবসেক্টরের অধীনে যুদ্ধ শুরু করেন ভবতোষ। ৫০ জনের একটি প্লাটুনের কমান্ডার নির্বাচিত করা হয় তাকে।
ভবতোষ বলেন, ছাত্র অবস্থায় স্কাউট করতাম। ফলে কিছুটা নেতৃত্ব গুণ তৈরি হয়েছিল। এছাড়া কিছু কিছু ইংরেজি ও হিন্দি জানতাম। এসব কারণে আমাকে প্লান্টুন কমান্ডার মনোনীত করা হয়।
নিজের প্লাটুন নিয়ে তামাবিল সীমান্তে যুদ্ধে অংশ নেন ভবতোষ। প্রথমদিকে সীমান্ত পার হয়ে কিছু গুলি ছুড়ে আবার ভারতীয় সীমান্তে চলে যেতেন।
যুদ্ধের উল্লেখযোগ্য স্মৃতি উল্লেখ করে ভবতোষ বর্মন বলেন, ‘জুন মাসের দিকে গোয়াইনঘাট উপজেলার বারহাল সেতু উড়িয়ে দেই আমরা। এতে পাঁচ জন রাজাকার নিহত হয়। তবে ওই সেতুর আশপাশেই ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর অবস্থান। সেতু উড়িয়ে দেয়ার পর তারা আমাদের ঘিরে ফেলে। তুমুল যুদ্ধ হয়। নিরঞ্জন ও নিখিলেশ নামে আমাদের দুই সহযোদ্ধা গুলিবিদ্ধ হয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের শিলং নিয়ে যাওয়া হয়। ওই যুদ্ধে আমরা কোনও রকমে প্রাণ নিয়ে বেঁচে যাই।’
ভবতোষ বলেন, ‘জাফলংয়ের রাধানগর চা বাগানে ছিল পাকবাহিনীর ঘাঁটি। আমরা ১৫ বার চেষ্টা করে এই বাগান মুক্ত করতে ব্যর্থ হই। অবশেষে ১৬তম চেষ্টায় সফল হই। এই অপারেশনে ১২ শ মুক্তিযোদ্ধা অংশ নেয়। গোয়াইনঘাট এলাকার কুখ্যাত রাজাকার আজির উদ্দিন চেয়ারম্যানকেও আটক করি আমরা।’
ভবতোষ বলেন, ‘নভেম্বরের প্রথম দিকে এক সম্মুখযুদ্ধে আমার সহযোদ্ধা আব্দুল মান্নার শহীদ হন। আমরা যতটা ব্রিজ বোমা মেরে উড়িয়ে দিয়েছি তার প্রতিটি বোমা তৈরির কাজ করেছেন মান্নান। আমার খুব ঘনিষ্ট ছিল। তার মৃত্যু আমার জন্য ছিল খুব বেদনাদায়ক।’
যুদ্ধ করে বিভিন্ন এলাকা শত্রুমুক্ত করতে করতে গোয়াইনঘাট হয়ে ১৬ ডিসেম্বর সিলেটের বিমানবন্দর এলাকায় এগিয়ে আসে ভবতোষ রায় বর্মনের দল। বিমানবন্দরের পাশেই (বর্তমানে সিলেট ক্যাডেট কলেজ) পাকিস্তানি বাহিনীর প্রধান ঘাঁটি। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের খবর পান ভবতোষ বর্মনরা। সবাই আনন্দে লাফিয়ে ওঠেন। বিজয় উদযাপন শুরু করেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে নিজের স্টেনগানের গুলিতেই এদিন প্রাণ হারান ভবতোষের সহযোদ্ধা হাবিবুর রহমান।
সহযোদ্ধাকে হারানোর শোকে যখন সবাই মুহ্যমান, তখন ১৬ ডিসেম্বর সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প থেকে গুলি শুরু হয়।
ভবতোষ বলেন, ‘পুরো যুদ্ধকালে এরকম গুলি কখনও দেখিনি। বৃষ্টির মতো হাজার হাজার গুলি ছুড়তে থাকে পাকবাহিনী। তারা চেয়েছিল আমাদের নিশ্চিহ্ন করে ভারতীয়দের কাছে আত্মসমর্পণ করতে।
‘তবে সেদিন আমরা কোনো রকমে বেঁচে যাই। পরদিন সকালে অস্ত্রসমর্পণে সম্মত হয় পাকবাহিনী। ফলে ঢাকায় ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করলেও সিলেট শত্রুমুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর। আমরা শহরে প্রবেশ করি।’
ভবতোষ বলেন, ‘সিলেটে এসে দেখি আমরা যে সরকারি বাসায় থাকতাম তা অন্য একজনকে বরাদ্দ দেয়া হয়ে গেছে। আমি তখন সেলিম নামে আমার এক বন্ধুর বাসায় উঠি। সাত মাস ২২ দিন পর সেখানে প্রথম সাবান দিয়ে গোসল করি। বালিশে মাথা রেখে ঘুমাই। এরপর ২৮ মার্চ বাবা-মাসহ পরিবারের সদস্যদের আনতে আবার বালাটে যাই।’
তারা সবাই ভেবেছিলেন আমি হয়তো মারা গেছি, এমনটি উল্লেখ করে ভবতোষ বলেন, আমার জন্য তারা অনেক পূজাঅর্চনা করেছেন। আমাকে ফিরে পেয়ে তারা কান্নায় ভেঙে পড়েন।
দেশ স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীনতার স্বপ্ন কি পুরণ হয়েছে। প্রশ্ন করি এই বীর মুক্তিযোদ্ধাকে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া আমাদের দায়িত্ব ছিল। আমরা সেই দায়িত্ব পালন করেছি। দেশকে সঠিকভাবে পালনের দায়িত্ব ছিল পরবর্তী সরকারগুলোর। তারা ব্যর্থ হয়েছে।
তিনি বলেন, স্বাধীনতার পরই আন্তর্জাতিক শক্তি ষড়যন্ত্র শুরু করে। কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি করা হয়। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়। এ সবই আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। এসব ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেয় আমাদের অনেকে। ফলে বাংলাদেশ ভুল পথে পা বাড়ায়।
আমরা যেদিন আলাপ করছিলাম, তার মাত্র ৭দিন আগে, ১৭ মার্চ সুনামগঞ্জের শাল্লায় হিন্দুদের শতাধিক বাড়িঘরে হামলা ও ভাংচুর করা হয়েছে। হেফাজতে ইসলামের নেতা মামুনুল হকের সমালোচনা করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার জেরে এই হামলা ঘটে।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা পাকিস্তান ভেঙে ভবতোষ বর্মনরা যুদ্ধ করে বাংলাদেশ নির্মাণ করেছেন। যার মূলনীতিতে ছিলো অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এমন দেশে ৫০ বছর পরও এরকম সাম্প্রদায়িক হামলা কেনো, প্রশ্ন করি ভবতোষ রায় বর্মনকে।
তার জবাব, এই বিষ আজকের নয়। ব্রিটিশরা আমাদের মধ্যে এই সাম্প্রদায়িক বিষ ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে। আমরা তা থেকে মুক্ত হতে পারিনি।
এতে নিজেদেরও দায় দেখছেন সিলেট মহানগর মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক এই কমান্ডার। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের পর সাম্প্রদায়িক শক্তি দমে যায়নি। তারা গ্রামে গ্রামে, ঘরে ঘরে গিয়ে নিজেদের আদর্শ প্রচার করেছে। নিজেদের দলে লোক ভিড়িয়েছে। আমরা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোকজন মেতে উঠেছি লুটপাট, দুর্নীতি আর হীন রাজনীতিতে। একারণেই আজ দেশের এ অবস্থা।
নির্বাহী সম্পাদক