অনলাইন সংস্করণ:
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আসন্ন শীত মৌসুমে করোনাভাইরাসের সম্ভাব্য দ্বিতীয় ঢেউ কার্যকরভাবে মোকাবেলায় জেলা হাসপাতালগুলো সর্বাত্মক প্রস্তুত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘গত শীতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছিল। এটি আসন্ন শীতে আবার উত্থান হতে পারে মাথায় রেখে, আমরা প্রতিটি জেলা হাসপাতালে আইসিইউ স্থাপন এবং অক্সিজেন নিশ্চিতকরণসহ সব ধরনের চিকিৎসা সেবা প্রস্তুত করে রাখছি।’
শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে কিশোরগঞ্জের ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম মহাসড়ক উদ্বোধন শেষে দেয়া ভাষণে একথা বলেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা করেন।
প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের সচিব মো. নজরুল ইসলাম প্রকল্পের পর একটি সংক্ষিপ্ত প্রেজেন্টেশন উপস্থাপন করেন। আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক ড. আবদুস সোবহান গোলাপ, পিএমও সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়া এবং প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এ সময় উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী কোভিড-১৯ মোকাবেলায় তার সরকারের পদক্ষেপের উল্লেখ করে বলেন, ‘আমরা হাসপাতালগুলোতে ইতোমধ্যে ২ হাজার ডাক্তার এবং ৩ হাজার নার্স নিয়োগ দিয়েছি।’
করোনাভাইরাস শুধু বাংলাদেশেই নয় সমগ্র বিশ্বেই ক্ষতির একটি কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘সব থেকে কষ্টের একটা বিষয় হচ্ছে- আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা স্কুলে যেতে পরছে না। কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে পারছে না। তাদের পড়াশোনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘তারপরেও আমরা চাচ্ছি তাদের পড়াশোনাটা যাতে চলমান থাকে সেজন্য সংসদ টেলিভিশনের মাধ্যমে পাঠ্যক্রম চলছে।’ তিনি এ সময় ডিজিটাল পদ্ধতিতে তার সরকারের শিক্ষা কার্যক্রম অব্যাহত রাখার প্রচেষ্টায় অভিভাবকদেরও সহযোগিতা কামনা করেন।
শেখ হাসিনা বৈশ্বিক সংকট করোনা মোকাবেলায় তার সরকারের পদক্ষেপের পাশাপাশি শিশু-কিশোরদের করোনা থেকে বাঁচাতে তাদের খেলাধুলা করা এবং রোদের সংস্পর্শে আসার পরামর্শ দেন।
তিনি বলেন, ‘শিশু-কিশোরদের মুক্ত বাতাসে থাকতে হবে এবং রোদে থাকাটা জরুরি।’ সরকার প্রধান বলেন, অভিভাবকদের নিজেদের সন্তানদের ক্ষেত্রে বিষয়টি মাথায় রাখার পাশাপাশি সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে, যাতে এ করোনাভাইরাসে আর কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হন।’
মুজিববর্ষে রাষ্ট্রপতির উপহার : প্রধানমন্ত্রী কিশোরগঞ্জের ‘ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম মহাসড়ক বা অল ওয়েদার রোড’ মুজিববর্ষে রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে একটি উপহার হিসেবে বর্ণনা করেন।
ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম মহাসড়ক উদ্বোধন শেষে সুবিধাভোগীদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে তিনি বলেন, ‘আমরা মুজিববর্ষে মহামান্য রাষ্ট্রপতির পক্ষ থেকে এটি উপহার হিসেবে দিয়েছি।’ এ সময় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে এমন মহাসড়ক তৈরির উদ্যোগ নেয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা তার (রাষ্ট্রপতির) অনুপ্রেরণা ও উদ্যোগের কারণে রাস্তাটি নির্মাণ করতে সক্ষম হয়েছি।’ এ অঞ্চলে এ জাতীয় মহাসড়ক নির্মিত হতে পারে এটা কল্পনার বাইরে ছিল উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাষ্ট্রপতির উদ্যোগের কারণে এটি সম্ভব হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ স্থাপন হওয়ায় এ মহাসড়কটি নির্মাণের কারণে এ অঞ্চলের মানুষের দুর্ভোগ দূর হয়ে যাবে।’
এ অঞ্চলের মানুষ এখন নাসিরনগর বা ভৈরব হয়ে দ্রুত ঢাকা যাতায়াত করতে পারবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমরা এই মহাসড়ক নির্মাণ করে একটি দুর্দান্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা তৈরি করতে সক্ষম হয়েছি।’
অনুষ্ঠানে মহাসড়কটির ওপর একটি ভিডিও চিত্রও প্রদর্শিত হয়। ভিডিওতে হাওরের বিস্ময় ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম অলওয়েদার সড়কের ভিডিও চিত্র দেখে হাওর ও সড়কটির সৌন্দর্যে অভিভূত হয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা বলেন, ‘ইশ! কবে যে যাব। এ সড়কে (দেখতে) কবে যে যাব।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমার মনটা পড়ে থাকল। এ সড়ক দিয়ে গাড়িতে কবে যাব? রাষ্ট্রপতিও চান আমি যেন সরাসরি যাই। আমি যাব। করোনা পরিস্থিতি উন্নতি হলে এ সড়ক দেখতে যাব।’
দেশের কোনো অঞ্চলের মানুষ আর অনুন্নত থাকবে না উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘যোগাযোগ ব্যবস্থা ভালো হলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থাও ভালো হবে। হাওর এলাকায় কৃষিভিত্তিক শিল্প কারখানা ও গড়ে তুলতে চায় সরকার।’
যেখানে যে পণ্যটা উৎপন্ন হয় সেখানেই সে শিল্প গড়ে তোলার দিকে সরকার নজর দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, যেহেতু হাওরে একটা বিশাল মৎস্য ভাণ্ডার রয়েছে তাই এ মৎস্য উত্তোলন, লালন-পালন ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাতকরণের সুবিধা হয় সেই লক্ষ্যেই আমরা এ অঞ্চলে শিল্পকারখানা গড়ে তুলতে চাই।
তিনি বলেন, কৃষি পণ্যের ওপর নির্ভরশীল অঞ্চলগুলোতে গড়ে তুলব খাদ্য এবং কৃষি প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্প। কারণ, শুধু কৃষির ওপর নির্ভরশীল থাকলেই হবে না। পণ্য উৎপাদন, বাজারজাত এবং বিদেশে রফতানির মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আমাদের অর্জন করতে হবে- সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আরও অনেক কর্মসূচি আমরা বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। রাস্তা তৈরি হয়ে যাওয়ায় অষ্টগ্রামের বিখ্যাত পনির এখন শুধু ঢাকা শহরেই নয় বিদেশেও রফতানি করা সম্ভব হবে অর্থাৎ অর্থনৈতিক ভাবে এ অঞ্চলের মানুষ যেন আরও সমৃদ্ধশালী হন সেটাই আমরা করতে চাচ্ছি- বলেন শেখ হাসিনা।
হাওরের সৌন্দর্য বহুগুণ বাড়িয়েছে মহাসড়কটি : সড়ক ও জনপথ অধিদফতর ৮৭৪ দশমিক ০৮ কোটি টাকা ব্যয়ে ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়কটি নির্মাণ করেছে। ২০১৬ সালের ২১ এপ্রিল ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম সড়ক প্রকল্পের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। হাওরের বুক চিরে চলে যাওয়া ২৯ দশমিক ৭৩ কিলোমিটার দীর্ঘ এ অলওয়েদার সড়কে ৫৯০ দশমিক ৪৭ মিটার দীর্ঘ তিনটি পিসি গার্ডার, ১৯০ মিটার দীর্ঘ ৬২টি আরসিসি বক্স কালভার্ট, ২৬৯ দশমিক ৬৮ মিটার দীর্ঘ ১১টি আরসিসি গার্ডার ব্রিজ নির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে ২৬১ দশমিক ৮১ মিটার দীর্ঘ ভাতশালা সেতু, ১৭১ দশমিক ৯৬৪ মিটার ঢাকী সেতু ও ১৫৬ দশমিক ৭২ মিটার দীর্ঘ ছিলনী সেতু মহাসড়কের সৌন্দর্যকে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছে।
বর্ষায় ভাঙন থেকে সড়ক রক্ষায় ৭ দশমিক ৬০ লাখ বর্গমিটার সিসি ব্লক দিয়ে স্লোপ প্রটেকশনের কাজ করা হয়েছে।
কিশোরগঞ্জের হাওর অধ্যুষিত ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলা যেন সৌন্দর্যের লীলাভূমি। শুকনো মৌসুমে মাইলের পর মাইল ফসলি জমি, যেখানে সবুজ আর সোনালি রং মিলেমিশে একাকার। হাওরের বুকে বিশাল খোলা আকাশের রূপে মুগ্ধ ভ্রমণ পিপাসুরা। কখনও ঝকঝকে নীল আকাশ, কখনও আকাশে সাদা মেঘের ভেলা। ভোরের সূর্য আর গোধূলিতে ভিন্ন রূপে সাজে হাওরের আকাশ।
বর্ষায় মাইলের পর মাইল বিস্তীর্ণ জলরাশি, বর্ষা শেষে জলকাদা আর শুকনো মৌসুমে ফসলি জমি। বর্ষায় নৌকা আর অন্য ঋতুতে হাঁটা ছাড়া চলাচলের উপায় ছিল না হাওরবাসীর।
নতুন সড়ক নির্মিত হওয়ায় হাওরের সৌন্দর্য উপভোগ করতে প্রায় প্রতিদিন হাজার হাজার পর্যটক সমাগম হচ্ছে। স্থানীয়দের কথায়, দৃষ্টিনন্দন রাস্তাটির সুবাদে জীববৈচিত্র্যে পরিপূর্ণ হাওরের সৌন্দর্য বেড়েছে।
প্রতিনিধি