শেখ বসির। লোকটি আরবের হলেও মননে ও চিন্তায়, আবেগে ও উচ্ছ্বাসে দেওবন্দী। দেওবন্দের যাবতীয় ছাপ ছিলো তার মধ্যে।
রুহানিয়্যাত, রব্বানিয়্যাত এবং তরীকত- সবকিছুতে সমান বিচরণ ছিলো তার।
তিনি ছিলেন হাজি ইউনুস সাহেবের মুরিদ। তার মাধ্যমে হাজি সাহেব সবচে বেশি ডোনেশন পেয়েছেন। এরপর আল্লামা আহমদ শফীও (রহ.) তার মাধ্যমেই সবচে বেশি ডোনেশন পেয়েছেন।
খানকার মতো একটা হলরুম ছিলো তার বাড়িতে। আরবের বিভিন্ন আলেমগণ আসতেন সেখানে। ছোট হলেও আমি যেতাম, যেতেন আল্লামা আহমদ শফী।
হলরুমের একপাশে বসতো মিসরি এবং সিরিয় আলেমগণ। সেই হলরুমের মজলিশে আহমদ শফী কথা বলতেন।
কোরআন হাদিসের উদ্ধৃতির সঙ্গে আওড়াতেন গুলিস্তা, বুস্তা, মসনবি থেকে ফার্সি কবিতা। যেই কবিতাগুলোতে থাকতো রুহানিয়্যাত ও রব্বানিয়্যাতের ঝলক। বড় আউলিয়া কেরামের দীপ্তিময় বাণী। সঙ্গে সঙ্গে ফার্সি কবিতাগুলোর অনুবাদ করে দিতেন।
অনেকগুলোর অনুবাদ করে দিতাম আমি। বয়সে ছোট হলেও, মজলিশে আমিও কথা বলতাম। মন্তব্য পেশ করতাম। চেষ্টা করতাম কথাগুলো গুছিয়ে বলার। তাই সবাই আমার কথাগুলো পছন্দ করতো।
এভাবেই হযরতের সঙ্গে আমার পরিচয়। নূরানী এক সফরের শুরু।
হাটহাজারি মাদরাসা যেন হযরতের স্পর্শেই পূর্ণতা পেয়েছে। হাজি ইউনুস সাহেব হযরতকে মাদ্রাসার মুহতামিম বানানোর পর সবকিছুতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে।
মাদ্রাসার শিক্ষা, মাদ্রাসার কাঠামোগত উন্নতি, মাদ্রাসা পরিচালনা- সবকিছুতে এক নবজোয়ার এসেছে। সবকিছু নব উদ্দীপনা পেয়েছে।
এত উন্নতি, তরতর করে উপরে উঠে যাওয়ার একমাত্র কারণ- হযরতের ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত। ইখলাসের শক্তি ও উদ্যম নিয়েই তিনি মাদরাসার জন্য দৌড়ে বেড়িয়েছেন দেশ দেশান্তর। দুবাই, সৌদি আরব, কাতার। শেখ বসিরের মজলিসেও মাদ্রাসা নিয়ে কথা হতো।
১৯৯৩ সালে মদীনা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক নিয়ে হাটহাজারি মাদ্রাসা গিয়েছিলাম। এরপর গিয়েছিলাম কুয়েতের একদল অতিথি নিয়ে।
হযরত আমাকে দারুণ আপ্যায়ন করেছেন। মেহমানখানায় হযরত নিজ হাতে তুলে আমাকে খাইয়ে দিয়েছেন। মাদানী দস্তরখানা যে কত উদার, তা সেদিন টের পেয়েছিলাম।
হযরতের ছেলে আনাস যখন হাটহাজারি মাদ্রাসার কালেকশনের জন্য কুয়েত যায়, আমি একটি ‘রিকমেন্ডেশন লেটার’ লিখে দিয়েছিলাম। এই লেটারের ভরসায় শেখ আবদুল আলী আল মুতাউওয়া মাদ্রাসার জন্য বড় অংকের বাৎসরিক একটা অনুদান চালু করে দেয়। এজন্য হযরত আমার উপর অনেক বেশী সন্তুষ্ট ছিলেন।
ইসলামি আকিদার জন্য, দেওবন্দী সিলসিলার জন্য, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের জন্য, সহীহ তাবলিগের জন্য, কদিয়ানিদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য- হযরত সবসময় তৎপর ছিলেন।
এই বৃদ্ধ বয়সে এসেও চৌকান্না হয়ে কাজ করেছিলেন। আমাদের জন্য আলোর পথ তৈরী করছেন। বিস্ময়কর সর্বশেষ যে কাজটি তিনি করলেন, তা হলো কওমি সনদ।
সব আলেমকে একমঞ্চে এনে, এক কাতারে দাঁড় করিয়ে সরকার থেকে আাদায় করলেন দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের সমমান দেয়া সনদ।
হযরতের মতো এত উদার, এত উন্নত মার্জিত মানসিকতার মানুষ খুব দুর্লভ। হাটহাজারি মাদ্রাসায় গেলেই টের পাওয়া যায় হযরতের উন্নত মানসিকতার চমক।
মাদ্রাসার ক্লাসরুম, গবেষণাগার, মেহমানখানা, লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব সবখানে।
একদিকে হযরত ইখলাস ও যিকরে ইলাহিতে ভরপুর, অন্যদিকে দুনিয়াবি আসবাব ও আধুনিকতার দিকেও মনযোগী ছিলেন আল্লামা শফী। দুটোর সম্মিলনে হযরত মহীরূহ হয়ে উঠেছিলেন। ছায়ায় মায়ায় আমাদের আগলে রেখেছেন।
শেখ বসীরের মজলিশ থেকে হযরতের সঙ্গে যে নূরানী সফরের শুরু, তা আমার ছোট্ট জীবনকে ধন্য করেছে।
লেখক: ইসলামিক স্কলার ও চট্টগাম ১৫ আসনের সংসদ সদস্য
প্রতিনিধি