চৌকি আদালতে প্রান্তিক জনগণের হাস্যোজ্জ্বল মুখঃ (Smiling faces of marginalized people in the Chowki court)
গৃহকর্মী ফেলানী একদিন হঠাৎ টিভিতে একটি বিজ্ঞাপন দেখে জানতে পারেন, ‘সরকার গরিবের মামলার ভার বহন করবে।’ ফেলানী নিজেই মামলা সংক্রান্ত জটিলতায় ভুগছিলেন। টিভির বিজ্ঞাপনে প্রচারিত কিছু মোবাইল নম্বর তিনি দেখতে পান। এরপর সে নম্বরে ফোন করে আইনি সহায়তা নিয়ে ফেলানী কারাগারে বন্দি তার ভ্যানচালক স্বামীকে জামিনে মুক্ত করেন। চুরির মামলায় তাকে এক মাসের বেশি সময় আটকে রাখা হয়েছিল। হাজতবাস শেষে জামিনে মুক্ত হন ভ্যানচালক ফেলানীর স্বামী।
ভাবছেন যে এটি কোনো নাটকের অংশ। না এটি কোনো নাটক নয়। এটি ফেলানীর জীবনের একটি বাস্তব ঘটনা। আরো অসংখ্য ফেলানীর গল্প আছে যা সচরাচর আমরা জানতে পারি না।
আজকাল আমাদের দেশে ফেলানীর মতো এরকম অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল, সুবিধাবঞ্চিত প্রান্তিক জনগণ, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, দুর্বল নারী ও শিশু এবং অশিক্ষিত ব্যক্তিরা এভাবেই বিনা খরচে বিচার পাচ্ছেন। কিন্তু কিভাবে? হুম তা সম্ভব হচ্ছে চৌকি আদালত এর মাধ্যমে। সারাদেশে নিয়মিত আদালত ছাড়াও এক ধরণের আদালত রয়েছে যাকে চৌকি আদালত বলা হয়। দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে তোলা চৌকি আদালতের মাধ্যমে আইনি সহায়তা দিয়ে এমন অনেক ফেলানীর মুখে এভাবেই হাসি ফোটাচ্ছে সরকার। চৌকি মামলায় তালিকাভুক্ত হয়ে আছেন ফরিদপুরের ভাঙ্গা উপজেলার কাউলিপাড়া ইউনিয়নের পল্লী বেড়া গ্রামের আলেয়া বেগম ও তার ছেলে ইস্তফা শেখের মতো আরও অনেকে। তাদের জমিজমা জোরপূর্বক দলিল করে নিয়েছেন কামারকান্দার বাসিন্দা আবদুস সালাম ছাত্তার মুন্সী। এ ক্ষেত্রেও নিঃসন্দেহে সত্যেরই জয় হবে।
মূলত এই চৌকি আদালত গুলো উপজেলা বা থানা শহরে অবস্থিত। দেশে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ করে যেসব উপজেলা থেকে জেলা শহরে যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই কষ্টসাধ্য, সেসব উপজেলায় চৌকি আদালত দেখা যায়। যারা জেলা সদরে যেতে পারেন না, সে সব গরিব ও অসামর্থ্য মানুষের জন্য উপজেলা বা থানা পর্যায়ে চৌকি আদালত রয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এসব আদালতের কার্যক্রম চলছে। এ আদালত প্রান্তিক জনগণের জন্য বড় ধরনের কাজ করছে।
আসুন এবার একটু বিশদ আলোচনা করি চৌকি আদালত কি এটা নিয়ে?
বৃটিশ শাসনামলে ওয়ারেন হেস্টিংস এর সময়কার কথা। ঐ সময় অর্থাৎ ১৭৯৩ সালে এপার বাংলায় চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালু হওয়ার পর জমিদাররা খাজনার জন্য গরীব প্রজাদের উপর নির্মম নির্যাতন চালাতো। কখনো কখনো খরা, বৃষ্টি, জলোচ্ছাস ইত্যাদি কারণে ফসল উৎপাদন কম হলে প্রজাদের পক্ষে খাজনা দেওয়া সম্ভব হতো না।
ফলে জমিদাররা নির্মমভাবে অত্যাচার করে প্রজাদেরকে শাস্তি দিতো। জমিদারদের এমন অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে কিংবা ভয়ে প্রজারা এক জমিদারের এলাকা ছেড়ে অন্য জমিদারের এলাকায় পালিয়ে যেতো। জমিদাররা যেহেতু খাজনা আদায় করতে পারতো না তাই তারা বৃটিশ সরকারকেও খাজনা দিতে পারতো না। আর এ সময় প্রজাদেরকে জমির স্থায়ী মালিকানা দেওয়া হতো না।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ব্রিটিশ সরকার ১৮৮০ সালের দিকে ভূমি আইন সংশোধন করে প্রজাদের জমির মালিকানা দেয় এবং খাজনা আদায়ের বিধান প্রবর্তন করে। তবে কোনো প্রজা যদি খাজনা দিতে না পারতো তবে তাকে জমি থেকে উচ্ছেদ করা হতো না। বরং খাজনা আদায়ের জন্য মামলা করার বিধান চালু করা হয়। আর খাজনা সংক্রান্ত মামলা পরিচালনার জন্য প্রত্যন্ত এলাকায় অঞ্চল ভিত্তিক যে ধরণের আদালত স্থাপন করা হয় সেটিই চৌকি আদালত নামে পরিচিত।
In fact, বৃটিশ আমলে চৌকি আদালত ছিল মোট ১৪ টি। এরপর সাবেক রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের আমলে আইনি সেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে সকল উপজেলায় আদালত স্থাপন করা হয়। কিন্তু ১৯৯১ সালে আবার উপজেলা থেকে আদালত সরিয়ে জেলা শহরে স্থানান্তর করা হয়। ব্রিটিশ আমল ছাড়াও পরবর্তীকালে যেসব উপজেলা থেকে জেলা শহরে যোগাযোগ ব্যবস্থা কষ্টসাধ্য সেসব প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্থাপিত আদালতগুলো রেখে দেওয়া হয়। এসব আদালতই আজ ‘চৌকি আদালত’ নামে পরিচিত।
However, দেশের বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত গড়ে উঠেছে ৪৩টি চৌকি আদালত। সর্বোচ্চ চার লাখ টাকার এখতিয়ারের দেওয়ানি মামলাগুলো পরিচালনা করা হয় এই আদালতে। সাধারণত অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল, সুবিধাবঞ্চিত, প্রান্তিক জনগণ, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, দুর্বল নারী ও শিশু এবং অশিক্ষিত ব্যক্তিরা এসব চৌকি আদালত থেকে বিনা খরচে বিচার পান।
এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল সৈয়দ আমিনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘যারা জেলা সদরে যেতে পারেন না, সে সব গরিব ও অসামর্থ্য মানুষের জন্য উপজেলা বা থানা পর্যায়ে চৌকি আদালত রয়েছে। ব্রিটিশ আমল থেকেই এসব আদালতের কার্যক্রম চলছে। এ আদালত প্রান্তিক জনগণের জন্য বড় ধরনের কাজ করছে। চৌকি আদালতের পরিধি আরও বাড়ানো দরকার।’
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার পরিচালক (সিনিয়র জেলা জজ) মালিক আবদুল্লাহ আল আমিন সমকালকে বলেন, ‘দেশের বিভিন্ন এলাকার চৌকি আদালতে বিচারকদের বাসস্থান, জনবলসহ অন্যান্য অবকাঠামো সংকট রয়েছে। পর্যায়ক্রমে তা নিরসন করা হচ্ছে।’
প্রবিধানমালায় যা আছে :২০১৬ খ্রিঃ এর ফেব্রুয়ারি মাসের সংসদ অধিবেশনে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা (চৌকি আদালতের বিশেষ কমিটি গঠন, দায়িত্ব, কার্যাবলি, ইত্যাদি) প্রবিধানমালা, ২০১৬ পাস হয়েছিল। আইনে বলা হয়েছে, এই আইনের তিন অনুচ্ছেদের ১ ও ২ নম্বর ধারা অনুযায়ী সরকারিভাবে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা গড়ে উঠেছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য হলো, এ আইনের প্রয়োগ ও রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা।
আইনে আরও বলা হয়েছে, চৌকি আদালতের প্রধান থাকবেন একজন সিনিয়র সহকারী জজ। তার নেতৃত্বে ১৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি বিশেষ কমিটি কাজ করবে। প্রত্যেক চৌকি আদালতের জন্য জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার একটি বিশেষ কমিটি থাকবে। যার কাজ হচ্ছে আইনগত সহায়তা প্রদান নীতিমালা, ২০১৪ অনুসারে আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন এবং আর্থ-সামাজিক কারণে বিচারপ্রাপ্তিতে অসমর্থ বিচারপ্রার্থীদের দরখাস্ত বিবেচনা করে যতদূর সম্ভব আইনগত সহায়তা দেওয়া।
সারাদেশে দুই ধরনের যে ৪৩টি চৌকি আদালত রয়েছে এগুলো হলো- ফৌজদারি ও দেওয়ানি উভয় আদালত। ২৫টি ফৌজদারি আদালত হচ্ছে- দুর্গাপুর, সন্দ্বীপ, বাঁশখালী, পটিয়া, লামা, মহেশখালী, চকরিয়া, কুতুবদিয়া, হাতিয়া, জকিগঞ্জ, আজমিরীগঞ্জ, বড়লেখা, ধর্মপাশা, কয়রা, পাইকগাছা, মঠবাড়িয়া, মনপুরা, চরফ্যাশন, মীর্জাগঞ্জ, কলাপাড়া, দশমিনা, গলাচিপা, আমতলী, পাথরঘাটা ও শাহজাদপুর।
১৮টি দেওয়ানি আদালত হচ্ছে- দুর্গাপুর, সন্দ্বীপ, পটিয়া, রাউজান, সাতকানিয়া, ফটিকছড়ি, রাঙ্গুনিয়া, চরফ্যাশন, হাতিয়া, শাহজাদপুর, নবীনগর, বাজিতপুর, চিকনদী, কয়রা, পাইকগাছা, ভাঙ্গা, ঈশ্বরগঞ্জ ও গোবিন্দগঞ্জ।
আইন সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ সংশোধিত হওয়ার পর চৌকি আদালত পর্যায়ের প্রথম আইনি সহায়তা দিতে বিশেষ কমিটি স্থাপন হয় ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা উপজেলায়। তবে সদরপুর ও নগরকান্দার জনগণও এ সুবিধার আওতায় আসে। অর্থের অভাবে, অজ্ঞানতায় যেন আইনের বৈষম্য তৈরি না হয় সে কারণে তৃণমূল পর্যায়ের ধর্ম, বর্ণ, পেশা নির্বিশেষে সব মানুষকে আইনি সহায়তা দিতে গঠন করা হয় জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান (Legal Aid)।লিগ্যাল এইড আইন অনুযায়ী চৌকি আদালতকে সহযোগিতা করছে একাধিক বেসরকারি আইনগত সংস্থা। নেত্রকোনার কলমাকান্দা এবং দুর্গাপুর উপজেলায় গত বছরের জুন মাস থেকে এ বছরের মে মাস পর্যন্ত লিগ্যাল এইডে ১৬টি পারিবারিক, ১৫টি ফৌজদারি, ৬টি দেওয়ানি ও ৩টি নারী-শিশু মামলা নেওয়া হয়েছে।
আইনজ্ঞদের মতে, দ্রুত দেশের সব এলাকায় চৌকি আদালত স্থাপন, আদালত পর্যায়ের কমিটির নিজস্ব তহবিলের ব্যবস্থা, মাঠ পর্যায়ে প্রচার বাড়ানো, স্কুলের পাঠ্যবইয়ে বিষয়টি সম্পৃক্ত করা ও নিযুক্ত প্যারা লিগ্যালের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাহলে আর্থিকভাবে অসচ্ছল, সহায়-সম্বলহীন মানুষেরা আরো ভালোভাবে সুবিচার প্রাপ্ত হবে। আর জেলা আদালতগুলোতে মামলা জটও অনেক কমে যাবে।
লেখিকা – আয়েশা সিদ্দিকা লোপা
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী
বার্তা বিভাগ প্রধান