সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের মাঠে পশুর হাট বসানোর ফলে কলেজের সাবেক শিক্ষার্থীসহ ক্রীড়াপ্রেমীদের মধ্যে দানা বাঁধছে ক্ষোভের। প্রশাসন ও সিলেট সিটি করপোরেশনের এমন সিদ্ধান্তকে হাস্যকর বলে মন্তব্য করছেন তারা। এমসি কলেজ স্বমহিমায় ও রূপে পৃথিবীর বুকে স্থান করে নিলেও সেই কলেজের সুনাম নষ্ট করার জন্য একটি পক্ষ ষড়যন্ত্র করেই মাঠে পশুর হাট বসানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে যেকোন সময় এমসি কলেজের অধ্যায়নরত শিক্ষার্থীরা মাঠ থেকে পশুর হাট সরিয়ে ন্যায়ার ব্যাপারে আন্দোলনে নামতে পারে।
এমসি কলেজের ঐতিহ্য সারা পৃথিবীতে যেভাবে ছড়িয়ে আছে তা নষ্ট করার জন্য পশুর হাট বসানো হচ্ছে বলে মনে করেন কলেজের প্রাক্তন ছাত্র সিলেট জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এমাদ উল্লাহ শহীদুল ইসলাম শাহীন।
তিনি বলেন, এমসি কলেজের ঐতিহ্য সম্পর্কে পৃথিবীর যেকোন মানুষকে বলতে হয়না। তারা জানে এই কলেজের ঐতিহ্য সম্পর্কে। কলেজের পূর্ণতা বলতে গেলে সব কিছুই মিলিয়ে পূর্ণতা। এর মধ্যে কলেজের মাঠ হলো অন্যতম। আর সেই মাঠে পশুর হাট যা আমাদের জন্য লজ্জার বিষয়। পশুর হাট বসালে মাঠের পরিবেশ পূর্ণ রূপে আর ফিরানো যাবেনা উল্টো এই মাঠটি বাণিজ্যিক মাঠে রূপান্তরিত হবে।
তিনি আরও বলেন, আমার দাদা ও বাবা এই কলেজে পড়াশুনা করেছেন। এই কলেজটি আমাদেরকে অনেক দিয়েছে। এই মাঠে খেলাধুলা করে অনেকেই আজ উচ্চস্থানে রয়েছে। এমনকি বর্তমানে এই মাঠটিতে প্রতিদিন দুপুর থেকে সিলেটের বিভিন্নস্থান থেকে এসে অনেকেই খেলাধুলা করেন। পশুর হাট বসলে ঐতিহ্য হারানোর পাশাপাশি খেলধুলারও পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাবে।
এদিকে, সিলেটের ঐতিহ্যবাহী এমসি কলেজের খেলার মাঠে কোরবানির পশুর হাট না বসানোর আহ্বান জানিয়েছে প্রগতিশীল ছাত্র জোট সিলেট জেলা। শুক্রবার (১৭ জুলাই) সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট সিলেট নগর শাখার সভাপতি সঞ্জয় কান্ত দাস ও সাধারণ সম্পাদক সাদিয়া নোশিন তাসনিম, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন সিলেট জেলার সভাপতি সরোজ কান্তি ও সাধারণ সম্পাদক নাবিল এইচ এবং সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্ট সিলেট মহানগের সভাপতি সঞ্জয় শর্মা ও সাধারণ সম্পাদক সুব্রত বসু চৌধুরী এক যৌথ বিবৃতিতে এই আহ্বান জানান।
নেতৃবৃন্দ বলেন, ‘সিলেটের ঐতিহ্যবাহী বিদ্যাপীঠ এমসি কলেজের খেলার মাঠে কোরবানির পশুর হাট বসানোর অনুমতি দিয়েছে প্রশাসন। আমরা মনে করি, প্রশাসনের এ সিদ্ধান্ত বর্তমান করোনাকালীন পরিস্থিতি ও এমসি কলেজের শিক্ষা পরিস্থিতির জন্য আত্মঘাতী। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে সিলেট শহরের মধ্যে অবস্থিত এমসির মাঠে পশুর হাট বসলে সংক্রমন ভয়াবহ মাত্রায় বেড়ে যাবে। পশুর হাটের যে আয়োজন থাকে,সেখানে কোন ভাবেই সমাজিক দুরত্ব রক্ষা করা কোন ভাবেই সম্ভব নয়। আবার বর্তমানে যে হারে শিক্ষাবাণিজ্যের প্রসার ঘটছে,তাতে এই হাট ভবিষ্যতে এমসি কলেজের মাঠ বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ব্যবহারের জন্যে দুয়ার উন্মুক্ত করবে।
ইতোমধ্যে শাহী ঈদগাহে অবস্থিত সদর উপজেলার খেলার মাটি বানিজ্য মেলাসহ নানা বাণিজ্যিক কার্মকান্ডে সারা বছর ব্যস্ত রাখা হয়। এমতাবস্থায় পূর্বেও বিভিন্ন সময় বাণিজ্যিক ভিত্তিতে এমসি কলেজের মাঠ ব্যবহার করার তৎপরতা আমরা লক্ষ্য করেছি। এমসি কলেজ শিক্ষার্থীসহ সিলেট শহরের ছাত্র-যুবাদের খেলাধূলার একমাত্র স্থান এই মাট পশুর হাটসহ অন্যান্য কার্যক্রমে ব্যবহারের অনুমতি দিলে সিলেটে ছাত্র যুবকদের খেলাধূলার স্থান একেবারেই বন্ধ করে দেয়া হবে। যা সামাজিক-সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় নিয়ে আসবে।’
জানা যায়, জেলা প্রশাসনের অনুমতি সাপেক্ষে কাজির বাজারস্থ স্থায়ী পশুর হাট ছাড়াও হাট বসবে এমসি কলেজ মাঠ ও দক্ষিণ সুরমার পারাইরচকস্থ কেন্দ্রীয় ট্রাক টার্মিনাল। তবে পশুর হাট বসানো কথাছিলো সিলেট সরকারি আলিয়া মাদরাসা মাঠেও। এমসি কলেজ মাঠ ও কেন্দ্রীয় ট্রাক টার্মিনালের ব্যাপারে কোনো আপত্তি না উঠলেও সিলেট আলিয়া মাদরাসা মাঠে পশুর হাট বসানো নিয়ে আপত্তি উঠে। এমনকি আন্দোলনের হুকমিতে সিটি করপোরেশন বাধ্য হয়ে আলিয়ার মাঠ থেকে পশুর হাট বসানো সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে।
সিলেট জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক ফেরদৌস চৌধুরী রুহেল বলেন, আসলে খেলার মাঠে মেলা কোনভাবেই কাম্য নয়। এটা অত্যান্ত দুঃখজনক ও অপমানজনক। এমনিতেই সিলেটে খেলার মাঠ হাতে গোনা কয়েকটি আর এমসি কলেজের মাঠে সিলেটের বিভিন্নস্থান থেকে এসে খেলোয়াড়রা খেলাধুলা করেন। এছাড়া এই মাঠে প্রায় ১০-১৫ টিম একই সাথে ফুটবল ও ক্রিকেট খেলাতে পারে। খেলার মাঠে যদি পশুর হাট বসানো হয় তাহলে এই ঐতিহ্যবাহী মাঠটি আর পূর্বের অবস্থা নিয়ে আসা কোনভাবেই সম্ভব নয়।
পূর্বে এমসি কলেজের মাঠে দুবার মেলা করে মাঠটি নষ্ট করা হয়েছিলো জানিয়ে সিলেট বিভাগীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ম্যানেজার আলী ওয়াসিকুজ্জামান চৌধুরী অনি বলেন, এমসি কলেজের মাঠটি দুবার মেলা হওয়ার পূর্ব খুবই চমৎকার ছিলো। এমনকি ওইসময় মাঠে যাতে পানি না জমে কাঁদা না হয় সেজন্য মাঠের মধ্যেস্থান থেকে শুরু করে আশপাশে ড্রেনেজ ব্যবস্থা ছিলো। কিন্তু মেলার সময় ওই ড্রেনেজ ব্যবস্থা ভরাট করা হয়। এখনও পর্যন্ত সেই মেলার খেসারত দিয়ে যাচ্ছে মাঠটি। মাঠে খেলতে গেলে মাটির নীচ থেকে ইট-পাথর বেরিয়ে আসে।
তিনি জানান, বাংলাদেশের মধ্যে বিশাল জায়গা নিয়ে রয়েছে সিলেটের এমসি কলেজের মাঠ। কিন্তু এবার মাঠে পশুর হাট বসানো যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে তা ক্রীড়াপ্রেমিদের জন্য অপমানজনক ও সিলেটের জন্য দুঃজনক। এই মাঠে একসময় খেলাধুলা আজ অনেকেই জাতীয় দলসহ বিভিন্ন লীগে খেলাধুলা করে সুনাম অর্জন করেছেন। যদি খেলার মাঠে পশুর হাট দেয়া একান্ত জরুরী হয় তাহলে পুরো মাঠে পশুর হাট না বসিয়ে অর্ধেক মাঠে পশুর হাট বসানোর জন্য তিনি পরামর্শ দেন।
সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলিম তুষার জানান, এমসি কলেজের মাঠে এবার যে পশুর হাট বসানো হচ্ছে প্রশাসনের সিদ্ধান্তে। কলেজ মাঠে পশুর হাট বসানো যথাথ সিদ্ধান্ত নয় বলে আমি মনেকরি। যদি হাট বসাতেই হয় তাহলে অন্যত্র জায়গায় যাওয়া ভালো। আর না হয় হাটের প্রভাব পড়বে শিক্ষার্থী, খেলোয়াড়দের উপর।
প্রতিনিধি