দেশে শিক্ষিত লোকের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বেকার লোকের সংখ্যা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৬ লাখ হলেও ৭১ লাখ মানুষের নির্দিষ্ট কোনো কাজ নেই। প্রতিদিন বাড়ছে উচ্চশিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। সরকারি চাকরিতে তিন লাখ শূন্য পদে নিয়োগ আটকে আছে। আবার কর্ম খালি থাকলেও দেশে দক্ষ কর্মীর অভাব থাকায় বিদেশ থেকে কর্মী আনা হচ্ছে। দেশে কর্মমুখী শিক্ষার অভাব আছে বলেই এমনটি হচ্ছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের।
দেশের শিল্প-কারখানায় কারিগরি জ্ঞানে দক্ষ জনবলের অভাবে প্রতিবছর ৬০০ কোটি মার্কিন ডলার বা প্রায় ৪৭ হাজার কোটি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন ফেডারেশন অব চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এফবিসিসিআই)।
এর কারণ হলো, আমরা প্রায়োগিক শিক্ষায় জোর না দিয়ে কেবল মুখস্থ বিদ্যায় জোর দিয়েছি। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার মূল উদ্দেশ্য জ্ঞান অর্জন না হয়ে ভারী সার্টিফিকেট অর্জনই হয়ে পড়েছে। অথচ বিশ্বের বড় বড় কম্পানিগুলোতে কাজ করার জন্য এখন আর কাগুজে সার্টিফিকেট মুখ্য বিষয় নয়। বরং দক্ষতা ও যোগ্যতা থাকলে যে কেউ তাদের কম্পানিতে কাজের সুযোগ পাবে। গুগল, অ্যাপলসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠান ঘোষণা দিয়েছে, তাদের কম্পানিতে যুক্ত হওয়ার জন্য কলেজ ডিগ্রি আবশ্যক নয়।
(shorturl.at/mru13) কিন্তু আমরা এখনো উল্টো পথেই হাঁটছি। এরই মধ্যে এ নিয়ে মুখ খুলেছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। তিনি বলেছেন, ‘সরকার আর শিক্ষিত বেকার তৈরি করতে চায় না।’
এভাবে অদক্ষ ও অযোগ্য লোকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া কিয়ামতের আলামত। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যখন আমানত নষ্ট হয়ে যাবে তখন কিয়ামতের অপেক্ষা করবে। এক ব্যক্তি বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমানত কিভাবে নষ্ট হয়ে যাবে? তিনি বলেন, যখন কোনো দায়িত্ব অযোগ্য ব্যক্তির ওপর ন্যস্ত করা হবে, তখনই কিয়ামতের অপেক্ষা করবে।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৯৬)
রাসুল (সা.)-এর হাদিসে অযোগ্য লোকদের দায়িত্ব গ্রহণকে দুর্নীতি বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। সমাজে দুর্নীতি বেড়ে গেলে অযোগ্য লোকেরা দায়িত্বে চলে আসে। যার প্রভাব সব সেক্টরেই পড়ে। ফলে যোগ্য ও দক্ষ মানুষ সেখানে মূল্যহীন হয়ে পড়ে। কোণঠাসা হয়ে পড়ে ঈমানদার ও আমানতদার লোকেরা।
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, আমি রাসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, ‘নিশ্চয়ই মানুষ এমন শত উটের মতো, যাদের মধ্যে থেকে তুমি একটিকেও বাহনের উপযুক্ত পাবে না।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৪৯৮)
আল্লাহর রাসুল (সা.)-এর এই হাদিসের বাস্তব চিত্র যেন গোটা বিশ্বব্যাপী ফুটে উঠেছে। পিছিয়ে নেই আমাদের দেশও। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) তথ্য মতে, ঘুষ ছাড়া প্রশাসনে কোনো কাজ হয় না। দেশের ৮৯ শতাংশ সাধারণ মানুষ ঘুষ-দুর্নীতির শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ মানুষ কোনো প্রতিবাদ বা অভিযোগ করা ছাড়াই ঘুষ দিতে বাধ্য হয়। অথচ রাসুল (সা.) ঘুষদাতা ও গ্রহীতা উভয়কেই অভিসম্পাত করেছেন। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৫৮০)
শুধু তা-ই নয়, রাসুল (সা.) তাঁর প্রশাসনের লোকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোরভাবে সতর্ক করেছেন। রাসুল (সা.) বলেন, হে লোকেরা! তোমাদের মধ্যকার কোনো ব্যক্তিকে আমাদের সরকারি কোনো পদে নিয়োগ করার পর সে যদি আমাদের তহবিল থেকে একটি সুই কিংবা তার অধিক আত্মসাৎ করে তবে সে খেয়ানতকারী (দুর্নীতিবাজ)। কিয়ামতের দিন সে তার এই খেয়ানতের বোঝা নিয়ে উপস্থিত হবে। তখন কালো বর্ণের জনৈক আনসার ব্যক্তি উঠে দাঁড়াল। (বর্ণনাকারী বলেন, আমি যেন তাকে দেখছি।) সে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব আপনি নিয়ে নিন। তিনি বলেন, তুমি কী বললে? সে বলল, আমি আপনাকে এরূপ এরূপ বলতে শুনেছি। তিনি বলেন, আমি বলেছি, যাকে আমরা কোনো দায়িত্ব দিয়েছি, সে কমবেশি যা কিছুই আদায় করে আনবে তা জমা দেবে। তা থেকে তাকে যা প্রদান করা হবে সে তা নেবে, আর তাকে যা থেকে বিরত থাকতে বলা হবে সে তা থেকে বিরত থাকবে। (আবু দাউদ, হাদিস : ৩৫৮১)
অতএব প্রকৃত যোগ্য লোক গড়ার জন্য আমাদের শুধু দক্ষতা অর্জনের দিকে নজর দিলেই সমস্যার সমাধান হবে না। শুধু কর্মমুখী শিক্ষাই এর একমাত্র সমাধান নয়। বরং দক্ষতা ও কর্মমুখী শিক্ষার পাশাপাশি চারিত্রিক উৎকর্ষ ও আমানতদার জনবল তৈরি করতে আমাদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। যাদের মধ্যে আল্লাহর ভয় নেই, তারাই বেশির ভাগ সময় দুর্নীতিগ্রস্ত হয়। তাই সর্বপ্রথম আমাদের সন্তানদের তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জনে সচেষ্ট করতে হবে।
একজন মানুষ প্রকৃত যোগ্য বলে গণ্য হওয়ার জন্য যেমন দক্ষতা ও শিক্ষা প্রয়োজন, তেমনি সৎ ও আল্লাহওয়ালা হওয়াও প্রকৃত যোগ্যতা অর্জনের পূর্বশর্ত। মহান আল্লাহ আমাদের সবাইকে প্রকৃত যোগ্যতা অর্জনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
মুফতি মুহাম্মদ মর্তুজা
প্রতিনিধি