Home » মু‌ক্তিযু‌দ্ধে অসীম বীরত্ব দেখা‌নো ‌বিচ্ছু বা‌হিনীর কথা ম‌নে রা‌খে‌নি কেউ

মু‌ক্তিযু‌দ্ধে অসীম বীরত্ব দেখা‌নো ‌বিচ্ছু বা‌হিনীর কথা ম‌নে রা‌খে‌নি কেউ

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাবার সঙ্গে ভারতে প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার পাশাপাশি তাদের গোপন তথ্য সংগ্রহ করে তা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতেন তৎকালীন বিচ্ছু বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার আব্দুর রাজ্জাক ভূঁইয়া। তবে স্বাধীনতার ৫০ বছর অতিবাহিত হতে চললেও আজও বিচ্ছু বাহিনীকে নিয়ে পৃথক গেজেট প্রকাশ করা হয়নি বলে আক্ষেপ করেন তিনি। স্মৃতিচারণে রাজ্জাক ভূঁইয়া জানান, দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিচ্ছু বাহিনীর সহায়তা চেয়েছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজ্জাক ভূঁইয়া বাবা মায়ের সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করতেন। তেজগাঁও পলিটেকনিক স্কুলের নবম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন। বর্তমানে রাজ্জাক ভূঁইয়া বরিশাল নগরীর পলাশপুর এলাকার বাসিন্দা।
তার বাবা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক ভূঁইয়া। বরিশাল নগরীর বিআইপি কলোনির মধ্যে পাক বাহিনীর আতর্কিত হামলায় নিহত হন। তবে তার মরদেহ পাওয়া যায়নি। ওই সময় এক থেকে দেড়শ জন নিহত হয়। তাদের বেশিরভাগেরই মরদেহ খাল থেকে কীর্তনখোলা নদীতে ভেসে যায় বলে জানা গেছে।
বিচ্ছু বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার রাজ্জাক ভূঁইয়া জানান, যুদ্ধ শুরুর সময় তার বয়স ছিল ১৫ বছর ৬ মাস। ওই সময় তার পরিবারের সঙ্গে তিনি ঢাকায় থাকতেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য তার পিতা তাকে সঙ্গে নিয়ে ভারতে যান। সেখানে তারা বাবা ছেলে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। এর মধ্যে বিচ্ছু বাহিনীর সদস্য ছিল ২০ হাজারের মত। তাদেরকে ভারত থেকে গ্রেনেড হামলা, স্টেনগান ও রিভলভার পরিচালনার ২১ দিনের প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ঢাকায় আসার পর তাকে (রাজ্জাক) বিচ্ছু বাহিনীর গ্রুপ কমান্ডার করে ৮/১০ জনের সদস্য সঙ্গে দেওয়া হয়। এ সময় তাদের গ্রেনেড সরবরাহ করা হয়। তারা গ্রেনেড শান্তিনগর বাজারের একটি মুদি দোকানে রাখতেন। সময় সুযোগ বুঝে পাক বাহিনীর ওপর হামলা চালাতেন।

হামলার চেয়েও তাদের বড় দায়িত্ব ছিল পাকবাহিনীর তথ্য আদান-প্রদান করা। এ জন্য তারা বাদাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন জিনিস ঘুরে ঘুরে বিক্রির ছলে তথ্য সংগ্রহ করে তা মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পে পৌঁছে দিতেন।

যুদ্ধ চলাকালীন সময় রমজানের মধ্যে পাক বাহিনী কার্ফু শিথিল করে। এরপর বিভিন্ন স্থান থেকে পাকবাহিনীর সদস্যদের একত্রিত করে ২টি লরিতে তোলা হয়। ওই লরি দুটি শান্তিনগর বাজার অতিক্রম করবে—এমন খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রাজ্জাক তার সদস্যদের নিয়ে ওই এলাকায় ওৎ পেতে থাকেন। শান্তিনগর বাজার এলাকায় লরি দুটি আসার সঙ্গে সঙ্গে দুই দিক থেকে গ্রেনেড হামলা চালান তারা। এতে লরিতে থাকা বেশিরভাগ পাকিস্তানি সেনা নিহত ও আহত হয়।

রাজ্জাক ভূঁইয়া আরও বলেন, ১০ জানুয়ারি দেশে আসেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই সময় সংসদ ভবনের ওই স্থানের একটি স্কুল ঘরে বিপুল সংখ্যক বাঙালিকে আটকে রাখে পাকিস্তানি সেনারা। এ খবর বঙ্গবন্ধু জানতে পেরে বিচ্ছু বাহিনীর সহায়তা চান। ওই সময় আমি বরিশালে অবস্থান করছি। আমাকেও খবর দেওয়া হয়। এরপর বিচ্ছু বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে বরিশাল থেকে বিউটি অব খুলনা নামক লঞ্চযোগে ঢাকায় যাই। সেখানে যাওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জিমনেশিয়ামে রাখা হয় আমাদের। রাতে আমাদের জন্য খাবার পাঠান বঙ্গবন্ধু। ওই স্থানে ভারতীয় সৈন্যরা আমাদের আবারও প্রশিক্ষণ দেন। কীভাবে আটককৃত বাঙালিদের উদ্ধার করতে হবে।

তিনি বলেন, ভোর হাওয়ার আগেই আক্রমণ শুরু হয়। সেখানে পাকবাহিনীর এলোপাথাড়ি গুলি ছোঁড়ে। তাতে তাদের শেষ রক্ষা হয়নি। সেখান থেকে মুক্ত করা হয় অসংখ্য বাঙালিকে। কিন্তু সর্বশেষ আক্রমণে আমি আহত হই। আমার বাম পায়ের হাঁটুতে একটি গুলি লাগে। সুস্থ হতে একমাস লেগে যায়।

যুদ্ধকালীন সময়ের স্মৃতিচারণ করে রাজ্জাক ভূঁইয়া বলেন, ওই সময় বিচ্ছু বাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করতে স্বাধীন বাংলা বেতার বড় ভূমিকা পালন করে। শুধুমাত্র বিচ্ছু বাহিনীর ওপর আধা ঘণ্টার অনুষ্ঠান প্রচার করা হতো। সেখানে বিচ্ছু বাহিনীকে বিভিন্ন ধরনের তথ্য দেওয়া হতো। এ জন্য কোড হিসেবে ব্যবহার করা হতো বিভিন্ন ধরনের গান। গানের মাধ্যমে আমরা বুঝে নিতাম কোথায় অপারেশন চালাতে হবে। তাদের নেতৃত্ব দিতেন ক্যাপ্টেন বেগ।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর বিভিন্ন রাজনৈতিক দল দেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। তখন আমাদের পক্ষ থেকে বিচ্ছু বাহিনীকে নিয়ে পৃথক গেজেট প্রকাশের দাবি জানিয়ে আসছি। প্রতিটি সরকার প্রধান এ দাবি মেনে নেয়ার আশ্বাস দিলেও আজো তা পূরণ হয়নি। আমরা চাই বিচ্ছু বাহিনীকে নিয়ে পৃথক গেজেট প্রকাশ করা। একই সঙ্গে আমাদের সনদে বিচ্ছু বাহিনী কথাটি লেখার দাবি রয়েছে।

শহীদ মুক্তিযোদ্ধা বাবা সিরাজুল হক ভূঁইয়ার সঙ্গে রাজ্জাক ভূঁইয়ার শেষ দেখা হয় ৭ ডিসেম্বর। যুদ্ধকালীন সময় তার বাবা দপদপিয়া বেইজ কমান্ডার আব্দুল মান্নানের নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশ নেন। ৭ ডিসেম্বর নগরীর বিআইপি কলোনি পাকবাহিনীর ক্যাম্পে রাজাকারদের রেখে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। খবরটি জানার পর সেখানে আক্রমণ চালান মুক্তিযোদ্ধারা। ওই সময় পাকবাহিনীর গুলিতে তার বাবাসহ প্রায় দেড় শতাধিক লোক শহীদ হন। তাদের মরদেহ পাকবাহিনীর ক্যাম্প সংলগ্ন খালে ফেলা দেওয়া হয়। ওই মরদেহ ভাসতে ভাসতে কীর্তনখোলা নদীতে নেমে যায়। রাজ্জাক ভূঁইয়ার বাবার মরদেহ আর পাওয়া যায়নি।

বিচ্ছু বাহিনীকে নিয়ে পৃথক গেজেট প্রকাশে একমত পোষণ করেন বরিশাল জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডের সাবেক ডেপুটি কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মহিউদ্দিন মানিক (বীর প্রতীক)। এ দাবি বহুদিনের তবে এটা করা আসল কষ্টকর। তারপরও সরকার ইচ্ছা করলে বিচ্ছু বাহিনীর দাবিটা পূরণ করতে পারেন। একই সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্রে বিচ্ছু বাহিনী কথাটা উল্লেখ থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন এ বীর মুক্তিযোদ্ধা।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *