( Depression results in Self-murder: What is the way of Salvation?)
পবিত্র কোরআন শরীফে একটি আয়াত আছেঃ
“কুল্লু নাফসিন জায়িকাতুল মউত” অর্থাৎ
প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে।
তবুও মানুষ মৃত্যুকে বড় ভয় পায়…সব প্রাণীর মতোই, আবার অন্যান্য প্রাণীর চেয়ে বেশি। সম্ভাব্য মৃত্যুর আগমন-মুহূর্তে পালিয়ে বা লড়াই করে বেঁচে থাকার চেষ্টা জীবমাত্রেরই প্রতিবর্ত প্রেরণা। অবচেতনের এই মৃত্যুভয় জীবের সহজাত। মৃত্যুর এ নিশ্চয়তা মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে নানাভাবে।
But the strange matter is that সেই মানুষই আবার মৃত্যুকে বেছে নেয়, অকালে। ডেকে নেয় অনাগত মৃত্যুকে। মৃত্যুকে তখন মানুষের চোখে মনে হয় ব্যক্তিগত সময়ের সমাপ্তি, ভালো-মন্দ সবকিছুর অবসান। আনন্দ, প্রিয়জন-সান্নিধ্য, জীবনভোগের অবসান হিসেবে তা যেমন ভীতিপ্রদ, তেমনই চরম দুঃখ-যন্ত্রণা, দারুণ সিদ্ধান্তহীনতা, হতাশা-ব্যর্থতার মুহূর্তে মনে হতে পারে মৃত্যুই সমস্যার সহজ সমাধান। মানুষের এ এক অভূতপূর্ব সংকট। মানব জীবনের অর্থ বা অর্থহীনতার সঙ্গে বিষণ্ণতা ও আত্মহনন তাই নিবিড়ভাবে জড়িত।
Infact, প্রতিটি মানুষের উপলব্ধি, আবেগ-অনুভূতি এর প্রকাশ এবং তা সামলানোর প্রক্রিয়াও ভিন্ন। মনোঃকষ্ট, হতাশা ও বিষণ্ণতা প্রায় প্রত্যেক মানুষের জীবনে স্বাভাবিক ঘটনা, তবে মাত্রা ভেদে তা ভিন্ন। জীবনের কোনো না কোনো সময়, কোনো না কোনো কারণে মানুষ হতাশাগ্রস্ততায় আক্রান্ত হতে পারে। দীর্ঘদিন কেউ মর্মপীড়া, বিমর্ষ ও বিপর্যস্ত বোধ করলে তা পরবর্তীতে বিষণ্ণতায় রূপ লাভ করে। সোজা কথায়, মনঃকষ্ট ও বিপর্যস্ত অবস্থা হচ্ছে বিষণ্ণতার প্রাথমিক ধাপ। বিষণ্ণতাকে বলা হয় ‘মানসিক ব্যাধি’ (Mental disorder)।
পরিবেশ-পরিস্থিতি ও অবস্থানের কারণে একেক জন একেক কারণে বিমর্ষ হতে পারে। যেমন: শারীরিক-মানসিক অত্যাচার, বিচ্ছেদ, প্রতারণা-বঞ্চনার শিকার, জীবনের লক্ষ্য পূরণে ব্যর্থতা বা অপূর্ণতা, নিয়ন্ত্রিত হওয়া, দীর্ঘ অসুস্থতা, স্বজনের মৃত্যু, অভাব-অনটন, মর্যাদাহানি, হতাশা, অসহায়ত্ব, ভয়-ভীতি ইত্যাদি।
বোধগম্য কারণে আমাদের দেশে মেয়েরা বিষণ্ণতায় বেশি আক্রান্ত হয়, বিশেষ করে বিবাহিত নারীরা। কারণ অধিকাংশ মেয়ে কর্তৃত্ব-নিয়ন্ত্রণ, ভয়, নিপীড়ন, লাঞ্ছনার মধ্যে বড় হয়, বসবাস করে। উপরন্তু ‘মানিয়ে নেওয়ার’ নামে শিশুকাল থেকে মেয়েদের বঞ্চনা ও মানসিক যন্ত্রণা গোপন ও দমন করার দীক্ষা দেওয়া হয়। কেউ কেউ হয়তো সব মানিয়ে নিতে পারে এবং টিকে থাকে। কিন্তু সবার অনুভূতি ও ধারণ ক্ষমতা এক নয়। ফলে অনেকের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন জমাট বাঁধা মনঃকষ্ট, বিপর্যস্ত অবস্থা একসময় বিষণ্ণতায় রূপ ধারণ করে।
যখন একজন ব্যক্তি নিজের অসহায়ত্ব অতিক্রম করার কোনো উপায় খুঁজে পায় না তখন সে হতাশ হয়ে পড়ে। দুই সপ্তাহের অধিক সময় ক্রমাগত হতাশাগ্রস্ততায় মানুষ বিষণ্ণতায় আক্রান্ত হয়। যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে এই বিষাদগ্রস্ততা জীবনকে তিলে তিলে নিঃশেষ করতে থাকে এবং একসময় মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় রূপ নেয়। Mass media এর মাধ্যমে মাঝেমধ্যেই অনেক করুণ পরিণতি সম্পর্কে ইদানিং জানা যায়, যেমন: আত্মহনন অথবা সন্তান হত্যার মতো বেদনাদায়ক ঘটনা।
অনেক সময় কেউ পরিকল্পনা করে আত্মহনন করেন আবার কখনও দেখা যায় হঠাৎই কোনও ঝোঁকের বশে কেউ আত্মহননন করলেন। কোনও কারণে কেউ যদি অবসাদে ভোগেন বা অত্যাচারিত হন, তা হলেও তিনি আত্মঘাতী হতে পারেন। তবে মানসিক অসুস্থতায় আত্মহননের হার অন্য কারণের চেয়ে বেশি: যেমন বিষণ্ণতা, Bipolar mood disorder, স্কিৎজোফ্রেনিয়া, Mental disorder, Mania, Drug Addiction এবং উদ্বেগ।
বহু ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় আশানুরূপ ফল না হলে বা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলে আত্মহননের পথ বেছে নেয়। কারও যদি প্রণয়ের সম্পর্ক ভেঙে যায় তা হলেও তিনি আত্মহত্যাপ্রবণ হতে পারেন। এছাড়াও বাড়িতে কোনো অশান্তির ফলে অপ্রীতিকর বা আকস্মিক কোনো ধাক্কার কারণেও কেউ আত্মহনন করতে পারেন। আবার কেউ একাকিত্বের যন্ত্রণায়, কেউবা ব্যাভিচারের জের ধরে আত্নহননের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সম্প্রতি তরুণ-তরুণীরা Online Games খেলেও আত্মঘাতী হচ্ছে, সেই খবর এখন সংবাদমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে।
However, আত্মহনন কিছুটা ছোঁয়াচেও বটে, যদিও জীবাণুঘটিত রোগ নয়। কেউ আত্মহনন করলে তাঁর ঘনিষ্ঠ পরিসরে অন্যদের আত্মহননের সংখ্যা বেড়ে যায়। কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি আত্মহনন করলে বা গণমাধ্যমে আত্মহননের দৃশ্য বা বিবরণ দেখলেও আত্মহননের চেষ্টা করার সম্ভাবনা বাড়ে। গবেষকেরা একে “suicide contagion” বলে থাকেন। এতে মনে হয়, নির্দিষ্ট শারীরিক, মানসিক বা সামাজিক কারণে কোনো মানুষ যখন ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছেন, তখন একটি আত্মহননের ঘটনা তার সামনে মডেল হয়ে উঠতে পারে এবং তিনি সেই পথটিই বেছে নিতে পারেন।
কামু বলেছিলেন, দার্শনিকের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যদি কিছু থাকে, তবে তা আত্মহনন। আত্নহনন এক ধরণের প্রতিরোধযোগ্য মৃত্যু। তাই তাকে আটকানোর চেষ্টা অবশ্যই করা উচিত। তবে এরকম মৃত্যুর হারও নগণ্য নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুসারে প্রতি বছর ৮ লক্ষ মানুষ আত্মহনন করে প্রাণ দিচ্ছেন। অর্থাৎ প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন নিজের হাতে খুন হচ্ছেন। যতজন এভাবে মারা যাচ্ছেন, তার কুড়ি গুণ মানুষ আসলে আত্মহননের চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন এই পরিসংখ্যান অনুযায়ী। তার মানে প্রতি ২ সেকেন্ডে একজন মানুষ আত্মহননের চেষ্টা করছেন। বেশিরভাগ আত্মহননের ঘটনা ঘটে দরিদ্র বা উন্নয়নশীল দেশগুলোতে। এর মধ্যে ইউরোপের পিছিয়ে পড়া দেশগুলোর মানুষদের আত্মঘাতী হবার সম্ভাবনা প্রবল। উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলিতে ১৫ থেকে ২৫ বছর বয়সের কিশোর-তরুণদের (নারী-পুরুষ মিলিয়ে) মধ্যে আত্মহননের সংখ্যা সর্বাধিক। চরম অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং জীবনের দিশাহীনতা সম্ভবত এর জন্য দায়ী। অল্পবয়সীদের মধ্যে এই ব্যাপক সংখ্যক আত্মহনন বিরাট দুশ্চিন্তার কারণ। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক সংকট যত বাড়ছে, এই সংকটও ততই বাড়ছে।
বাংলাদেশে প্রতি বছর লাখে প্রায় ১২৮ জন ব্যক্তি আত্মহতনন করে এবং প্রায় ২৮১ জন ব্যক্তি তা করার চেষ্টা করে থাকে। আত্মহননে মৃত ব্যক্তিদের প্রায় ৮৯ ভাগ নারী এবং ২১ ভাগ পুরুষ। নারীদের মাঝে অপ্রাপ্তবয়স্ক এবং অবিবাহিত নারীদের সংখ্যাই বেশি। বর্তমানে ভার্চুয়াল লাইফের প্রতি ঝুঁকে পরার কারণে মানুষ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে স্ট্যাটাস দিয়ে যাওয়ার ঘটনা দেখা যাচ্ছে। আত্মহননের পূর্বে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার মাধ্যমে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষটি সামাজের প্রতি তার অভিমানের জানান দিয়ে যায়। দেখুন আমি যখন এই লেখাটি লিখছি, তখন হয়তো আমাদের আশেপাশেই অজস্র সহ-নাগরিক আত্মহননের কথা ভাবছেন, কেউ কেউ পরিকল্পনা করছেন, জোগাড়যন্ত্র করছেন, এমনকি চেষ্টাও। কাল সকালে যাদের মৃত্যু সংবাদ পাওয়া যাবে, তাদের মধ্যে কেউ হয়তো আমার বা আপনার আত্নীয় হতে পারে।
বস্তুত এমন এক পৃথিবীতে, এমন এক সময়ে বাস করছি আমরা, যা অনেককেই আত্মহননে প্ররোচিত করছে। সমস্যা জটিল। একটু গভীরভাবে ভাবলে অবশ্য অনুভূত হবে অন্যান্য মানুষ বা সমাজ, রাষ্ট্র, পরিস্থিতির চাপ ইত্যাদি থেকে বাঁচানো, প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করার ক্ষমতা বাড়ানো তথা লড়াইয়ের সময়ে তাদের পাশে থাকার প্রয়োজন। পার্থিব শরীরে শেষ আঘাতটি করেন আত্মহননকারী নিজেই, কিন্তু তিলে তিলে অথবা সহসা ঝটকায় তার বাঁচার ক্ষমতাকে মেরে ফেলে পরিস্থিতি।
দুঃখজনকভাবে সারা বিশ্বেই বিষণ্ণতা ও আত্নহনন নিয়ে নেতিবাচক মনোভাব বা স্টিগমা (Stigma) বিদ্যমান। কিন্তু আমাদের দেশে এর উপস্থিতি কখনও কখনও ভয়ানক নির্মম। নারী, পুরুষ, শ্রেণি/সামাজিক অবস্থান নির্বিশেষে সবাই এর শিকার। সব ক্ষেত্রেই মানসিক ব্যাধিকে ‘সহ্য করার’ বা লুকানোর দীক্ষা দেওয়া হয়।
নারীর কথা উপরে উল্লেখ করেছি। আমাদের সমাজে আমরা পুরুষকে কঠোর মানসিকতায় দেখতে অভ্যস্ত এবং সেভাবেই তাদের লালন-পালন করা হয়। যেমন: বাচ্চা ছেলেকেও শেখানো হয় ‘ছেলেদের কাঁদতে নেই’, ‘মেয়েদের মতো কান্না ছেলেদের মানায় না’ ইত্যাদি। ফলে অধিকাংশ সময় ছেলেরা মানসিক কষ্ট প্রকাশ করা দুর্বলতা মনে করে তা দমন করে। তাছাড়া নারী-পুরুষ নির্বিশেষে শিক্ষিত, সামাজিক অবস্থানে অধিষ্ঠিত কারো মনঃকষ্ট তুচ্ছ করে দেখার প্রচলন বিদ্যমান। যেমন: ‘এত আবেগী হওয়া তোমাকে মানায় না’, ‘ঢং করছ’, ‘পাগলামি রাখ’ ইত্যাদি।
ভুক্তভোগীর অনুভূতি তাচ্ছিল্য করা, হাসি-তামাশা, কটূক্তি করার প্রবণতা যেন সাধারণ ব্যাপার। এসব কারণে অনেকে নিজের মানসিক ব্যাধি বুঝতে পারলেও তা প্রকাশ করেন না, নিরাময়ের জন্য সঠিক ব্যবস্থাও নেন না। প্রকৃতপক্ষে আবেগ-অনুভূতির কোনো লিঙ্গ, জাত-পাত, শ্রেণি নেই। এর একটি অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে চিত্র নায়িকা অপু বিশ্বাসের আবেগময় টিভি সাক্ষাৎকার।
তবে অনেকেই অপুর মতো নিজের আবেগ প্রকাশ করতে পারে না। প্রচলিত নেতিবাচক ধারণা, ‘পাছে লোকে কিছু বলে’র ভয়ে, দ্বিধায় অনেকে মানসিক ক্ষত বয়ে বেড়ায়। এছাড়া অনেক ভুক্তভোগী তাদের বিপর্যস্ত অবস্থা এবং ভেতরের গভীর ক্ষত লুকিয়ে রাখার জন্য বেশি বেশি ভালো থাকার ভান করে। যার ফলে অন্যরা তাদের অস্বাভাবিকতা অনুধাবন করতে পারে না। এ ধরনের বিষণ্ণতাকে Psychiatry and Human Behaviour and Medicine এর ক্লিনিক্যাল অধ্যাপক Carol Landau ‘উচ্চ ক্রিয়াশীল বিষন্নতা’ (High-Functioning Depression) হিসেবে অবিহিত করেছেন।
High Functioning Depression এর যথাযথ উদাহরণ হচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়াত শিক্ষক আকতার জাহান এবং প্রয়াত মাহবুবুল হক শাকিল। এ দুজনের ক্ষেত্রেই, তাদের অন্তঃক্ষরণ বাইরে থেকে কেউ অনুমান করতে পারেনি। এই দুজনের মানসিক ব্যাধি শেষ পর্যন্ত তাঁদের আত্মহননের দিকে ঠেলে দিয়েছে।
আসলে মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে তুলনা করা হয় সমুদ্রে ভাসমান বরফখণ্ড বা হিমশৈলের (ice berg) সঙ্গে। আমরা ভাসমান অংশটাই কেবল দেখতে পাই, কিন্তু পানির নিচে বরফখণ্ডটা কত বড় এবং কত গভীরে প্রথিত তা অনুমান করা যায় না। একইভাবে কোনো ব্যক্তির মনোজগতে প্রকৃতপক্ষে কি হচ্ছে, তা অনুধাবন করা কঠিন। তাই কারো আবেগ-অনুভূতি, বিমর্ষ অবস্থা তুচ্ছ করে দেখা মানে সেই ব্যক্তিকে সাহায্য না করা। অথচ একজন বিপর্যস্ত, বিষণ্ণ মানুষের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সহানুভূতি ও সহযোগিতা।
এই তথ্যগুলো থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে আত্মহননের কারণ হিসেবে সামাজিক বা অর্থনৈতিক বাস্তবতাগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ নানাবিধ মানসিক ব্যাধি আত্মহননের গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলেও একমাত্র কারণ কখনোই নয়। অতএব শুধুমাত্র মনোরোগ চিকিৎসার ওষুধ প্রয়োগ করে সব আত্মহত্যা প্রতিরোধ করার ভাবনা অবৈজ্ঞানিক। মধ্য যৌবনে চাকরি হারিয়ে সপরিবারে পথে বসতে চলেছেন যিনি, যৌবনের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কর্মজগতের ভয়াবহ সংকট দেখে সহসা স্তম্ভিত যে তাদের সমস্যা গোড়া থেকে সারাতে পারে কোন ওষুধ? যে মেয়েটির শ্বশুরবাড়ি পণের দাবিতে অথবা বংশমর্যাদার অহংকারে নিয়ত অপমান অত্যাচারে তাকে ঠেলে দিচ্ছে আত্মহননের দিকে, তাকে বাঁচাতে গেলে শুধু কি তার চিকিৎসাই যথেষ্ট? নাকি আরো বেশি করে চিকিৎসা প্রয়োজন সেই শ্বশুরালয়ের আদি মানসিকতার বাসিন্দাদের? সেই চিকিৎসা কি ওষুধ না সুশিক্ষা? চিকিৎসা করবেন কি চিকিৎসক একা, নাকি আমি-আপনি সকলে মিলে?
মোদ্দাকথা বৃহৎ ও ক্ষুদ্র পরিসরে বহু মানুষের আত্মহনন রুখতে গেলে আন্তরিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড অত্যাবশ্যক। কিভাবে সে পথে আমরা এগোতে পারি, তা স্বতন্ত্র আলোচনার বিষয়। প্যারাসিটামল দিয়ে যেমন জ্বর কমানো হয়, জ্বরের কারণটিকে সারানোর আগে, তেমনিভাবে আশেপাশে ব্যক্তি মানুষকে আত্মহননের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য ছোট ছোট কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে পারি আমরা। নিজের পরিচিত পরিজনদের আরেকটু সময় দিতে পারি আমরা। স্মার্ট ফোন থেকে মুখ তুলে পাশের মানুষটিকে দেখতে পারি। তাদের সঙ্গে কথা বলতে পারি। শুধুমাত্র এটুকুতেই অনেক কিছু হওয়া সম্ভব।
আপনার ঘনিষ্ঠ মহলে কি এমন কেউ আছেন, যাকে ইদানিং বা বহুদিন ধরে দুঃখী মনে হয়? এমন কেউ যিনি মাত্রাতিরিক্ত আতঙ্কিত বা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত? অসম্ভব একলা কোনো মানুষ? অথবা কেউ ক্রমশ নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছেন? ভয়ানক শারীরিক যন্ত্রণা বা দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন কেউ? কর্মহীনতা, কর্মচ্যুতি বা ব্যর্থতার গ্লানিতে ভুগছেন কেউ? অতিরিক্ত দায়িত্বের বোঝা সামলাতে পারছেন না? নেশাগ্রস্ত হয়ে পড়ছেন কোনো পরিচিত? কেউ কি মনে করছেন যে তিনি অপ্রয়োজনীয়, অন্যদের ঘাড়ে বোঝা হয়ে গেছেন? মরে যাবার ইচ্ছে প্রকাশ করছেন কেউ? অন্য মানুষের জন্য নিজের চোখ, কান আর মন খোলা রাখলে সহজেই এদের খুঁজে পাবেন। নিজের উদ্যোগে সরাসরি কথা বলুন এদের সঙ্গে।
তবে এক্ষেত্রে দু’একটা ভ্রান্ত ধারণা পরিষ্কার করা দরকার। অনেকে মনে করেন, যারা আত্মহননের কথা বলেন, তারা আদতে তা করে উঠতে পারেন না। আবার অনেকে মনে করেন, বিষাদগ্রস্ত মানুষকে জিজ্ঞেস করতে নেই আত্মহননের কথা ভাবছেন কিনা, কারণ তাতে নাকি আত্মহননের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দুটো ধারণাই ভুল। কেউ আত্মহননের কথা বললে, গুরুত্ব দিন। তার নিরাপত্তা এবং চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে সাধ্যমতো উদ্যোগী হোন। পরিচিত কারো মধ্যে আত্মহননের ঝুঁকিগুলোর কোনোটা খুঁজে পেলে তার সঙ্গে কথা বলুন। প্রয়োজনে সরাসরি আত্মহননের প্রসঙ্গে আলোচনা করতে পারেন। ধাপেধাপে এগোনো যায় আলোচনা। খুব হতাশ লাগছে কি? খুব অবসাদ বোধ হয়? নিজের ওপর রাগ হয় বা চারপাশের সবার ওপর, অথবা বিশেষ কারো ওপর? নিজের ক্ষতি করতে ইচ্ছে করে? মরে যেতে ইচ্ছে হয় কখনও? আত্মহননের কথা কি মনে এসেছে? আত্মহননের কোনো পদ্ধতিও ভেবেছেন নাকি কখনও? এভাবে এগিয়ে বিষয়টিকে স্পষ্টভাবে চিহ্নিত করে চিকিৎসার ব্যাপারে তৎপর হওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি নিয়মিত তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, কিন্তু সমালোচনা না করা… সহমর্মিতা প্রদর্শন করা, কিন্তু অনুকম্পা না দেখানো এগুলোও জরুরি।
প্রতিদিন যেমন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নানা রকম নিয়ম রক্ষা করা হয়। তেমনি মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিয়মিত পরিচর্যা অপরিহার্য করে নিতে হবে।
* মানসিক ব্যাধির কারণ বা ট্রিগার (trigger) চিহ্নিত করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া এবং টিকে থাকার কৌশল রপ্ত করতে হবে।
* খুব আপন জনের মনের ভেতর ভাঙ্গন শুরু হয়েছে, একটুখানি সচেতনার অভাবে তা আমলে আসছে না। তাই পারিবারিক বন্ধন মজবুত করা আবশ্যক।
* সামান্য অস্বাভাবিকতাকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
* বর্তমানে জটিল আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় উপযুক্ত শিক্ষা প্রশিক্ষণ ও পেশা গ্রহণে ব্যর্থ কিশোর-কিশোরীরা নিজেদের সামঞ্জস্য বিধান করতে না পারার কারণে সামাজিক শোষণ বঞ্চনার শিকার হয়। ফলে তাদের মনে তীব্র হতাশা ও নৈরাশ্য দানা বাঁধে, যা এক পর্যায়ে সমাজের বিরুদ্ধে অসন্তোষ ও আক্রোশে রূপ নেয়। আবার বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট, পত্র-পত্রিকা, ম্যাগাজিন ও Social Media যেমনঃ ফেইসবুক, টুইটার, ইউটিউবের ন্যায় গণমাধ্যমগুলো শিশু-কিশোরদের দারুণভাবে প্রভাবিত করে। উক্ত গণমাধ্যমগুলো ব্যবহারের ক্ষেত্রে অভিভাবকদের যথেষ্ট সচেতন হতে হবে।
অনেকসময় বিভিন্ন পত্র পত্রিকা থেকে জানা যায় মাদকদ্রব্যের প্রতি আসক্ত ব্যক্তি আত্মনিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে এবং তার শারীরিক ও মানসিক বিপর্যয় ঘটার ফলে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতি, পকেটমারা, নারী-শিশু নির্যাতন, সহিংসতা, চাঁদাবাজি, ইত্যাদি বড় বড় সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। যখন এর মাত্রা দ্বিগুন আকার ধারণ করে তখন অনেকে আত্মহননের পথ বেঁচে নেয়। এজন্য আত্মহনন একটি Mental illness। তাই প্রাণ খুলে হাসুন, বুক ভরে নিঃশ্বাস নিন, শত ব্যস্ততার মাঝেও দিনে অন্তত ২০ মিনিট হলেও নিজের জন্য বাঁচুন।
এবার একটু আইনের কথা বলি। আত্মহনন সংক্রান্ত আইনের ইতিহাস কিছুটা বিচিত্র। আব্রাহামিক ধর্মে প্রাণ হল পবিত্র, যে কারণে তাঁরা গর্ভপাতেরও বিরোধিতা করে থাকেন (যদিও ধর্মযুদ্ধে বহু নরহত্যা করেছেন)। একই ধর্মীয় যুক্তিতে তাঁরা মনে করেন আত্মহত্যা হল ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অপরাধ। এই কারণে পাশ্চাত্য আইনে আত্মহননের চেষ্টা ছিল শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ব্রিটিশ ঐতিহ্যের ভারতীয় Penal Code এও তাই ছিল। বাংলাদেশ দন্ডবিধি ধারা ৩০৬ মোতাবেক, আত্মহত্যায় প্ররোচনাকারীর জন্য সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদন্ডের বিধান রয়েছে এবং দন্ডবিধি ৩০৯ মোতাবেক, আত্মহত্যার চেষ্টাকারীর এক বছর কারাদন্ডের বিধান রয়েছে। এখানে আত্মহত্যার প্রচেষ্টাকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করে তার জন্য শাস্তির বর্ননা দেওয়া হয়েছে। কেউ আত্মহত্যার চেষ্টা করলে বা আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে স্বীয় শরীরের উপর কোন ধরনের আঘাত করলে তাকে পেনাল কোড ৩০৯ ধারা অনুসারে ১ বছর কারাদন্ডে দন্ডিত করা হবে। এছাড়া পেনাল কোড ৩০৬ ধারায় প্রাপ্তবয়স্ক মানুষকে আত্মহত্যায় সহায়তা বা প্ররোচনা করার শাস্তির কথা বলা হয়েছে। কেউ আত্মহত্যার প্ররোচনা দিলে সে ব্যাক্তি আত্মহত্যা করে মৃত্যুবরণ করলে, প্ররোচনা দানকারীর শাস্তি পেনাল কোড ৩০৬ ধারা মোতাবেক ১০ বছরের কারাদন্ড এবং জরিমানায় দন্ডিত করা হবে। তাছাড়া আত্মহত্যা চেষ্টাকারী যদি মৃত্যুবরণ না করে তাহলে প্ররোচনা দানকারীকে ১ বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত করা যেতে পারে।
মূলত সৃষ্টিকর্তা মানুষকে মরণশীল হিসেবেই সৃষ্টি করেছেন। মানুষের মৃত্যু ঘটানোর কাজটি একমাত্র সৃষ্টিকর্তার। অতএব কেউ যদি কাজটি নিজের হাতে তুলে নেন, নিজেই নিজের মৃত্যু ঘটান তবে তিনি অনধিকার চর্চাই করবেন। সৃষ্টিকর্তা তা পছন্দ করেন না। কেউই অনধিকার চর্চা প্রত্যাশা করে না।
ইসলাম ধর্মে আত্মহনন তো দূরে থাক, মৃত্যু কামনাও বৈধ নয়, কোনো বিপদে পড়ে বা জীবন যন্ত্রনায় কাতর হয়ে নিজের মৃত্যু কামনা করা পর্যন্ত নিষিদ্ধ ।এখানে আত্নহননকে মহাপাপ বলে গণ্য করা হয়েছে। কাজেই এ থেকে বিরত থাকতে হবে, কারণ এর পরিণাম কঠোর ও যন্ত্রণাদায়ক শাস্তি রয়েছে পরকালে। এ থেকে বাঁচতে হলে মানুষকে ইসলামের অনুশাসন ও প্রেরণা অনুসরণ করতে হবে। শত হতাশা ও দুঃখ সত্ত্বেও আল্লাহ সুবহানুওয়া তায়ালার ওপর ঈমান-আস্থা-ভরসাই তাকে রক্ষা করবে।
পরিশেষে এটাই বলবো যে, Self-love মানে নিজের সঠিক যত্ন যেমনঃ সময়মতো সঠিক আহার, ঘুম ও শারীরিক ক্রিয়া মানসিক ব্যাধি থেকে দূরে থাকতে সাহায্য করে। এছাড়া নিজের পছন্দের কাজ করা, নতুন কিছু করা, প্রতিদিন মুক্ত বাতাসে হাঁটাচলা, সহমর্মী বন্ধু তৈরি করা, একান্ত বিশ্বস্ত কারো সঙ্গে মানসিক অবস্থা শেয়ার করা, সঠিক সাহায্য সন্ধান করা, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিসম্পন্ন মানুষ থেকে দূরে থাকা ইত্যাদির মাধ্যমেও নিজের মনকে হালকা করা যেতে পারে যা আত্নহননের মত সিদ্ধান্ত থেকে একজন মানুষকে বের করে নিয়ে আসতে পারে।
লেখিকা – আয়েশা সিদ্দিকা লোপা
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী
বার্তা বিভাগ প্রধান