জন্মদাতা মায়ের একটানা আর্তনাদ-পুলিশে আমার ফুয়ারে নিয়া মারিলাইছে। বিনা দোষে আমার ফুয়ারে যতো মাইর মারছে। আমার ফুয়ায় কোনো অপরাধ করছে না। একমাত্র ঘুষর টেখার লাগি আমার ফুয়ারে পুলিশে মারিলাইলো, আমার বুক খালি করিলাইলো। এখন তার ২ মাসর বাচ্চায় কিতা করবো। তার বউয়ে কিতা করবো। আমি কিতা করতাম….’
এসব কথা বলছেন আর টানা আহাজারি করছেন সালমা বেগম। তিনি সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারি পাড়ার রায়হান আহমদ (৩৪)-এর মা। ছেলের লাশ সামনে নিয়ে বার বার জ্ঞান হারাচ্ছেন তিনি। চার সন্তানের মধ্যে বড় ছেলেকে অকালে হারিয়ে সালমা বেগম হয়ে পড়েছেন শোকে দিশেহারা। প্রতিবেশি কিংবা স্বজন- কারোরই সান্তনা থামাতে পারছে না সালমা বেগমের আর্তচিৎকার।
কান্নাভেজা কণ্ঠে সালমা বেগম বার বার তার ছেলেকে ‘হত্যাকারী’ পুলিশ সদস্যদের মৃত্যুদণ্ড দাবি করেন।
এর আগে- সিলেট নগরীর বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে নির্যাতন করে রায়হান আহমদকে মেরে ফেলার অভিযোগ ওঠে। নিহত রায়হান আহমদের পরিবারের পক্ষ থেকে আটকের পর ‘ঘুসের টাকা’ না পেয়ে পুলিশি নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ করা হয়।
এদিকে, রোববার (১১ অক্টোবর) সকালে ছিনতাইকালে গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে বলে পুলিশ দাবি করলেও নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার পর ঘটনাটি তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা।
নিহত রায়হান আহমদ (৩৪) সিলেট নগরীর আখালিয়া এলাকার নেহারিপাড়ার গুলতেরা মঞ্জিলের মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে। তিনি এক সন্তানের জনক। নগরীর স্টেডিয়াম মার্কেটস্থ ডা. আবদুল গফ্ফারের চেম্বারে সহকারী হিসেবে চাকরি করতেন।
রায়হান আহমদের মা সালমা বেগম ও চাচা হাবিবুল্লাহ অভিযোগ করে বলেন, কর্মস্থল চিকিৎসকের চেম্বার থেকে ফিরতে দেরি দেখে শনিবার রাত ১০টায় রায়হানের মোবাইলে ফোন দেন মা ও স্ত্রী। কিন্তু ফোন বন্ধ পান। ভোর ৪টা ২৩ মিনিটের দিকে মায়ের মোবাইল ফোনে অপরিচিত একটি নাম্বার থেকে কল দিয়ে রায়হান জানায় পুলিশ তাকে ধরে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে নিয়ে এসেছে। এখন তার কাছে ১০ হাজার টাকা ঘুষ চাচ্ছে। টাকা দিলে পুলিশ তাকে ছেড়ে দিবে।
এ কথা শুনে রায়হানের মা তার চাচাকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে পাঠান। রায়হানের চাচা হাবিবুল্লাহ রবিবার ফজরের সময় টাকা নিয়ে ভাতিজা রায়হানকে ছাড়িয়ে আনতে বন্দরবাজার ফাঁড়িতে যান।
এসময় সাদা পোষাকে ফাঁড়িতে থাকা এক পুলিশ সদস্য বলেন, ‘আপনার ১০ হাজার টাকা নিয়ে আসার কথা। আপনি ৫ হাজার টাকা নিয়ে আসলেন কেন? চলে যান, রায়হান এখন ঘুমাচ্ছে এবং যে পুলিশ কর্মকর্তা তাকে ধরে নিয়ে এসেছেন তিনিও ফাঁড়িতে নেই। আপনি ১০ হাজার টাকা নিয়ে সকাল ৯টার দিকে আসেন। আসলেই তাকে নিয়ে যেতে পারবেন। তাকে আমরা কোর্টে চালান করবো না। ’
এ কথা শুনে রায়হানের চাচা বাসায় চলে যান এবং পরে সকাল ৯টার দিকে টাকা নিয়ে ফের বন্দরবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে যান। এসময় পুলিশ সদস্যরা জানান, অসুস্থ হয়ে পড়ায় সকাল ৭টার দিকে রায়হানকে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ খবরে হাবিবুল্লাহ উদ্বিগ্ন হয়ে তৎক্ষণাৎ ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারেন রায়হানের লাশ মর্গে রাখা হয়েছে। ময়না তদন্তের পর বিকেল ৩টার দিকে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর করে।
রায়হানের মা সালমা বেগম বলেন, তার দুই ছেলে ও দুই মেয়ের মধ্যে রায়হান বড়। তার এক মেয়ে বিয়ে হয়ে আমেরিকায় থাকে। আমেরিকা প্রবাসী বোনের আবেদনের ভিত্তিতে রায়হানও কিছুদিনের মধ্যে আমেরিকা চলে যাওয়ার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। এরই মাঝে খালি হয়ে গেলো তার বুক।
সালমা বেগম আরও বলেন, যদি আমার ছেলে জনতার হাতে মার খেতো তবে তার চেহারা বা বুকে-পিঠে মারের দাগ থাকতো। কিন্তু আমার ছেলের বুক-পিঠ এবং চেহারা সম্পূর্ণ অক্ষত। শুধু হাটুর নিচের প্রহারের দাগ এবং হাতের আঙ্গুল ও নখে আঘাতের চিহ্ন। শুনেছি, পুলিশ নির্যাতন করলে নাকি এসব স্থানেই আঘাত করে।
রায়হানের মা আহাজারি করে বলেন, পিতৃহারা আমার কলিজার ধন রায়হানকে এলাকার সবাই পছন্দ করতো। তার বিরুদ্ধে কারো কোনো অভিযোগ ছিলো না। কিন্তু পুলিশ কেন তাকে তুলে নিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করলো- তার বিচার চাই। হত্যাকরী পুলিশদের মৃত্যুদণ্ড চাই। দেশের প্রধানমন্ত্রীও আমার মতো একজন মা। আমি এক অভাগা মা হয়ে সারা দেশের মায়ের কাছে বিচার চাচ্ছি। দোষী একজন পুলিশকেও যেন ছাড় দেয়া না হয়।
উল্লেখ্য, রোববার (১১ অক্টোবর) ভোরে রায়হানের মৃত্যুর পর পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিলো- ছিনতাইকালে নগরীর কাস্টঘর এলাকায় গণপিটুনিতে রায়হানের মৃত্যু হয়েছে। তবে পরিবারের পক্ষ থেকে নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ তোলার পর তদন্তে নেমেছে পুলিশ।
এ বিষয়ে সিলেট মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (গণমাধ্যম) জ্যোতির্ময় সরকার জানান, রায়হানের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে তদন্ত চলছে। তদন্তে পুলিশের কেউ জড়িত থাকার প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
প্রতিনিধি