Home » দেশব্যাপী বাড়ছে ধর্ষণঃ দায়ভার আসলে কার?

দেশব্যাপী বাড়ছে ধর্ষণঃ দায়ভার আসলে কার?

দেশব্যাপী বাড়ছে ধর্ষণঃ দায়ভার আসলে কার?

(Rape is increasing nationwide :Who is responsible?)

 

ধর্ষণ নামক ঘাতক শব্দটির সাথে আমরা কমবেশি সবাই পরিচিত। ইদানিং বহুল পরিমাণে ধর্ষণের ঘটনা উঠে আসছে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমগুলোতে। The matter of regret, ২০২০ সালের Pandemic Covid-19 এর মত শক্তিশালী Corona Virus ও দমাতে পারছে না এই ভয়াবহ অপরাধটিকে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের মতো বাংলাদেশেও দিন দিন ধর্ষণ বেড়েই চলছে।
২০১০ খ্রিঃ থেকে ২০১৯ খ্রিঃ পর্যন্ত ধর্ষণের সংখ্যা কত তা উল্লেখ করতে গেলে হয়তো এ নিবন্ধটি পড়ার আগ্রহই হারিয়ে ফেলবে সবাই। তাই পাঠকের সুবিধার্থে কেবল অতি সাম্প্রতিক একটি ঘটনা উল্লেখ করছি।
হিরামনি। আজকের গণমাধ্যমগুলোতে একটি আলোচিত নাম। কিন্তু কেন? গেল শুক্রবার ১২ জুন ২০২০ খ্রিঃ দুপুরে লক্ষ্মীপুরের সদর উপজেলার হামছাদী ইউনিয়নের পশ্চিম গোপীনাথপুর গ্রামে হিরামনি (১৪) নামে নবম শ্রেণির এক ছাত্রীকে বাসগৃহে একলা পেয়ে ধর্ষণের পর শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। মহামারীর এ দুঃসময়ে এমন পৈশাচিক ঘটনা আসলেই কি লজ্জাজনক নয়?
এতো জানালাম, কেবল পুলিশের কাছে রিপোর্ট করা এবং প্রকাশ পাওয়া ধর্ষণ ও হত্যার খবর। কিন্তু বাস্তবে এমন আরও অনেক অনেক ঘটনা চাপা পড়ে রয়েছে। এর কারণ অনেক। অল্প সংখ্যক ভুক্তভোগী ধর্ষণের কথা প্রকাশ করে। বেশিরভাগ মানুষই মান-সম্মানের কথা ভেবে ধর্ষণের খবর প্রকাশ করতে চায় না। এছাড়া দাম্পত্য ধর্ষণের খবর তো বাংলাদেশে কখনই উঠে আসে না। যদি এসব প্রকাশ করা হতো তাহলে হয়তো দেখা যেতো মুহূর্তেই পরিসংখ্যানের হিসাব কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছে।
However, নারী ধর্ষণের কারণ হিসেবে অধিকাংশ মানুষই দায়ী করে নারীর পোশাককে। এক্ষেত্রে ধর্মান্ধতা বা ভূল ধারণা এমন প্রকট আকার ধারণ করেছে যে ধর্ষণ আসলে কী সেটা সঠিকভাবে না জেনেই মানুষ কেবল ইসলাম ধর্ম কর্তৃক দেয়া পর্দার নির্দেশ অমান্য করার দায় দিয়ে ধর্ষণের দোষ চাপাতে চেষ্টা করছে সেই ধর্ষিতা অসহায় নারীর উপরই। কিন্তু আমার জ্ঞান ও সুস্থ বিবেক বরাবরই বলে ধর্ষণের জন্য সম্পূর্ণরূপে পোশাক নয়, মানসিকতা দায়ী। আচ্ছা চলুন, ধর্ষণ কি এবং এর জন্য আসলে দায় কার এ ব্যাপারে কিছু আলোচনা করা যাক।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৬০ সালের দন্ডবিধি, ১৮৭২ সালের সাক্ষ্য আইন, ২০১৪ সালের ডিঅক্সিরাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড (ডিএনএ) আইন এবং ২০০০ সালের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কয়েকটি ধারায় ধর্ষণ ও এর সাজার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট আইনগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, “যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শণ বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন।” একটি বিষয় খেয়াল করুন। এখানে কিন্তু পুরুষ কর্তৃক নারী ধর্ষিত হবার কথা উল্লেখ রয়েছে।
এবার আর একটি বিষয় খেয়াল করুন। দেশি বিদেশি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সূত্রানুসারে ধর্ষণের সংজ্ঞা হলো—-
“ধর্ষণ এক প্রকার যৌন অত্যাচার। সঙ্গী বা সঙ্গিনীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বা অনুমতি ব্যতিরেকে যৌনাঙ্গের মিলন ঘটিয়ে বা না ঘটিয়ে যৌন সঙ্গমে লিপ্ত হওয়াকে ধর্ষণ বলা হয়।”
এই সংজ্ঞা থেকে দুটি বিষয় লক্ষ্য করুন।
ধর্ষণের সংজ্ঞায় উল্লেখ করা হয়েছে ’সঙ্গী বা সঙ্গিনী’ অর্থাৎ শুধুমাত্র নারী নয় বরং নারী কর্তৃক পুরুষ এমনকি সমলিঙ্গের মানুষের মাঝেও ধর্ষণ হয়। বহির্বিশ্বের দিকে তাকালে দেখা যায় সেখানে নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণের ঘটনা অহরহই ঘটে। শুধু বহির্বিশ্বে নয়, সম্প্রতি বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমগুলোতেও নারী কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণের খবর উঠে আসছে। এখন কথা হচ্ছে, নারী কর্তৃক পুরুষ যখন ধর্ষণ হয়, তখন ধর্মান্ধগণ কাকে দোষ দেবেন? পুরুষের পোশাককে নাকি ঐ নারীর মানসিকতাকে? নাকি এখন বলবেন ঐ পুরুষ নিশ্চয়ই Mini Skirt পড়ে ঘুরে বেড়াতো তাই ধর্ষণ হয়েছে। যদি পোশাকই ধর্ষণের জন্য দায়ী হয়ে থাকে, তবে নিশ্চয়ই ধর্ষণ এড়াতে পুরুষকেও বোরখা পড়ে বাইরে বের হতে হবে।

এবার বহির্বিশ্বের একটু উদাহরণ দেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৯% ধর্ষণের ঘটনা ঘটে পুরুষ কর্তৃক পুরুষ ধর্ষণের। একজন পুরুষ আর একজন পুরুষকে ধর্ষণ করে কি কারণে? পোশাকের শালীনতার অভাবে নাকি নোংরা মানসিকতার বদৌলতে? নিঃসন্দেহে নোংরা মানসিকতার জন্যই।
যা হোক, উপরের সংজ্ঞায় উল্লেখ করা হয়েছে, ’ইচ্ছার বিরুদ্ধে, অনুমতি ব্যতিরেকে’ যৌনকর্মে লিপ্ত হওয়ার কথা। এখন একটু গভীরভাবে ভাবুন, অনুমতি বা ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনতা কি শুধু রাস্তাঘাটে বখাটে দ্বারাই ঘটে নাকি ইচ্ছার বিরুদ্ধে যৌনতা আপনার-আমার ঘরেও ঘটে?
আর একটু Details এ বলি। বাংলাদেশে Arrange Marriage ব্যবস্থাটা যুগ যুগ ধরেই চলে আসছে। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যেখানে বাবা-মায়ের চাপে পড়ে বহু নারী নিজের প্রেমিককে নিয়ে দেখা হাজার স্বপ্নগুলো মাটি চাপা দিয়ে আরেকজনের সাথে সংসার গড়তে বাধ্য হয়। কিংবা অনেক সময় যথেষ্ট সুযোগের অভাবে বিয়ের আগে হবু স্বামীর সাথে তেমন একটা ভালোবাসাময় সম্পর্কও গড়ে ওঠে না। তো স্বভাবতই সেই নারী নতুন একজনের সাথে সম্পর্কের শুরুতেই যৌনকর্মে লিপ্ত হতে চায় না। কিন্তু বিয়ের মাধ্যমে নারীকে নিজ ইচ্ছেমতো ভোগ করার লাইসেন্সের সুবাদে একদল ভোগী পুরুষ প্রথম রাতেই নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার সাথে এক রকম জোর করেই যৌনকর্মে লিপ্ত হয়। আর ভোগী লাইসেন্সের কারণে নারী এর প্রতিবাদও করতে পারে না।
আচ্ছা আপনারা জানেন কি এটাও এক প্রকার ধর্ষণ যার নাম ’দাম্পত্য ধর্ষণ’! এর জন্যও কি পোশাক দায়ী? বাসর রাতেও স্ত্রী কি Mini Skirt পড়ে বসেছিলো বলে ধর্ষণের স্বীকার হয়েছে নাকি স্বামীর ভোগী মানসিকতার কারণে হয়েছে? প্রশ্ন রইলো।তবে কি ধর্ষণ এড়াতে বাসর ঘরে নারীর বোরখা পড়ে থাকা উচিত ছিলো?
Furthermore, সময়ে অসময়ে বহু নারী নিজ আবাসেই এভাবে ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিজের স্বামী কর্তৃক ধর্ষিত হয়, যার খবর আমাদের কাছ পর্যন্ত কখনই পৌঁছায় না। লেখাটি লিখতে লিখতে আমার Suddenly মনে পড়লো একজন মহিলার ঘটনা যা না বললেই নয়। তার সাথে আমার যখন পরিচয় হয়, তখনো আমার দাম্পত্য ধর্ষণের অস্তিত্ব নিয়ে কোন জ্ঞান ছিল না। কিন্তু সে অবলা নারী দাম্পত্য ধর্ষণের বাস্তব শিকার ছিলেন। তার কাছ থেকে জানতে পারি Arrange Marriage এর বদৌলতে কলেজ জীবনে তার বিয়ে হয়ে যায় তার থেকে বয়সে বেশ বড় একজন পুরুষের সাথে। বিয়ের আগে কাছে থেকে সেই পুরুষকে জানার সুযোগ না হওয়া সত্ত্বেও বিয়ের প্রথম রাত থেকেই সে বর্বরতার স্বীকার হতে থাকে। আরও জানতে পারি, তার স্বামীর জন্য সে অনেকটাই যৌনকর্মীর মতো এবং সব থেকে অবাক করা বিষয় ইতিমধ্যে তিন সন্তানের জননী হওয়া সত্ত্বেও সময়ে অসময়ে ইচ্ছের বিরুদ্ধে তার সাথে এমন বর্বরতা এখনো চলে। এখনো কি আপনারা বলবেন ধর্ষণের জন্য মানসিকতা নয়, দায়ী নারীর পোশাক?
পোশাক নাকি মানসিকতা দায়ী, এটি বিচার করতে হলে আরেকটি বিষয় না বললেই নয়।দেখুন, বাংলাদেশে শিশু ধর্ষণের ঘটনা অনেক সময়ই উঠে আসে পত্রিকায়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, আরও বহু দেশে শিশু ধর্ষণ নিত্যদিনের ঘটনা। কিন্তু একটি শিশু ধর্ষিত কেন হয়? শিশুরা Mini Skirt পড়ে থাকে বলে? শিশু বাচ্চাদের দেখেও কি মনের মধ্যে কামনার সৃষ্টি হয়? তাহলে কি জন্মের পর থেকেই শিশু বাচ্চাদের পা পর্যন্ত আলখেল্লা পড়িয়ে রাখতে হবে? নাকি নিজের Mindset পরিবর্তন করতে হবে?
৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আর রাজাকারেরা যে হাজারো মা-বোনকে ধর্ষণ করেছিল, এসব কি পোশাকের কারণে? ৭১ এ কী তারা Mini Skirt পড়ে ঘুরে বেড়াতো? নাকি নিজেদের ভোগী মানসিকতার খোরাক মিটাতেই নরপিশাচগুলো ঘরে বাইরে থেকে নারী-শিশুদের তুলে নিয়ে ধর্ষণ করতো?
পোশাকই যদি ধর্ষণের মূল কারণ হয়, তাহলে আরব দেশগুলোতে কেন ধর্ষণের ঘটনা ঘটে যেখানে সবাই বোরখা পড়ে? খারাপ মানসিকতা সৃষ্টির জন্য নারীর অর্ধনগ্ন পোশাককে দায়ী করা হচ্ছে অথচ ইন্টারনেটে রেকর্ডতুল্য Porno Movie আরব দেশগুলো থেকে আসে। যেখানে আশেপাশে সবাই বোরখা পড়ে চলাফেরা করে সেখানে কামনা কি করে সৃষ্টি হয় যে Porno site এ আরব দেশগুলোর রেকর্ডতুল্য ক্লিক পড়ে?
আরো একটি ঘটনা বলি, কিছুদিন আগে কোন যেন এক সংবাদপত্রে দেখলাম যে একটি শিশু মসজিদের ভিতর ঈমাম দ্বারা ধর্ষিত হয়েছে। আমি রীতিমতো হতভম্ভ হয়ে পড়ি সংবাদটি দেখে। আচ্ছা এখানে আপনারা কাকে দায়ী করবেন? মসজিদে কোনো মেয়ে শিশু তো হিজাব ছাড়া প্রবেশ করে না। তার কথা কী বলা যায়? এটাও কি পোশাকের দোষ? সত্য করে বলুন তো, নিচু আর বর্বর ধরণের মানসিকতা না হলে কি এরকম ধর্ষণ সম্ভব?
বস্তুত ধর্মান্ধ হয়ে যতই বলা যাক নারীর পোশাক দায়ী ধর্ষণের জন্য, কিন্তু Reality বলে অন্য কথা। এখানে মূলত মানসিকতাই দায়ী। বোরখা হলো সুন্নতী পোশাক যা শরীরী অবয়বকে ঢেকে রাখে। কিন্তু তাই বলে বোরখা পড়লেই যে ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি এড়ানো যাবে এটা নিতান্তই অযৌক্তিক একটি মতবাদ। বহির্বিশ্বের দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, সেখানে নারী পুরুষ নির্বিশেষে সবাই ঘরে বাইরে বেশ ছোটখাটো পোশাক পড়তে অভ্যস্ত। যদি ধর্ষণের জন্য পোশাক দায়ী হতো তাহলে সেখানে প্রতি সেকেন্ডে ১টি করে নারী, শিশু অথবা পুরুষ ধর্ষিত হতো।
পরিশেষে বলতে চাই, এ পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের অধিকার আছে তার নিজের ইচ্ছেমত নিজেকে পরিপাটিরূপে সাজানোর সেটা বোরখা দিয়েই হোক বা বোরখা না দিয়েই হোক। আপনি নিশ্চয়ই তার নোংরা মানসিকতাকে বদ্ধ রাখতে আরেক জনের অধিকার কেড়ে নিতে পারেন না। মনে রাখবেন, আপনি যতক্ষণ না আপনার নোংরা মানসিকতার পরিবর্তন ঘটাতে পারবেন ততক্ষণ পর্যন্ত সমগ্র নারী জাতিকে পুরো হিজাব দিয়ে ঢেকে দিলেও ধর্ষণ বন্ধ হবে না। তাই ধর্ষণ রোধে আগে মনকে সংযত করে নোংরা মানসিকতা থেকে নিজের মনকে বের করে আনতে হবে। তারপর অন্য পদক্ষেপগুলো গ্রহণ করতে হবে।

লেখিকা – আয়েশা সিদ্দিকা লোপা
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *