Home » ডিজিটাল যুগের অন্যতম হাতিয়ার সাইবার হয়রানি:প্রতিরোধে করণীয়

ডিজিটাল যুগের অন্যতম হাতিয়ার সাইবার হয়রানি:প্রতিরোধে করণীয়

ডিজিটাল যুগের অন্যতম হাতিয়ার সাইবার হয়রানিঃপ্রতিরোধে করণীয়
[One of the tools of the Digital age is Cyber Harassment::What to do to prevent]

🔷 Globalisation এর যুগে Internet ছাড়া এক মুহূর্তও কল্পনা করা যায় না। বিষয়টি এমন হয়ে গেছে যে Internet এর আওতায় থাকা মানেই গোটা বিশ্ব হাতের মুঠোয় থাকা। তাই ইহার অগ্রযাত্রা মানব জীবনে অনস্বীকার্য। কিন্তু ইন্টারনেটের অগ্রযাত্রার পাশাপাশি গত কয়েক বছরে ব্যাপক হারে বেড়েছে Cyber Crime। আর এ অপরাধের বড় অংশ জুড়ে আছে Cyber Harassment বা সাইবার হয়রানি।

🔷 প্রযুক্তির বিস্তারে বিভিন্ন ধরনের ডিভাইস সবার নাগালে চলে আসায় অনেকেই এর শিকার হতে শুরু করেছে। প্রাচ্য কিংবা পাশ্চাত্য সবখানেই নির্বিশেষে চলছে এ ঘটনা।বাস্তবে হয়রানির শিকার হলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া বেশি হয়। কিন্তু সাইবার হয়রানির প্রভাব দীর্ঘস্থায়ী। একবার ছড়িয়ে পড়লে লাখ লাখ মানুষের কাছে অপমানিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

🔷 বাংলাদেশে দিন দিন Social Media নারী পুরুষ নির্বিশেষে সকলের জন্য অনিরাপদ হয়ে উঠছে। কারণ ইন্টারনেটের প্রতিটি Platform  এই এখন হয়রানি উপস্থিত।ফেইসবুক, ইন্সটাগ্রাম হোক কিংবা এক্সবক্স লাইভ, স্ন্যাপচ্যাট, মাইনক্রাফট গেইম, মোবাইল এসএমএস- সব প্ল্যাটফর্মে নিজস্ব কায়দায় হয়রানির ঘটনা ঘটছে প্রতিনিয়ত।ফেইসবুক, টুইটার, ইন্সটাগ্রাম, গুগল, স্কাইপিতে ভুয়া আইডি খুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন অনলাইন পোর্টাল, ব্লগে মিথ্যা ও মানহানিকর তথ্য প্রচার, বিভিন্ন Apps এ অশ্নীল ছবি, ভিডিও ও মেসেজ পাঠিয়ে Specially নারীদের উত্ত্যক্ত করছে সাইবার অপরাধীরা।ফিশিংয়ের মাধ্যমে অন্যের আইডি Hack করে প্রতারণাও করা হচ্ছে। সাইবার অপরাধের শিকার ৫২২ জনকে নিয়ে সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা যায়, ভুক্তভোগীদের ৭০ শতাংশই নারী। তাদের মধ্যে ১৫ থেকে ২৫ বছরের কম বয়সী নারী ৫৭ শতাংশ।এসব সাইবার অপরাধের ধরনের মধ্যে রয়েছে Cyber  Pornography ১৪ শতাংশ, Hacking ২০ শতাংশ, Defamation ১৮ শতাংশ, Fake ID ২০ শতাংশ ও অন্যান্য ৬ শতাংশ।

🔷 গবেষণা প্রতিবেদনে দেখা যায়, ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১১ ধাপে অপরাধ সংঘটিত হয়। এর মধ্যে মুঠোফোনে বার্তা পাঠিয়ে হুমকি, কপিরাইট আইন লঙ্ঘন, পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে প্রতারণা এবং অনলাইনে কাজ করিয়ে নেওয়ার কথা বলে প্রতারণা অন্যতম। আক্রান্তদের মধ্যে নারী ভুক্তভোগী বেশি। যাদের ৮০ শতাংশই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেন না। বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে ১৫ টি অভিযোগ জমা হচ্ছে পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্স ন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগে। এই হিসাবে মাসে আড়াই শতাধিক অভিযোগ জমা হচ্ছে। এছাড়া অভিযোগ জমা না দিয়েই প্রতিদিন গড়ে অন্তত অর্ধ শতাধিক ভুক্তভোগীকে বিভিন্ন সেবা দেওয়া হয়ে থাকে বলেও জানান এই পুলিশ কর্মকর্তা। এর বাইরেও বিশাল একটি অংশ আইনী সহায়তা না নিয়ে গোপনে যাতনা ভোগ করতে থাকেন।

🔷 সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন নামক একটি বেসরকারি সংস্থা ২০১৮ সালের মে মাসে ‘বাংলাদেশ সাইবার অপরাধের প্রবণতা শীর্ষক’এক গবেষণা প্রকাশ করে। প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন সিসিএ ফাউন্ডেশনের সভাপতি কাজী মুস্তাফিজ। এতে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সী মেয়েরা। আর ভুক্তভোগীদের মধ্যে ১৮ বছরের কম বয়সী মেয়েদের সংখ্যা ১০.৫২ শতাংশ, ১৮ থেকে ৩০ বছরের কম বয়সী নারীর সংখ্যা ৭৩.৭১ শতাংশ, ৩০ থেকে ৪৫ বছর বয়সী নারীর সংখ্যা ১২.৭৭ শতাংশ এবং ৪৫ বছরের বেশি নারীর সংখ্যা ৩ শতাংশ।

🔷 হয়রানির শিকার নারীদের ৩০ শতাংশই এর বিরুদ্ধে কিভাবে আইনী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয় সে বিষয়ে জানেন না। বাকিদের মধ্যে ২৫ শতাংশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হবে না ভেবে অভিযোগ করেন না। অভিযোগ করেও আশানুরূপ ফল পাননি ৫৪ শতাংশ ভুক্তভোগী। আবার মফস্বলে অনলাইনে হয়রানির শিকার বেশিরভাগ ভুক্তভোগী থানায় যান না। সামাজিক ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে এবং অভিযুক্ত ব্যক্তি প্রভাবশালী হওয়ায় ৩ দশমিক ৯ শতাংশ ভুক্তভোগী আইনের আশ্রয় নেন না।

🔷 ‘থিংক ট্যাংক ফর সিকিউরিটি ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর আহ্বায়ক সৈয়দ জাহিদ হোসেন বলেন, ‘কম্পিউটার ব্যবহারের ফলে সাইবার অপরাধও বাড়ছে। যারা সাইবার অপরাধে জড়াচ্ছেন তারা আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার ইচ্ছা থেকে এ কাজ করে থাকেন।’

🔷 সাইবার হয়রানির বিষয়ে নিজেদের সচেতন হবার পরামর্শ দিয়ে লেখক ও নাগরিক সাংবাদিক রোদেলা নীলা রাইজিংবিডিকে জানান,”অনলাইন জীবনেও পরিমিতিবোধ থাকা দরকার। Emotional হয়ে ব্যক্তি জীবনের কথা অনেকেই সোশ্যাল মাধ্যমে লিখি। পরে যতোই ডিলিট করি না কেন ডাটাতে কিন্তু সব থেকে যাচ্ছে। তাই নিজের মনের রিমোট রাখতে হবে নিজের হাতেই। আমার ঘরের নিরাপত্তা প্রথম আমাকেই দিতে হবে।ঘরের দরজা খুলে রেখে চুরি হবার দায় নিশ্চয়ই আমি রাষ্ট্রকে দিতে পারি না। তেমন করেই আমার অনলাইনে কোনো পোস্ট শেয়ার দেবার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে কোন পোস্ট পাবলিকে যাবে,আর কোন পোস্ট হবে শুধুই বন্ধুদের জন্য। আর কতটুকু লিখলে তা পরিমিতিবোধ ছাড়িয়ে যাবে না, সে বিষয়েও খেয়াল রাখতে হবে। তবেই সুরক্ষিত থাকবে এই ডিজিটাল এবং অ্যানালগ জীবন।”

🔷 নারীদের সাইবার সুরক্ষা নিয়ে কাজ করা আর্টিকেল নাইনটিনের বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক পরিচালক ফারুখ ফয়সল বলেন, “প্রযুক্তিকে ভয় নয় বরং এর প্রায়োগিক ও ব্যবহারিক দিক জেনে এগিয়ে যেতে হবে। কারণ প্রযুক্তির ব্যবহার জানা ছাড়া নারীর ক্ষমতায়ন সম্ভব নয়। Digital Literacy বা প্রযুক্তি শিক্ষার মাধ্যমে নারীরা অনলাইনে Bullying এর মতো নেতিবাচক বিষয় থেকে নিজেকে রক্ষা করতে পারেন।”

🔷 এ বিষয়ে ব্যক্তিগত সুরক্ষার স্বার্থে বিভিন্ন প্রযুক্তি ও App ব্যবহারে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দেন সুপ্রিম কোর্টের ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। তিনি বলেন, “ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ভূমিকার শুরুতেই ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের’ কথা বলা হয়েছে। অথচ আইনের কোনো ধারায় নিরাপত্তার বিধান নাই। তাই অনলাইনে বিচরণের ক্ষেত্রে পেশাগত ও ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে পার্থক্য রাখাটা জরুরি। আইনী সুরক্ষার আগে অনলাইন ব্যবহারকারীকে অবশ্যই প্রযুক্তির কারিগরি দিকগুলো সম্পর্কে ভালোভাবে জানতে হবে।”

🔷 সাইবার ক্রাইম ও সাইবার সিকিউরিটি ডিভিশনের (ডিএমপি) অ্যাডিশনাল ডিপুটি কমিশনার মিশুক চাকমা জানান, হয়রানির শিকার একজন ভুক্তভোগীকে সর্বপ্রথম মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। বিচলিত হয়ে এমন কোনো কাজ করা যাবে না,যা তার পরিস্থিতির বিপক্ষে চলে যায়।

🔷 সাইবার অপরাধীদের শনাক্ত, গ্রেপ্তার ও অভিযোগ প্রমাণ করা সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের জন্য সময় সাপেক্ষ ও বেশ চ্যালেঞ্জিং। পুলিশের একার পক্ষে সাইবার অপরাধ মোকাবেলা সম্ভব নয়। তাছাড়া দক্ষতার অভাবে অনেক পুলিশ কর্মকর্তাকে সাইবার অপরাধের বিষয়গুলো তদন্তে হিমশিম খেতে হয়। এজন্য পরিবার থেকে শুরু করে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও নাগরিক সমাজের সম্মিলিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

🔷 সাইবার হয়রানি থেকে বাঁচতে হলে সর্বপ্রথম দরকার ব্যক্তিগত সচেতনতা।কারণ ব্যক্তিগত সচেতনতাই একসময় সামাজিক সচেতনতায়
পরিণত হয়। ব্যক্তিগত সচেতনতা মেনে চললে  অনেকাংশেই বেঁচে থাকা সম্ভব Cyber Crime থেকে। এক্ষেত্রে আমার পরামর্শ হলো….

♦Online ব্যবহার এর সময় সতর্ক থাকতে হবে৷
♦ইন্টারনেট ব্যবহারের Device মোবাইল হলে এতে এমন কোনো ছবি রাখা যাবে না যা চুরি হলে বা Viral হলে সম্মানহানী হতে পারে।
♦bkash বা Bank Account, Credit বা Debit Card এর নাম্বার বা Pin Number অথবা অন্য কোনো তথ্য মোবাইলে বা কম্পিউটারে রাখা যাবে না।
♦নিজের Facebook,E-mail ID সুরক্ষিত রাখতে নিয়মিত পাসওয়ার্ড বদলাতে হবে এবং এ ধরণের গোপনীয় তথ্য কারো সঙ্গে শেয়ার করা যাবে না।
♦মোবাইল বা কম্পিউটারে 2 Step/3 Step Verification Code থাকে প্রয়োজনে সেগুলো Set করে দিতে হবে।

🔷 এরপরও হয়রানির শিকার হলে এ বিষয়ে অভিযোগ জানাতে সাইবার নিরাপত্তা বিভাগের ই-মেইল – (cyberhelp@dmp.gov.bd), ফেইসবুক পেজে (www.facebook.com/cyberctdmp) এবং হেল্প ডেস্কে (০১৭৬৯৬৯১৫২২) যোগাযোগ করতে হবে।

🔷 ২০১৩ সালে সংশোধিত সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ আইন (আইসিটি অ্যাক্ট) অনুযায়ী কারো অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি বা ভিডিও তোলা এবং তা প্রকাশ করার অপরাধে ১০ বছর কারাদণ্ড এবং অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দেয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এ আইন অনুযায়ী অভিযোগ করা যেতে পারে।

🔷 সাইবার হয়রানি থেকে সুরক্ষা দিতে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগে একটি সাইবার Help desk  রয়েছে৷ এই Helpline (০১৭৬৬৬৭৮৮৮৮) 24/7 খোলা থাকে।বাংলাদেশের যে কোন জায়গা থেকে যে কেউ Helpline এ সরাসরি ফোন করে অথবা এসএমএসের মাধ্যমে অভিযোগ জানাতে পারবেন।

🔷 এছাড়া সাইবার হয়রানি থেকে রক্ষা পেতে Hotline ‘৯৯৯’ চালু করেছে সরকার। যে কোন Cyber Harassment Victim এই হটলাইনে ফোন করেও অভিযোগ জানাতে পারবেন।

🔷 একথা সত্য যে আইনের যেমন বিধান আছে তা কার্যকারিতার ক্ষেত্রে কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে।
তাই বলে হাল ছেড়ে দেয়া যাবে না।
নিউটনের গতির তৃতীয় সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি যে….
“For every action, there is an equal and opposite reaction…”

সব কিছুরই একটি ভালো কিংবা খারাপ দিক থাকবে। First & Foremost duty আমার যে আমি কোন দিকটি কিভাবে Use or Abuse করবো।

🔷 উপরের আলোচনা থেকে বলতে চাই, আমার ব্যক্তিগত সুরক্ষার চাবিকাঠি আমার নিজের হাতেই আমি এটাকে অন্যের কাছে হস্তান্তরিত করবো কোন যুক্তিতে। একটি কথা মনে রাখতে হবে,
“Self safety is one’s first duty.”
ছোট একটি গল্প দিয়ে আমার নিবন্ধটি শেষ করবো……..
একটি ফুল থেকে মৌমাছি মধু সংগ্রহ করে আবার
ঐ একই ফুল থেকে মাকড়সা সংগ্রহ করে বিষ।
Social Media ও এক ধরণের ফুলের মত।
এখন আমাদেরকেই ভাবতে হবে আমরা ফুলকে কোন কাজে ব্যবহার করবো।

লেখিকা – আয়েশা সিদ্দিকা লোপা
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী

Leave a comment

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *