Home » পবিত্র শবে বরাত এর ফজিলত

পবিত্র শবে বরাত এর ফজিলত

শবে বরাত : (আরবি: ليلة البراءة‎, প্রতিবর্ণী. লাইলাতুল বরাত‎) বা মধ্য-শা’বান (আরবি: نصف شعبان‎, প্রতিবর্ণী. Niṣf Sha‘bān‎) হচ্ছে আরবী শা’বান মাসের ১৫ তারিখে পালিত একটি পূণ্যময় রাত। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মুসলমানগণ বিভিন্ন কারণে এটি পালন করেন। এই রাতকে লাইলাতুল বরাত বলা হয়। এই রাতকে আরবিতে ‘লাইলাতুল বারাআত’ বলা হয়। ‘বারাআত’ নামক আরবি শব্দটির অর্থ নিষ্কৃতি। মুসলমানদের বিশ্বাস মতে, এ রাতে বহু সংখ্যক বান্দা আল্লাহর পক্ষ থেকে ক্ষমা ও আশীর্বাদ লাভ করে জাহন্নাম থেকে নিষ্কৃতি লাভ করেন। তাই, এ রজনীকে আরবিতে ‘লাইলাতুল বারাআত’ বা ‘নিষ্কৃতির রজনী’ বলা হয়।

ইতিহাস
এই বিশেষ রাতের ব্যাপারে কুরআনে সরাসরি কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে, সিহাহ সিত্তাহবা বিশুদ্ধ ছয়খানা হাদিস গ্রন্থের কোনো কোনো হাদিসে এই রাতের বিশেষত্ব নির্দেশক হাদিস বর্ণিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য হাদিস গ্রন্থেও এই রাতের বিশেষত্বের উল্লেখ পাওয়া যায়।

কুরআনের বাণি

পবিত্র কুরআনের সুরা দুখানে উল্লেখিত একটি আয়াতে বর্ণিত একটি বিশেষ রাতের ব্যাখ্যায় ইসলামি ধর্মবিশারদদের কেউ কেউ বলেছেন, বরকতময় সে রাতটি হচ্ছে মধ্য শা’বানের রাত তথা শবে বরাত। প্রাসংগিক আয়াতগুলো হচ্ছে-

হা-মীম। শপথ সুস্পষ্ট কিতাবের। আমিতো এটা অবতীর্ণ করেছি এক বরকতময় রাতে। আমি তো সতর্ককারী। এই রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সূরা দুখান, ১-৪)

কুরআনের প্রসিদ্ধ ব্যাখ্যাকার ইকরামা ‘এক বরকতময় রাত’ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, এ রাতটি হলো মধ্য শাবানের রাত। ইকরামার উপরিউক্ত ব্যাখ্যার সাথে কুরআনের ভাষ্যকারদের অধিকাংশই সহমত হতে পারেননি। তাদের সবাই কুরআনের উপর্যুক্ত আয়াতে বর্ণিত ‘এক বরকতময় রাত’ বলতে শবে কদরকে বুঝানো হয়েছে বলে মত প্রকাশ করেছেন। এমতের সপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করেছেন বিশিষ্ট সাহাবি আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস, প্রখ্যাত তাফসীরবিদ ইবনে কাসীর, ইমাম কুরতুবী প্রমুখ। কুরআনের বিশিষ্ট ব্যাখ্যাকার ইবনে কাসীর বলেছেন, এখানে ‘বরকতময় রাত’ বলতে পবিত্র শবে কদরের রাতকে বোঝানো হয়েছে, যা কুরআনের অপরাপর আয়াত থেকেও প্রমাণিত হয়। ইমাম কুরতুবী তাঁর তাফসীরে বলেছেনঃ

“কোন কোন ধর্মবিশারদ বলেছেন, ‘লাইলাতুম মুবারাকাহ’ দ্বারা বোঝানো হয়েছে মধ্য শাবানের রাতকে (শবে বরাত)।

হাদিস

‘শবে বরাত’ শব্দযুগল ফার্সি হওয়ায় আরবিভাষী নবী মুহাম্মাদ (সা) বাণিসমষ্টিতে এর উল্লেখ পাওয়া যায় না। তবে মহানবী মুহাম্মাদ (সা) এর বাণিসমষ্টি নামে খ্যাত হাদিস শাস্ত্রে ‘শবে বরাত’ বলতে যে পরিভাষাটি ব্যবহার করা হয়েছে, তা হলো ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শা’বান’ তথা ‘শা’বান মাসের মধ্য রজনী’। হাদিস শাস্ত্রে শবে বরাত সংক্রান্ত যেসব হাদিস উল্লেখিত হয়েছে, সেগুলো বিভিন্ন মানের। এসকল হাদিসের কোন কোনটি সহীহ বা বিশুদ্ধ পর্যায়ের, কোনটি হাসান বা সৌন্দর্যমণ্ডিত, কোনটি জইফ বা দুর্বল, কোনটি জইফে জিদ্দান বা অতি দুর্বল আর বাকিগুলো মাউযু বা জাল হাদিস।

সহীহ হাদিস বা বিশুদ্ধ হাদিস[সম্পাদনা]

মুআয ইবনে জাবাল থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, নবী কারীম (সা) বলেছেন, ‘‘আল্লাহ তাআলা অর্ধ-শাবানের রাতে সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত আর সবাইকে মাফ করে দেন।’’ (সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ৫৬৬৫)

আধুনিক যুগের প্রখ্যাত হাদিসবিশারদ শায়খ নাসিরুদ্দীন আলবানী রাহ. ‘‘সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহা’’ ৩/১৩৫-১৩৯-এ এই হাদীসের সমর্থনে আরো আটটি হাদীস উল্লেখ করার পর লেখেন, ‘‘এ সব রেওয়ায়াতের মাধ্যমে সমষ্টিগতভাবে এই হাদীসটি নিঃসন্দেহে সহীহ প্রমাণিত হয়।” সালাফি ঘরানার ইসলামি ধর্মগুরুদের মধ্যে যারা এ হাদিসকে বিশুদ্ধ বলে স্বীকার করেন, তারা সতর্ক করে দিয়ে বলেন, হাদিসটি শবে বরাতের তাৎপর্য তুলে ধরলেও এ রাতে বান্দার রাত্রি জাগরণ বা অন্যান্য কোন আচার-অনুষ্ঠান পালন করতে কোন নির্দেশনা দেওয়া হয় নি।

অন্যান্য হাদিস

এই রাতের কথা হাদিস সংগ্রাহক তিরমিযী কর্তৃক বর্ণিত হাদিসে পাওয়া যায়, ঐ হাদিস মতে, এক রাতে ইসলামের নবী মুহাম্মদের(সাঃ) স্ত্রী আয়েশাঘুম থেকে উঠে পড়লেন কিন্তু মুহাম্মদ(সাঃ)কেবিছানায় দেখতে পেলেন না। তিনি মুহাম্মদকে(সাঃ) খুঁজতে বের হলেন এবং তাঁকে জান্নাতুল বাকিকবরস্থানে দেখতে পেলেন। মুহাম্মদ(সাঃ) বললেন, ১৫ শাবানের রাতে আল্লাহ সর্বনিম্ন আকাশে নেমে আসেন এবং [আরবের] কালব্‌ উপজাতির ছাগলের গায়ের পশমের থেকে বেশি লোককে কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করেন। উল্লেখ্য, সেসময় কালব্ গোত্র ছাগল পালনে প্রসিদ্ধ ছিল এবং তাদের প্রচুর ছাগল ছিল। এই হাদিসের নিচে ইমাম তিরমিযী উল্লেখ করেন, “হযরত আবু বকরও [রা.] এরূপ হাদিস বর্ণনা করেছেন বলে জানা যায়।[১]প্রসিদ্ধ হাদিস বেত্তা ইমাম বুখারী ও ইমাম তিরমিযী কর্তৃক হাদিসের মান পর্যালোচিত হয়েছে। ফলে, অপরাপর হাদিস বিশারদগণের মতে এ হাদিসটি মুনকাতি’ (তথ্যসূত্র পরম্পরাবিহীন) পর্যায়ের।

প্রখ্যাত হাদিস সঙ্কলক ইমাম বায়হাকি তাঁর ‘শুআবুল ঈমান’ নামক হাদিস সংকলন গ্রন্থে একই রকম আরেকটি ঘটনা বর্ণনা করেছেন।

আলা ইবনে হারিস থেকে বর্ণিত, আয়িশা (রাঃ) বলেন, এক রাতে আল্লাহর রাসূল (সা) দাঁড়িয়ে সালাত আদায় করছিলেন। সিজদাহ এত দীর্ঘ করলেন যে, আমি ধারণা করলাম তিনি ইন্তেকাল করেছেন। আমি এ অবস্থা দেখে দাড়িয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুল ধরে নাড়া দিলাম, আঙ্গুলটি নড়ে উঠল। আমি চলে এলাম। সালাত শেষ করে তিনি বললেন, ‘হে আয়িশা অথবা বললেন হে হুমায়রা! তুুমি কি মনে করেছ, আল্লাহর নবী তোমার সাথে বিশ্বাস ভংগ করেছেন?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহর কসম হে রাসূল! আমি এমন ধারণা করিনি। বরং আমি ধারণা করেছি আপনি না জানি ইন্তেকাল করলেন!’ অতঃপর তিনি বললেন, ‘তুমি কি জান এটা কোন রাত?’ আমি বললাম, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসূল ভাল জানেন।’ তিনি বললেন, ‘এটা মধ্য শাবানের রাত। এ রাতে আল্লাহ তা’আলা তার বান্দাদের প্রতি মনোনিবেশ করেন। ক্ষমা প্রার্থনাকারীদের ক্ষমা করেন এবং রাহমাত প্রার্থনাকারীদের রহম করেন। আর হিংসুকদেরকে তাদের অবস্থার উপর ছেড়ে দেন।’

তবে এ হাদিসটির তথ্যসূত্রের বিশুদ্ধতাও প্রশ্নাতীত থাকে নি। মানগত দিক থেকে হাদীসটি মুরসাল। সহীহ বা বিশুদ্ধ নয় । কেননা বর্ননাকারী ‘আলা’ আয়িশা (রাঃ) থেকে শুনেননি।

শবে বরাত সংক্রান্ত প্রখ্যাত হাদিসগুলোর মধ্যে আরেকটি বর্ণনা বায়হাকি সংকলিত ‘শুআবুল ঈমান’ গ্রন্থেই পাওয়া যায়। এটি নিম্নরূপঃ

উসমান ইবনে আবিল আস (রাঃ) থেকে বর্ণিত, রাসূলূল্লাহ (সা) বলেছেন, যখন মধ্য শাবানের রাত আসে তখন একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা দেয়, “আছে কি কোন ক্ষমা প্রার্থনাকারী? আমি তাকে ক্ষমা করব। আছে কি কেউ কিছু চাইবার? আমি তাকে তা দিয়ে দিব।” রাসূল (সা) বলেন, “মুশরিক ও ব্যভিচারী বাদে সকল প্রার্থনাকারীর প্রার্থনা কবুল করা হয়।”

বিখ্যাত হাদিসবেত্তা নাসিরুদ্দীন আল-বানী হাদিসটিকে তার সংকলন ‘যয়ীফ আল-জামে’ নামক কিতাবের ৬৫২ নং ক্রমিকে ‘দুর্বল’ বলে মন্তব্য করেছেন।

শিয়া মতাদর্শী মুসলিমদের ইতিহাস

শিয়া মতাবলম্বী মুসলিম সম্প্রদায় জাক-জমকের সাথে এ বিশেষ রাতটি উদযাপন করে থাকেন। মহিমান্বিত ও বরকতময় হিসেবে এ রাত উদযাপনের পাশাপাশি এ পূর্ণিমা তিথিটি শিয়া বিশ্বাসের ১২ ইমামের একজন, ইমাম মাহদির জন্মদিন হিসেবে পালিত হয়ে থাকে। শিয়াগণ বিশ্বাস করেন যে, এ তিথিতেই মুহাম্মাদ মাহদি ধরাধামে এসেছিলেন। শবে বরাত পালনের মধ্যে রয়েছে রোযা, দোয়া-মাহফিল ও আলোচনা অনুষ্ঠান। শবে বরাতের রাতে ইরানের নগরগুলো আলোকসজ্জায় রাঙানো হয়।

বরকত নাযিল

শবে বরাত সংক্রান্ত বর্ণনায় কোন কোন হাদিসে উল্লেখ পাওয়া যায়, এ রাতে আল্লাহ্‌ তাঁর প্রেমসিক্ত ধর্মপরায়ণ বান্দাদের মাঝে তাঁর রহমত ও বরকত বর্ষণ করেন। মুসলিমদের মধ্যে কোন কোন গোষ্ঠি বিশ্বাস করেন, এ রাতে আল্লাহ্‌ সকল কিছুর ভাগ্য পুনর্বণ্টন করেন। কোন কোন সংস্কার মতে, এ রাতে কবর থেকে আত্নারা উঠে নিজ আত্নীয়-স্বজনের বাড়িতে আসে। ফলে, এ রাতে বিভিন্ন এলাকার আবাসিক গৃহে আলোক প্রজ্বালন করা হয়। তবে, এ ধরনের বিশ্বাস বা তথ্য কুরআন কিংবা হাদিস দ্বারা সমর্থিত নয়।

মুরতাদ্বা থেকে বর্নিত, নবী করিম (সা) এর বানী, যখন শাবানের ১৫তম রাতের আগমন ঘটে তখন তাতে কিয়াম (ইবাদত) করো আর দিনে রোযা রাখো । নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা সূর্যাস্তের পর থেকে প্রথম আসমানে বিশেষ তাজাল্লী বর্ষন করেন, এবং ইরশাদ করেনঃ কেউ আছ কি আমার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা কারী? তাকে আমি ক্ষমা করে দিব ! কেউ আছ কি জীবিকা প্রার্থনাকারী? তাকে আমি জীবিকা দান করব ! কেউ কি আছ মুসিবতগ্রস্ত? তাকে আমি মুক্ত প্রদান করব! কেউ এমন আছ কি! কেউ এমন আছ কি! এভাবে সূর্য উদয় হওয়া পর্যন্ত আল্লাহ পাক তার বান্দাদেরকে ডাকতে থাকবেন।

— সুনানে ইবনে মাযাহ, ২য় খন্ড, পৃঃ ১৬০, হাদিস নং-১৩৮৮

বুখারী ও মুসলিম বর্ণিত অনুরূপ একটি সহীহ হাদীসের বক্তব্য হল, আল্লাহ তাআলা প্রতি রাতের শেষের দিকে নিকটতম আকাশে অবতরণ করে দু‘আ কবুলের ঘোষণা দিতে থাকেন। উপরেরতহাদিসটি প্রখ্যাত হাদিসবিদ নাসিরুদ্দিন আলবানী দুর্বল বলেছেন। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, হাদিসটির বর্ণনাসূত্রে ‘সাবুরাহ’ নামে এক ব্যক্তির উল্লেেখ এসেছে, যইবনে মাজাহ বর্ণিত তিনি হাদিস কে জাল করতেন বলে জনশ্রুতি আছে। উপরন্তু, প্রতিষ্ঠিত ও প্রমাণিত তথ্যের বিরোধী হওয়ায় হাদিসটি গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

শবে বরাত উদযাপন

শবে বরাত রজনীটি ইসলামের প্রচারক মুহাম্মাদ (সা) বা তাঁর অনুচরবর্গ স্ব-স্ব জীবদ্দশায় কখনো পালন করেছেন বলে সহীহ সনদে বর্ণিত কোন তথ্যনামায় পাওয়া যায় না। তবে, বেশ কিছুকাল আগে থেকেই মুসলিম বিশ্ব সাড়ম্বরে রজনীটি উদযাপিত হয়ে আসছে। ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা, ইরান, লেবানন, তুরস্ক, আফগানিস্তান সহ প্রভৃতি দেশে শবে বরাত ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে পালনের রেওয়াজ আছে। [১] বিশেষত ইরানে রজনীটি ভিন্ন মাত্রায় সাড়ম্বরে উদযাপিত হয়। এ রাতে ছাত্রাবাসসমূহে আনন্দ উৎসব পালিত হয়। বিজয় তোরণ তৈরি করা হয়। মিষ্টি ও শরবত বিতরণ করা হয়। রাস্তায়-রাস্তায় ইমাম মাহদির আগমন নিয়ে গান গাওয়া ও শুভেচ্ছা জানানো হয়। এ ছাড়া ১৫ শাবান ইরানি আচার প্রথা অনুযায়ী দিন-রাত মিলাদ ও দোয়া-মাহফিলের আয়োজন করা হয়।

তবে সালাফি মধ্যপ্রাচ্য এ রাতটিকে উদযাপন করে না। সালাফিদের কেউ কেউ এ রাতটির তাৎপর্যের কথা স্বীকার করলেও এ রাত উদযাপন করাকে সমর্থন করেন না। এ রাত উদযাপনকে ‘বিদআহ’ বা নবউদ্ভাবন হিসেবে পরিত্যাজ্য বলে তারা বিশ্বাস করেন।

বাংলাদেশে শবে বরাত

বাংলাদেশ ও ভারতীয় উপমহাদেশে শবে বরাত পালনের এক দীর্ঘ ঐতিহ্যবাহী রেওয়াজ গড়ে উঠেছে। শবে বরাত উপলক্ষে প্রতিটি বাড়িতে আয়োজন করা হয় বিভিন্ন স্বাদের খাবার। এসবের মধ্যে রয়েছে রুটি, বিভিন্ন রুচির হালুয়া, সুজি, মিষ্টান্ন। বিকেলে বা সন্ধ্যায় পাড়া প্রতিবেশিদের মাঝে এসব খাবার বিতরণ ও পরিবেশন করা হয়। এতে সামাজিক হৃদ্যতা ও সৌহার্দের সম্পর্ক গড়ে উঠে বলে স্থানীয় মুসলিম গণ বিশ্বাস করে থাকেন। এই রাতে অলি-গলি, রাস্তা-ঘাট সর্বত্র আলোক সাজসজ্জা করা হয়। আতশবাজি উৎসব দেখা যায়।

শবে বরাত উপলক্ষে ১৪ই শাবান দিন থেকেই ঘরে ঘরে রুটি, হরেক প্রকার হালুয়া ও বিচিত্র সব মিষ্টান্ন তৈরির কাজ শুরু হয়ে যায়। বিকেলের মধ্যে এগুলো সম্পন্ন হলে, পাড়া-প্রতিবেশিদের মধ্যে বিতরণ করা শুরু হয়। এতে পুরো এলাকায় উৎসবের আমেজ পড়ে যায়। বাংলাদেশ ইসলামিক ফাউন্ডেশনসহ বিভিন্ন ইসলামি সংগঠন বিশেষ আলোচনা, দোয়া মাহফিল ও ধর্মীয় সভার আয়োজন করে। এশার নামাজের শুরু থেকে, বিশেষত মাগরিবের নামাজের পর থেকেই, মসজিদ পানে ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের ঢল নামে। প্রায় সকল মসজিদেই শবে বরাত শীর্ষক বিশেষ আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাতভর ইবাদত বন্দেগির নিমিত্তে সারা বাংলাদেশের সমস্ত মসজিদ পুরো রাত উন্মুক্ত থাকে। মসজিদের পাশাপাশি বাসা-বাড়িতেও রাতভর ধর্মপ্রাণ মুসলিমগণ নামাজ, তিলাওয়াত, জিকির-আজকার ও বিভিন্ন ইবাদত করে থাকেন। প্রয়াত হয়ে যাওয়া আত্নীয়-স্বজনের সমাধি পরিদর্শন এ রাতের এক বিশেষ অনুষংগ হিসেবে দৃষ্ট হয়।

শবে বরাত উপলক্ষে বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বেতার ও টেলিভিশন চ্যানেলগুলো বিশেষ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করে। জাতীয় পত্রিকাগুলো এ দিন বিশেষ ক্রোড়পত্র ও সাময়িকী প্রকাশ করে। ১৫ ই শাবানের কার্যদিবসটি অর্থাৎ শবে বরাতের পর আসন্ন দিনটি বাংলাদেশে সাধারণ ছুটির দিন হিসবে পালিত হয়। সর্বস্তরের পেশাজীবীরা এ দিন বাধ্যতামূলক ছুটি উপভোগ করে থাকেন।

শবে বরাত ও ইসলামি সাহিত্য[সম্পাদনা]

শবে বরাত উপলক্ষে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় ইসলামি সাহিত্যের একটি আলাদা স্বরূপ গড়ে উঠেছিল। পারস্যের প্রাচীন গবেষক আবু রায়হান আল বেরুনি লিখেছেন: ‘১৫তম শাবানের রাত হচ্ছে মহত্তম রাত এবং এটিকে শাবে বারাত বলা হয়। সম্ভবত ইবাদত বন্দেগির মাধ্যমে পুণ্য সংগ্রহ করে নরকের আগুন থেকে বেঁচে থাকার জন্য ও ভাগ্যকে সুপ্রসন্ন করার প্রক্রিয়াকে শাবে বারাত বলে।’ বিশিষ্ট ফারসি গদ্য লেখক গারদিজি এই রাতের নামকরণ সম্পর্কে কিছুটা ভিন্ন ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন: ‘এই দিনের রাতটি শাবে বারাত নামে পরিচিত। ভাগ্যগুলো লওহে মাহফুজে সংরক্ষিত আছে এবং মহান প্রভু সেখানে অবস্থান করছেন। এই রাতে মহান প্রভু লওহে মাহফুজ থেকে আকাশে নেমে আসেন। সেখান থেকেই দুনিয়াবাসির জন্য মহান প্রভুর নির্দেশ নিয়ে আসা হয়। তাই এই বিশেষ রাতকে লাইলাতুল কদর আস সাকও বলা হয়।’

কিছু কিছু গবেষক শবে বরাতের উৎসবকে ইসলামপূর্ব প্রাচীন ইরানের ফারভারদেগান উৎসবের পরিবর্তিত রূপ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এ ছাড়া বর্তমান ইরানে সবচেয়ে প্রচলিত মতামত হচ্ছে, এই রাতে ইমাম মাহদি জন্মগ্রহণ করেছেন। এ কারণেই ইরানের সর্বত্র উৎসবটি পালিত হয়।

এই রাতে দলবদ্ধভাবে বিশেষ কবিতা ও গান গাওয়াটাও এখানকার মানুষের অন্যতম বিনোদন হিসেবে চিহ্নিত। এমনি একটি ফারসি কবিতার বাংলা রূপ তুলে ধরা হলো-

এই রাত উৎসর্গের রাত মৃত ব্যক্তিদের ক্ষমার রাত

এই রাত ভাগ্যের রাত রাঁধো হালুয়া, আর বানাও নাবাত

এমন উৎসর্গের রাতে মাহদি রয়েছে আমাদের মোনাজাতে

এমন জন্মদিনের রাতে যেন সকলের আনন্দ আর উৎফুল্লে কাটে।

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সভ্যতায়ও শবে বরাতের প্রভাব লক্ষণীয়। প্রখ্যাত কবি গোলাম মোস্তফা এ রাতকে নিয়ে লিখেছেন তাঁর একটি বিখ্যাত কবিতা ‘শবে বরাত’। তিনি লিখেছেনঃ

আজ যদি না জাগে এ জাত

তবে মিথ্যে তাদের শবে বরাত।

প্রখ্যাত কবি কাজী নজরুল ইসলামও এ রাত নিয়ে ইসলামি সংগীত রচনা করেছেনঃ

‘এল এল শবে রাত

তোরা জ্বালরে ঘরে বাতি,

হোক রওশন মুসলিম জাহানের

অন্ধকার রাতি। ‘

অন্যান্য ন

লাইলাতুল বরাত।লাইলাতুল দোয়া।ইরান ও আফগানিস্তানে নিম শা’বান।আরবী ভাষাভাষীগণ বলে নিসফ্ শা’বান।মালয় ভাষাভাষীগণ বলে নিসফু শা’বান।তুর্কি ভাষাভাষীগণ বলে বিরাত কান্দিলি।ভারতীয় উপমহাদেশে বলা হয় শবে বরাত।

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *