Home » বাংলাদেশের উন্নয়ন বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

বাংলাদেশের উন্নয়ন বঙ্গবন্ধু থেকে শেখ হাসিনা

স্বাধীনতা অর্জনের পর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যখন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের হাল ধরলেন তখন সারা দেশে চিকিৎসাব্যবস্থা ছিল বিপর্যস্ত। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতের মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়টির কথা ভেবে বঙ্গবন্ধু কোনো বিলম্ব না করে দেশের বৃহত্তর গরিব জনগোষ্ঠীর জন্য স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জাতীয়করণ করেন।

তখন সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে চিকিৎসক হওয়ার আগ্রহ থাকলেও পাস করার পর তাদের চাকরির নিশ্চয়তা ছিল না।

বঙ্গবন্ধু চাকরির নিশ্চয়তা দিয়ে সব মেডিকেল কলেজে মেধাবীদের ভর্তির ব্যবস্থা করেন। চিকিৎসকরা তখন সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণির মর্যাদা পেতেন না। বঙ্গবন্ধু চিকিৎসকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা প্রদান করেন। একই সঙ্গে ১৯৭২ সালের জুন মাসে Bangladesh

College of Physicians and Surgeons (BCPS)-কে একটি আইনগত কাঠামো করে সাংগঠনিক রূপদান করেন। দেশে চিকিৎসকদের বিশেষায়িত ট্রেনিং ও উচ্চতর শিক্ষার প্রয়োজনীয়তার দূরদর্শী চিন্তা থেকেই বঙ্গবন্ধু এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।

মিটফোর্ড হাসপাতালকে স্বাধীনতার পরপরই পূর্ণাঙ্গ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের রূপ দেন। এবং ১৯৭২ সালেই প্রথম ব্যাচের MBBS ছাত্ররা ভর্তি হয়। দেশের একমাত্র কলেরা হাসপাতালকে The International Centre for Diarrhoeal Disease Research,

Bangladesh (ICDDR,B) হিসেবে রূপান্তর করে একে সাংগঠনিক রূপ দেন। শিশু-কিশোরদের স্বাস্থ্যের দিকে বঙ্গবন্ধুর সজাগ দৃষ্টি ছিল। এ প্রেক্ষাপটে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে ১৯৭৪ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ‘National Economic Council of Bangladesh’-এর সভায় ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট একটি শিশু হাসপাতাল প্রকল্প অনুমোদিত হয়।

এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭৫ সালে মার্চ মাসে তৎকালীন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় এই প্রকল্প বর্তমান অবস্থান শেরেবাংলা নগরের শ্যামলীতে স্থানান্তর করেন, যা ঢাকা শিশু হাসপাতাল নামে পরিচিত। স্বাস্থ্য খাতে বঙ্গবন্ধুর ব্যাপক কর্মপরিকল্পনার আরও একটি দিক হল, ১৯৭২ সালে ১০০ শয্যার বিশেষায়িত সংক্রামক ব্যাধি হাসপাতাল স্থাপন করেন। বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জনের সময় ১৯৭২ সালে সারা দেশে হাসপাতাল ছিল মাত্র ৬৭টি, যা ছিল খুবই অপ্রতুল।

যার ফলে গরিব জনগোষ্ঠী ঠিকমতো চিকিৎসা নিতে পারত না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে বঙ্গবন্ধু সরকারি চিকিৎসাব্যবস্থাকে জনগণের দোরগোড়ায় নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে প্রতি থানায় একটি করে হাসপাতাল নির্মাণের উদ্যোগ নেন। যার ফলে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত এভাবে সারা দেশে ৩৭৫টি থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়।

শুধু চিকিৎসক ও হাসপাতালই নয়- বঙ্গবন্ধু গুণগত মানসম্পন্ন ওষুধের দিকেও নজর দিয়েছিলেন। এজন্য তিনি প্রয়াত জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ওষুধ নিয়ন্ত্রণ বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করেন, যার লক্ষ্য ছিল ক্ষতিকর, অপ্রয়োজনীয় ও বেশি দামি ওষুধ আমদানি বন্ধ এবং ওষুধের যৌক্তিক ও নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করা। ক্ষতিকর অনেক ওষুধও তিনি বাতিল করেছিলেন। সেই সঙ্গে তিনি ওষুধের উৎপাদন ও মান নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে ওষুধ প্রশাসন পরিদফতর গঠন করেন। বহুজাতিক ওষুধ কোম্পানিগুলো কর্তৃক মামলা করার ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি ওষুধের পেটেন্ট আইন না মানার ঘোষণা দেন। ফলে মানুষ কম দামে ওষুধ পেত, যা আজও অব্যাহত রয়েছে।

এভাবে তিনি ওষুধ নিয়ন্ত্রণে একটি নীতিমালা তৈরি করেছিলেন, যাকে বাংলাদেশের প্রথম ওষুধনীতি বলা যেতে পারে। উল্লেখ্য, পরবর্তীকালে ১৯৮২ সালের জাতীয় ওষুধনীতি প্রণয়নের সময় বিশেষজ্ঞ কমিটি বঙ্গবন্ধুর এসব নীতিমালাকেই ভিত্তি হিসেবে অনুসরণ করেছিল।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে পাকিস্তানি আমলের নৈরাজ্য আবার ফিরে আসে। তার থেকে উত্তরণে দু’দশক লেগে যায়। ১৯৭৫-পরবর্তী সরকারগুলো সর্বজনবান্ধব নীতি ও প্রকল্প বাদ দিয়ে দেয়। ওষুধনীতিরও অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ ও মূল্যসংক্রান্ত নিয়মের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটানো হয় ১৯৯৪ সালে বিএনপির শাসনামলে। আক্ষরিক অর্থেই স্বাস্থ্য খাতের জনবান্ধব নীতিমালা থেকে সরকার সরে আসে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এলে স্বাস্থ্য খাত আবার জনবান্ধব হতে থাকে। স্বাস্থ্যকে গণমুখী ও জনবান্ধব করার জন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৯৮ সালে দরিদ্র মানুষের প্রতি লক্ষ্য রেখে জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি প্রণয়ন করেন। স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচিকে একত্র করার ফলে সেবা পাওয়া আরও সহজ হয়।

সংশ্লিষ্টদের আপত্তি না শুনে শাহবাগ ইন্সটিটিউট অব পোস্ট গ্র্যাজুয়েট মেডিসিন অ্যান্ড রিসার্চ ও হাসপাতাল (আইপিজিএমআর)-কে পূর্ণাঙ্গ ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে’ রূপান্তরিত করেন এবং হাসপাতালকে উন্নততর সেবাদান পরিকল্পনার অনুমোদন দেন।

উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স হাসপাতালগুলোকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করেন। ফলে বিশেষত গরিব মানুষ উন্নত সেবা পেতে থাকে। প্রতি ৬ হাজার মানুষের জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপন শুরু করেন, যা ন্যক্কারজনকভাবে ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ক্ষমতায় এসে বন্ধ করে দেয়।

বঙ্গবন্ধুকন্যা ২০০৯ সালে আবার সরকারে আসার পর গরিব মানুষের জন্য কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের কাজ শুরু করেন এবং এ পর্যন্ত সারা দেশে মোট ১৩ হাজার ৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিক, যেগুলোতে ৩১টি ওষুধ বিনামূল্যে প্রদান করা হচ্ছে। বর্তমানে দেশে সরকারি ৩০টি ও বেসরকারি ৭৪টি মেডিকেল কলেজ রয়েছে, যেগুলোর মাধ্যমে চিকিৎসা শিক্ষাকে যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে সরকারি ও বেসরকারি সব মেডিকেল কলেজের পাঠ্যসূচিকে উন্নত এবং একমুখী করেছেন।

এভাবে প্রতি বছর সারা দেশে ১০ হাজার চিকিৎসক স্বাস্থ্যসেবায় যোগ দিতে পারবেন। সব জেলা হাসপাতালকে তিনি ২৫০ শয্যা, যেগুলো ২৫০ শয্যার ছিল সেগুলোকে ৫০০ শয্যা এবং ৫০০ শয্যার হাসপাতালকে ১ হাজার শয্যায় রূপান্তরিত করেছেন।

কিছু সমস্যা সত্ত্বেও সরকারি হাসপাতালগুলো এখনও গরিব মানুষের চিকিৎসা পাওয়ার একমাত্র জায়গা। গরিব জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি মাথায় রেখে তিনি এসব করেছেন। সেই সঙ্গে তিনি সব সরকারি হাসপাতালে রোগীপ্রতি খাবারের বরাদ্দ দ্বিগুণ করে দিয়েছেন।

এছাড়া নতুন ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৩৬টি। দেশে এই প্রথম জেলা হাসপাতালগুলোতে কার্ডিয়াক কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। শহরের নিম্ন আয়ের মানুষ ও মধ্যবিত্তদের জন্য নতুন হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছে। এছাড়া উন্নত বিশ্বের মতো নতুন বিশেষায়িত হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

উপজেলা ও জেলা হাসপাতালগুলোতে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। প্রত্যন্ত গ্রামের হাসপাতাল থেকে ভিডিও কনফারেন্স করে বিশেষজ্ঞদের মতামত নেয়ার ব্যবস্থা করেছেন। ‘স্বাস্থ্য বাতায়ন’ প্রকল্পে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির সুবিধা তৈরি করা হয়েছে। এর ফলে গ্রামের রোগীরাও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের মতামত পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে। রোগীরা এখন উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে কম যাচ্ছে এবং জটিল ও দুরারোগ্য রোগের চিকিৎসা দেশেই গ্রহণ করতে শুরু করেছে।

যেখানে শুধু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২৫ শয্যার একটিমাত্র বার্ন ইউনিট ছিল এখন সেখানে নতুন একটি শেখ হাসিনা বার্ন ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল উন্নত ও সম্প্রসারিত চিকিৎসা সেবাদানের জন্য কার্যক্রম শুরু করেছে। এছাড়া প্রতিটি সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং জেলা হাসপাতালে বার্ন ইউনিট খোলা হচ্ছে। নতুন একটি শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রোলিভার ইন্সটিটিউট ও হাসপাতাল নির্মিত হয়েছে, যেখানে বর্তমানে করোনা রোগীদের চিকিৎসা হচ্ছে।

চট্টগ্রাম ও রাজশাহীতে মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। নার্সদের দীর্ঘদিনের দাবি অনুযায়ী তাদের সরকারি দ্বিতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেয়া হয়েছে। এ রকম আরও বিভিন্ন জনবান্ধব ও গরিব মানুষের কল্যাণমুখী কাজের ফলে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাত আজ তৃতীয় বিশ্বের রোল মডেলে রূপান্তরিত হয়েছে।

বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে অনেক ইতিবাচক ফল পাওয়া গিয়েছে। Bangladesh Bureau of Statistics 2019 তথ্যানুসারে, নবজাতক মৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ৩০ এবং ১ বছর পর্যন্ত শিশুমৃত্যু হার ৩৮; আর ৫ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার বর্তমানে প্রতি হাজারে ৪৫ জনে নেমে এসেছে। মাতৃমৃত্যুর হার বর্তমানে ১.৮১ প্রতি হাজারে। সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি, সুপেয় পানি ও স্যানিটেশনের সফলতায় বাংলাদেশ বিশ্বে উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।

শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির অভূতপূর্ব সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। যেজন্য আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা ‘ভ্যাকসিন হিরো’ (২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯) সম্মাননায় ভূষিত হন। কালাজ্বরে মৃত্যুর হার এখন শূন্য।

যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসায় সফলতার হার এখন ৯৪ শতাংশ। এইচআইভির বিস্তার থামানো গেছে। ২০১১ সালে বাংলাদেশ বার্ড ফ্লু প্রতিহত করতে পেরেছে। হেপাটাইটিস-বি, মাম্পস, রুবেলা ও নিউমোনিয়ার টিকাও এখন সরকারি টিকা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। বাংলাদেশকে এখন পোলিওমুক্ত রাষ্ট্র ঘোষণা করা হয়েছে।

অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের কারণে এখন দুর্ভিক্ষ আর মঙ্গা নেই। মানুষের সচ্ছলতা বেড়েছে। ফলে মানুষের গড়পড়তা ক্যালরি গ্রহণের পরিমাণ বেড়েছে। বিভিন্ন হিসাবে ক্যালরি গ্রহণের সর্বনিম্ন পরিমাণ ২ হাজার ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ২ হাজার ৬৪০ পর্যন্ত পাওয়া গেছে, যা গড়ে ২ হাজার ২০০ ক্যালরি অনায়াসেই ধরে নেয়া যায়। ফলে মানুষের কর্মক্ষমতা বেড়েছে। পুষ্টি ও স্বাস্থ্যের উন্নতির ফলে গড় আয়ু বেড়ে ৭১.২ বছর হয়েছে।

সরকারের এতসব সাফল্যের কারণে জাতিসংঘ ঘোষিত সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা বাংলাদেশ ২০১৫ সালের আগেই অর্থাৎ নির্ধারিত সময়ের দু’বছর আগেই অর্জনে সফল হয়েছে। যার স্বীকৃতি স্বরূপ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এমডিজি অ্যাওয়ার্ড ২০১০, স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় তথ্যপ্রযুক্তির সফল প্রয়োগের জন্য সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ড ২০১১সহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন।

বাংলাদেশে নারী শিক্ষা ও উদ্যোক্তা তৈরিতে অসামান্য নেতৃত্বদানের জন্য গত বছরের ২৭ এপ্রিল ২০১৯ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘গ্লোবাল উইমেনস লিডারশিপ অ্যাওয়ার্ড’ লাভ করেন।

ওষুধের মানসম্মত উৎপাদন ও দেশকে ওষুধে স্বনির্ভর করার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৪ সালে যে ওষুধ প্রশাসন পরিদফতর গঠন করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে একে অধিদফতর করেছেন। এখন দেশের বার্ষিক চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ দেশেই উৎপাদন হচ্ছে। শুধু তাই নয়, এখন বাংলাদেশের ওষুধ মোট ১২৫টি দেশে রফতানি হচ্ছে। স্বল্পোন্নত, উন্নয়নশীল ও উন্নত বিশ্বও আজ আমাদের ওষুধ খাচ্ছে।

পৃথিবীর সবচেয়ে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত ওষুধের বাজার বলে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও এ বছর থেকে আমাদের ওষুধ রফতানি শুরু হয়েছে। কিছু অসাধু ওষুধ কোম্পানি যখন যে সরকার আসে সে সরকারি দলের আশ্রয়ে গিয়ে নিম্নমান, নকল ও ভেজাল ওষুধ বিক্রির চেষ্টা করে থাকে।

এ সরকারের আমলে জাতীয় সংসদের স্বাস্থ্যবিষয়ক স্থায়ী কমিটির সুপারিশে ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে নিম্নমান, নকল ও ভেজাল ওষুধ নির্মূলে ৬২টি কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। সরকারের এসব তৎপরতা অব্যাহত থাকায় দেশের ওষুধ খাত গার্মেন্টসের পরই দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাতে পরিণত হচ্ছে।

খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপতৎপরতা নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশুদ্ধ খাদ্য আইন ২০১৩ জারি হয়েছে। এখানে আগের আইনগুলোতে বর্ণিত লঘু শাস্তির পরিবর্তে ভেজাল খাবারের শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড করা হয়েছে। এছাড়া ফরমালিন নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৫ জারি হয়েছে এবং ফরমালিনের আমদানি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। এর ফলে বাজারের সবজি, ফল, মাছ ও দুধে ফরমালিন মেশানোর প্রবণতা কমেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে। ভোক্তা অধিকার রক্ষা অধিদফতর স্থাপন করা হয়েছে।

অতি দরিদ্রদের খাদ্যের জন্য কর্মসংস্থান প্রকল্প, প্রতিবন্ধী ভাতা, টাঙ্গাইল থেকে শুরু করা স্বাস্থ্য বিমা প্রকল্প, দলিতদের জন্য প্রতি জেলায় সুইপার কলোনি, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য খাদ্য সাহায্য কর্মসূচি, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রতি কেজি ১০ টাকা দরে প্রতি পরিবারকে মাসে ৩০ কেজি চাল প্রদান কর্মসূচি, দরিদ্র ও অতি দরিদ্রদের জন্য ভিজিএফ কার্ড বিতরণ, দুর্বৃত্ত ও স্বামী কর্তৃক নির্যাতিত নারীদের জন্য আইন প্রণয়ন, তাদের চিকিৎসার জন্য সব মেডিকেল ও জেলা হাসপাতালগুলোতে ওয়ান স্টপ সার্ভিস প্রবর্তন, গৃহকর্মী নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ, গর্ভবতী মায়েদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটি ৬ মাস করা, দরিদ্র মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোতে সহায়তা ভাতা, শারীরিক প্রতিবন্ধী আইন ২০১৩, মানসিক ও স্নায়ুগত প্রতিবন্ধীদের সুরক্ষা আইন ২০১৩, মানসিক স্বাস্থ্য আইন প্রণয়ন, ক্যান্সার-কিডনি-লিভার সিরোসিস রোগীদের চিকিৎসার জন্য আর্থিক সহায়তা প্রদান ইত্যাদি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিও দেশের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে প্রভূত অবদান রাখছে। সরকার তার বিভিন্ন দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর জন্য দু-একটি নয়, মোট ১১৮টি সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি চালু করেছে। তাও আবার প্রথাগত চিন্তা অনুযায়ী শুধু সমাজসেবা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে নয়, বরং ২৩টি বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে এবং এগুলোর জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে দেশের মোট বাজেটের ৯.৫ শতাংশ অর্থ।

বঙ্গবন্ধুকন্যা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হওয়ার স্বপ্ন দেখিয়ে গেছেন। আজ বঙ্গবন্ধুকন্যা সেই স্বপ্নকে একটার পর একটা বাস্তবায়ন করে আমাদের আত্মপ্রত্যয়ী করছেন। অন্যান্য সেক্টরের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধুকন্যা স্বাস্থ্য সেক্টরে যে প্রভূত উন্নতি করেছেন তা অন্যান্য দেশের জন্য ঈর্ষণীয় এবং তা জাতির ভবিষ্যৎ ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

স্বাধীনতা-উত্তরকালে বঙ্গবন্ধুর সরকারই প্রথম এ দেশের পল্লী অঞ্চলের সাধারণ মেহনতি মানুষের স্বাস্থ্যসেবার কথা বিবেচনা করে চিকিৎসাসেবাকে থানা পর্যায়ে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স চালু করেন, চিকিৎসকদের সরকারি চাকরিতে সম্মান ও মর্যাদার কথা বিবেচনা করে চিকিৎসকদের পদমর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণিতে উন্নীত করেছিলেন; যা দেশের চিকিৎসক সমাজ চিরদিন শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে।

ডা. মনজুর হোসেন : সভাপতি, বাংলাদেশ শিশু চিকিৎসক সমিতি; সাবেক পরিচালক ও অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা শিশু হাসপাতাল

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *