একটি উদ্ধৃতি দিয়ে আরম্ভ করি—-
“Lawyers never lose
They either win or learn”
অর্থাৎ
“আইনজীবীরা কখনো হারেন না
তাঁরা জিতেন নয়তো শিখেন”
উল্লেখিত উদ্ধৃতিটুকু থেকেই আমরা বুঝে নিতে পারি একজন আইনজীবীর প্রচেষ্টা বা উদ্যম এর কোনো মাপকাঠি নেই।।আর তাঁদের এ উদ্যমী মানসিকতার জন্যই তাঁরা”ব্যবহারজীবী” বা “Legal Practitioner” হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছেন।
একবার একজন Solicitor এর পেশাদার দক্ষতার ভিত্তিতে “আদর্শ বনাম বাস্তবতা” নামক এক সমীক্ষার প্রশ্নের জবাবে যুক্তরাজ্যের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ (63:63%) উত্তরদাতারা বলেছেন যে তারা বৌদ্ধিকভাবে উদ্দীপক পরিবেশে কাজ করার জন্য আইনজীবী হয়েছিলেন এবং তৃতীয়াংশের (৩৫%) বলেছেন যে তারা পুরস্কৃত কাজ করার জন্য আইনজীবী হয়েছেন।তাহলে দেখা যাচ্ছে বিশ্বে আইনজীবী পেশার মর্যাদা বা গুরুত্ব কতখানি।।
এবার আসা যাক বিশদ আলোচনায়।
আমরা জানি,আইনজীবী শব্দের ইংরেজী অর্থ হলো ‘Lawyer’ যদিও এর আরো অনেক প্রতিশব্দ রয়েছে।বিগত ১৪ শতক থেকে আইনজীবী বা “Lawyer” শব্দটি,Lauire,Lawer,Lawere “আইনের বিষয়ে পারদর্শী একজন যার পেশার আদালতে মামলা রয়েছে বা আইনী অধিকারের বিষয়ে ক্লায়েন্টের সাথে পরামর্শকারী হিসেবে ব্যবহৃত হতো।১৭ শতক থেকে মূলত Lawe এর সাথে iere যুক্ত করা হয় যার অর্থ হিসেবে জ্ঞানী ব্যক্তি,উপদেষ্টা,কাউন্সিলর ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহৃত হতো এবং সবশেষে “Lawyer”এর জন্য মধ্যবর্তী ইংরেজী শব্দটি ছিল “Man-of-Law.”
প্রকৃতপক্ষে “LAWYER” শব্দটির_প্রতিটি_বর্ণের_ মাঝে লুকায়িত রয়েছে একজন আইনজীবীর দক্ষতাসমূহ…..
Elaboration টা একটু লক্ষ্য করা যাক।
L-#Legal Expert= আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ
A-#Analytical=ব্যাখাকারক
W-#Wisdom=প্রজ্ঞা
Y-#Youthful=তারুণ্যময়
E-#Evergreen=চিরহরিৎ
R-#Royalist=রাজকীয় ব্যক্তি
বিভিন্ন দেশ তাদের নিজ নিজ আইনী ব্যবস্থা অনুযায়ী আইনজীবীদের বিভিন্ন নামে অভিহিত করে থাকেন।ব্রিটিশ আইন অনুযায়ী আইন বিষয়ে পারদর্শী এবং সনদপ্রাপ্ত যে কেউ আইনজীবী।
কিন্তু স্কটিশ ভাষায় রচিত ‘ম্যাক্স আইনে’ বা দক্ষিণ আফ্রিকা, ইতালিয়ান, ফরাসী, স্পেনিয়, পর্তুগিজ, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান, পোলিশ, ইস্রায়েলীয়, দক্ষিণ এশিয়ায় এবং দক্ষিণ আমেরিকার আইন ব্যবস্থা অনুযায়ী “Lawyer” বলতে উচ্চতর শ্রেণির একজন আইনজীবীকে নির্দেশ করে।আবার “Lawyer” বা “Advocate” কিছু দেশে আইনজীবীদের সম্বোধনের উপায়ও বটে।যেমন: “এড. স্যার অ্যালবেরিকো জেন্টলি।
Point to be noted…..
★অস্ট্রেলিয়ায় আইনজীবী বলতে সাধারণত Barrister বা Solicitor উভয়কেই বোঝানো হয়ে থাকে।
★ইংল্যান্ডে “Lawyer” বা আইনজীবী বলতে সংরক্ষিত বা অসংরক্ষিত ক্ষেত্রে আইনী সহায়তা দানকারী ব্যক্তিকে বোঝানো হয় যাদের মধ্যে Barrister ও Solicitor কেও ধরা হয়ে থাকে।
★দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলিত কথায় আইনজীবী বলা হলেও আসল শব্দটি হল অ্যাডভোকেট যা অ্যাডভোকেট এক্ট – ১৯৬১ তে সংজ্ঞায়িত করা আছে।
★স্কটল্যান্ড এ আইনজীবী বলতে আইনে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত ব্যক্তিকে বোঝানো হয়ে থাকে।
গবেষণায় দেখা যায় বিশ্বে বিভিন্ন রকমের আইনজীবী রয়েছেন।।
একটা “Birds eye view”দেয়া যাক……
★প্রতিরক্ষা আইনজীবী(Defense Lawyer)
= একজন আইনজীবী যিনি আদালতে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে কেউ দোষী নয়।এটি প্রমাণের দায়িত্ব প্রতিরক্ষা আইনজীবীকে দেওয়া হয়েছে।
★প্রসিকিউশন আইনজীবী(Prosecution Lawyer)= রাষ্ট্রপক্ষের একজন আইনজীবী যিনি আদালতে প্রমাণ করার চেষ্টা করেন যে কেউ অপরাধী।
★নাগরিক অধিকার আইনজীবী(Civil rights Lawyer)=তিনি নাগরিক অধিকারের আইনজীবী হিসাবে কাজ করেন।
★অপরাধী আইনজীবী(Criminal Lawyer)=তিনি দেশের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় অপরাধী আইনজীবী।
★অবজ্ঞাপূর্ণ আইনজীবী(Libel Lawyer)=ধরুণ, কোনো অভিনেত্রী ম্যাগাজিনের নিবন্ধ সম্পর্কে অসন্তুষ্ট।তাহলে তিনি এ বিষয়ে একজন অবজ্ঞাপূর্ণ আইনজীবীর সাথেই পরামর্শ করবেন।
★চৌকস আইনজীবী(Clever Lawyer)=কোনও চৌকস আইনজীবী কারিগরিতার কারণে তার ক্লায়েন্টকে বাদ দিয়ে একটি মামলা পেতে পারেন।
★হটশট আইনজীবী (Hotshot Lawyer)= একজন সফল এবং আত্মবিশ্বাসী আইনজীবী হলেন ক্রমবর্ধমান খ্যাতির সাথে হটশট আইনজীবী।
বলা হয়ে থাকে, “একজন আইনজীবীকে সবগুলো বিষয়ের কিছু জানতে হবে,কিন্তু কিছু বিষয়ের সব জানতে হবে।”
একজন আইনজীবী হলেন একাধারে “আইনজীবী”, “অ্যাটর্নি”,”ব্যারিস্টার”,”পরামর্শদাতা” বা “সলিসিটার”এবং তিনি আইন অনুশীলন করেন। একজন আইনজীবী হলেন সেই ব্যক্তি যিনি আইন বিষয়ে একটি ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং কোনও নির্দিষ্ট অঞ্চলে আইন অনুশীলনের লাইসেন্স তাঁর রয়েছে।লোকেদের যদি আইন সম্পর্কিত কোনও সমস্যা থাকে তবে তারা পরামর্শের জন্য কোনও আইনজীবীর সাথেই কেবল যোগাযোগ করতে পারেন।একটি আইনী সমস্যা Case হিসাবে উল্লেখ করা হয়।কোনও ব্যক্তি অন্য কারও বিরুদ্ধে মামলা শুরু করতে বা তাদের বিরুদ্ধে যে মামলা শুরু হয়েছে তাতে সহায়তা করার জন্য একজন আইনজীবী নিয়োগ করতে পারেন।যদি মামলা আদালতে যায়,আইনজীবী আদালতে তাদের ক্লায়েন্টের প্রতিনিধিত্ব করবেন।যখন কোনো ব্যক্তির কোনো অপরাধের জন্য অভিযুক্ত করা হয়,তখন সেই ব্যক্তির প্রতিরক্ষা আইনজীবী থাকে যাতে তারা কোনো অপরাধ করেনি তিনি ইহা দেখানোর চেষ্টা করেন।আইনজীবী যে যুক্তি দিয়েছিল যে তারা অপরাধ করেছে তাকে প্রসিকিউটর বলা হয়। আইনজীবীরা তাদের ক্লায়েন্টদের জন্য আইনী নথিও প্রস্তুত করেন। উদাহরণ: সম্পত্তি কেনা বেচা বা উইল তৈরি করা।কিছু আইনজীবী (ইংল্যান্ডে “শপথ কমিশনারদের নামে পরিচিত”) আইনত বাধ্যতামূলক সাক্ষ্য বিবৃতি নিতে পারেন যা আদালতে উপস্থাপন করা যেতে পারে।
আইনজীবীরা বিভিন্ন Settings এ কাজ করেন। কেউ কেউ নিজেরাই কাজ করেন,আবার কেউ আইন সংস্থায় কাজ করেন।কিছু আইনজীবী হাসপাতাল এবং বেসরকারি সংস্থার জন্য কাজ করেন।যে সকল আইনজীবী বেসরকারি সংস্থাগুলোর পক্ষে কাজ করেন তাঁদের সাধারণত In-House পরামর্শক বলা হয়।আইনজীবীরা সাধারণত তাঁরা যে কাজটি করে তার জন্য একটি পারিশ্রমিক ধার্য করেন,তবে কখনও কখনও নির্দ্বিধায়ও পরামর্শ দেওয়া হয়,যাকে “Pro bono” অর্থ “জনস্বার্থের জন্য” বলা হয়।অনেক দেশে,যদি কোনো ব্যক্তি কোনো অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত হন এবং কোনো আইনজীবীর জন্য অর্থ প্রদান করতে অক্ষম হন তবে সরকার ট্যাক্সের অর্থ ব্যবহার করে তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য একজন আইনজীবীকে অর্থ প্রদান করে থাকেন।
উপরের বিশ্লেষণ থেকে এটা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে যে,এই দক্ষতাসমূহ থাকতে হবে একজন বিজ্ঞ আইনজীবীর।
ইহা গুণ কিন্তু নয়!ইহা কেবল আইনজীবীগণের মেধা,প্রজ্ঞা আর দক্ষতা।
আসলে একজন আইনজীবীকে হতে হয়….
১.আইন বিষয়ে অভিজ্ঞ ও Up-to-date। নতুন নতুন বিষয়ে খোঁজ রাখতে হয়।তাঁকে আইন জানতে হয় না,বরং জানতে হয় সে আইনটি কোথায় রয়েছে তা পরিষ্কারভাবে ।
২. হাজার হাজার আইন তার মুখস্ত করতে হয় না। আইনটি সময়মত সঠিক জায়গাতে প্রয়োগের দক্ষতা থাকতে হয়।
৩. সব বিষয়ে তার জ্ঞান থাকতে হয়।যদি গণিত বিজ্ঞানের মা হয়ে থাকে তবে আইন হবে বিজ্ঞানের বাবা!একজন দক্ষ আইনজীবীকে সর্বস্তরের জ্ঞান নিয়ে কাজ করতে হয়।
৪. একজন আইনজীবী হয়ে থাকেন তারুণ্যময়। তার কণ্ঠে থাকে মাধুর্য ও বলিষ্ঠতা(কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে)।যে কারণে বাংলাদেশের প্রখ্যাত আইনজীবী রফিকুল হক ৫০ বছরের উপর কাজ করছেন আইনজীবী হয়ে।উপস্থাপন করেছেন নিজেকে দক্ষতার সাথে।যিনি চির তারুণ্যের অধিকারী।
৫. একজন আইনজীবী হচ্ছেন একজন শিল্পী। আদালত হচ্ছে তাঁর জন্য মঞ্চ যেখানে সে তাঁর সবোর্চ্চ পরিশ্রমটুকু করেন অভিনয় সঠিক হওয়ার জন্য।নিজের ব্যক্তিত্ব,আত্নবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে একজন ভাল শিল্পীর মত হন যিনি বিচারককে মোহিত করেন তার অভিনয় শিল্প দিয়ে।
তাই একজন আইনজীবীর জীবন রাজকীয় সমতুল্য হওয়া উচিৎ।রাজার মত যিনি ভদ্র ও সাহসী।তাঁর নিজেকে প্রকাশ করা উচিৎ রাজকীয়ভাবে আদালতে যিনি নিজেকে ছাড়িয়ে যান নিজের দক্ষতার মাধ্যমে।
আইনজীবীরা সাধারণত আদালতে,সরকারি সংস্থাগুলোর প্রয়োজনে এবং ব্যক্তিগত আইনী বিষয়গুলোতে ক্লায়েন্টদের সাথে পরামর্শ করেন, ব্যবসায়ের জন্য আইন, বিধি এবং নিয়মাবলির ব্যাখ্যা করেন তাঁদের ক্লায়েন্ট বা অন্যদের কাছে লিখিতভাবে এবং মৌখিকভাবে তথ্য উপস্থাপন করেন।ক্লায়েন্টদের পক্ষে তর্ক করেন।আইনী দস্তাবেজ যেমন মামলা, আপিল, উইল, চুক্তি এবং ক্রিয়াকলাপগ প্রস্তুত এবং ফাইল করেন আইনজীবী যাঁকে অ্যাটর্নিও বলা হয়,তাঁরা উভয় পক্ষের পরামর্শক এবং পরামর্শদাতা হিসাবে কাজ করেন।আইনজীবী হিসাবে তাঁরা দলিলগুলোর মধ্যে একটিকে ফৌজদারি বা দেওয়ানি বিচারে প্রতিনিধিত্ব করে প্রমাণ উপস্থাপন করেন এবং তাঁদের ক্লায়েন্টের সমর্থনে যুক্তি দিয়ে থাকেন। উপদেষ্টা হিসাবে আইনজীবীরা তাঁদের ক্লায়েন্টদের তাদের আইনী অধিকার এবং বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে পরামর্শ দেন এবং ব্যবসা ও ব্যক্তিগত বিষয়ে ক্রিয়াকলাপের পরামর্শ দেন।সমস্ত অ্যাটর্নি আইন ও বিচার বিভাগীয় সিদ্ধান্তের অভিপ্রায় নিয়ে গবেষণা করেন এবং তাঁদের ক্লায়েন্টরা যে নির্দিষ্ট পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় সেই পরিস্থিতিতে আইন প্রয়োগ করেন।আইনজীবীরা প্রায়শই সহায়তা কর্মীদের কাজের তত্ত্বাবধান করেন যেমন প্যারাগ্রিজাল, আইনজীবী সহকারী এবং আইনজীবী সচিবদের। তাঁরা কোথায় কাজ করেন তার উপর নির্ভর করে আইনজীবীদের বিভিন্ন উপাধি এবং বিভিন্ন দায়িত্ব থাকতে পারে।আইন সংস্থাগুলোতে আইনজীবীদের কখনও কখনও Associate বা সহযোগী বলা হয়, ব্যক্তি বা ব্যবসায়ের জন্য আইনী কাজ সম্পাদন করে যাঁরা অভিযুক্তদের প্রতিনিধিত্ব করেন এবং তাদের পক্ষে আত্মপক্ষ সমর্থন করেন তাঁদের অপরাধমূলক আইন অ্যাটর্নি বা প্রতিরক্ষা অ্যাটর্নি (Defense Attorney)বলা যেতে পারে।অ্যাটর্নিরা ফেডারেল রাজ্য এবং স্থানীয় সরকারের পক্ষেও কাজ করেন।প্রসিকিউটররা সাধারণত আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত ব্যক্তি বা কর্পোরেশনের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য বা অভিযোগ দায়ের করার জন্য সরকারের পক্ষে কাজ করেন।কেউ কেউ জনসাধারণের প্রতিরক্ষা অ্যাটর্নি হিসেবেও কাজ করতে পারেন।তাঁরা এমন ব্যক্তিদের প্রতিনিধিত্ব করেন যারা তাদের নিজস্ব ব্যক্তিগত অ্যাটর্নি ভাড়া নিতে পারেন না।অন্যরা প্রশাসনিক সংস্থা এবং নির্বাহী বা সরকারের আইনসভা শাখার সরকারি পরামর্শক হিসাবে কাজ করতে পারেন।তাঁরা আইন এবং বিধিগুলি লিখেন এবং ব্যাখ্যা করেন এবং সেগুলো প্রয়োগের জন্য পদ্ধতি স্থাপন করেন।সরকারি পরামর্শকরা এজেন্সি সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের আইনী পর্যালোচনাও লিখে থাকেন।তাঁরা সরকারের তরফ থেকে দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা তর্ক করেন।কর্পোরেট কাউন্সেল, যাঁদের ইন-হাউস কাউন্সেলও বলা হয়,তাঁরা হলেন আইনজীবী যাঁরা কর্পোরেশনের পক্ষে কাজ করেন। তাঁরা কর্পোরেশনের ব্যবসায়িক ক্রিয়াকলাপ সম্পর্কিত এবং আইন সম্পর্কিত বিষয়ে কর্পোরেশনের কর্মকর্তাদের পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এই বিষয়গুলোর পেটেন্টস,সরকারি বিধিবিধান, অন্যান্য সংস্থার সাথে চুক্তি,সম্পত্তির স্বার্থ, কর বা ইউনিয়নগুলোর সাথে সম্মিলিত-দরকষাকষির চুক্তি জড়িত থাকতে পারে।
আবার জনস্বার্থের আইনজীবী বেসরকারি অলাভজনক সংস্থাগুলোর পক্ষে কাজ করেন যা সুবিধাবঞ্চিত ব্যক্তিদের বা অন্যদের জন্য আইনী প্রতিনিধিত্ব করতে সক্ষম নাও হতে পারে এমন আইনী পরিষেবা সরবরাহ করেন।তাঁরা সাধারণত দেওয়ানি মামলা পরিচালনা করেন যেমন ফৌজদারি মামলার পরিবর্তে ইজারা,চাকরির বৈষম্য এবং মজুরি বিরোধের সাথে সম্পর্কিত। বিভিন্ন শিল্পে কাজ করার পাশাপাশি আইনজীবীরা বিশেষ আইনী ক্ষেত্রে বিশেষীকরণ করতে পারেন। নিম্নলিখিত এই ক্ষেত্রগুলোতে আইনজীবীদের বিভিন্ন ধরণের উদাহরণ রয়েছে।
যেমনঃ
★পরিবেশগত আইনজীবীরা পরিবেশ সম্পর্কিত যে বিষয়গুলো এবং নীতিগুলো তা নিয়ে কাজ করেন। উদাহরণস্বরূপঃতাঁরা Advocacy Group,বর্জ্য নিষ্পত্তিকারী সংস্থাগুলো বা সরকারি সংস্থাগুলোর জন্য প্রাসঙ্গিক আইনের সাথে সম্মতি নিশ্চিত করতে সহায়তা করতে কাজ করতে পারেন।
★ট্যাক্স আইনজীবীরা ব্যক্তি ও কর্পোরেশনগুলোর জন্য কর সম্পর্কিত বিভিন্ন ধরণের সমস্যা পরিচালনা করেন।তাঁরা ক্লায়েন্টদের জটিল ট্যাক্স বিধিমালা Negative করতে সহায়তা করতে পারেন যাতে ক্লায়েন্টরা আয়, লাভ এবং সম্পত্তি হিসাবে আইটেমগুলোতে উপযুক্ত ট্যাক্স প্রদান করেন। উদাহরণস্বরূপঃ কর আইনজীবীরা কর্পোরেশনকে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবাদি (আইআরএস) বিধি মেনে চলার জন্য বিভিন্ন রাজ্যে যে লাভ করা হয় তার থেকে কত ট্যাক্স দিতে হয় তার পরামর্শ দিতে পারেন।
★বুদ্ধিজীবী সম্পত্তি আইনজীবীরা আবিষ্কার, পেটেন্টস, ট্রেডমার্ক এবং সৃজনশীল কাজ,
যেমনঃ সঙ্গীত, বই এবং চলচ্চিত্র সম্পর্কিত আইনগুলো নিয়ে কাজ করেন।
উদাহরণস্বরূপঃ একজন বৌদ্ধিক সম্পত্তি আইনজীবী ক্লায়েন্টের আগত বইতে প্রকাশিত উপাদান ব্যবহার করা ঠিক আছে কিনা সে সম্পর্কে কোনও ক্লায়েন্টকে পরামর্শ দিতে পারেন।
★পরিবারের আইনজীবীরা পরিবারের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন আইনি সমস্যা handle করেন।তাঁরা ক্লায়েন্টদের ডিভোর্স,শিশু হেফাজত এবং দত্তক গ্রহণের বিষয়ে পরামর্শ দিতে পারেন।
★সিকিওরিটি আইনজীবীরা স্টক কেনা বেচা থেকে উদ্ভূত আইনী সমস্যা নিয়ে কাজ করেন যা নিশ্চিত করে যে সমস্ত প্রকাশের প্রয়োজনীয়তা মেটানো হয়েছে।তাঁরা প্রাথমিক কর্পোরেশন অফার (আইপিও) এর মাধ্যমে বা অন্য কর্পোরেশনে শেয়ার কেনার ক্ষেত্রে স্টক এক্সচেঞ্জে তালিকাবদ্ধ করতে আগ্রহী এমন কর্পোরেশনগুলোকে পরামর্শ দিতে পারেন।
উপরোক্ত আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে যে ইউরোপ আমেরিকা বা উন্নত বিশ্বে আইন পেশা হলো নাগরিকের প্রথম পছন্দনীয় এবং সর্বোচ্চ সম্মানজনক পেশা।এবং ঐ সকল দেশে আইন পেশার লোকজন সরকারের সবচেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা পেয়ে থাকেন।ঐসব দেশে সবচেয়ে মেধাবী ছেলে মেয়েদের পছন্দের পেশা হলো ‘আইন’ পেশা এবং সরকার এই পেশায় সবচেয়ে বেশি সুযোগ সুবিধা দিয়ে থাকেন।
এখন আমাদের দেশের আইন পেশার বিষয়ে বলি.. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের যে কয়টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয় আছে সব জায়গায় ভর্তিচ্ছুক ছাত্রছাত্রীদের প্রথম পছন্দের বিষয় হলো আইন বিষয়।এখান থেকে আইন পাস করার পর সীমিত সংখ্যক ছেলে মেয়ে জুডিশিয়াল সহ অন্যান্য পেশায় যেতে পারে।আর বেশিরভাগই আইনজীবী হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেষ্টা করে।সাথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ছেলেমেয়েরা তো আছেই।
বাংলাদেশে বর্তমানে LL.B বা LL.M করে একটি ছেলে বা মেয়ে আইনজীবী হতে চাইলে ৬ মাস শিক্ষানবীশকাল সহ (MCQ, WRITTEN, VIVA) সকল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে আসতে সাধারণভাবে ৩/৪ বছর সময় লাগে।আর যদি এর কোথাও এক জায়গায় ফেল করে তাহলে আরো ৩/৪ বছর পিছিয়ে যাবে।(বিঃদ্রঃ ২০১৮ সালে আইনজীবী হওয়ার জন্য বার কাউন্সিলের অধীনে MCQ পরীক্ষা দিয়েছিল প্রায় ৫০ হাজার, তার মধ্যে পাশ করেছে ৮ হাজার জনের মতো)।
আইনজীবী হওয়ার পর নিজেকে এই পেশায় পুরোপুরি Set up করতে একজন সিনিয়রের অধীনে Juniorship করতে হয় আরো ৫/৬ বছর। একজন শিক্ষানবীশ বা একজন জুনিয়র আইনজীবীর ফিস হচ্ছে দৈনিক ২০০ থেকে ৩০০ টাকা যা বর্তমান সময়ে কোর্টে আসা যাওয়ার ভাড়া ও দুপুরের খাওয়াতে খরচ হয়ে যায়।আর এভাবেই আইনজীবী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে একটি ছেলে বা মেয়ের ৯/১০ বছর সময় লেগে যায়।আর প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সরকারকে নিয়মিত ট্যাক্স ভ্যাট প্রদান করতে হয়।
এখন একজন শিক্ষক, ব্যাংকার, বিসিএস ক্যাডার, বা সরকারের সুযোগ সুবিধা পাওয়া অন্যান্য পেশার লোকজন এর কথা বলি।এনারা অনার্স বা মাস্টার্স শেষ করে যেদিন থেকে তাদের পেশায় যোগদান করেন সেদিন থেকে মোটা অংকের বেতন সহ নানান সুযোগ সুবিধা পেতে থাকেন।আর মোটামুটি ৪/৫ বছরে গাড়ি বাড়ির মালিক হয়ে যান।
তারা পেনশন পান,স্বল্প লাভে ব্যাংকের লোন সুবিধা পান,সরকারি প্লট বরাদ্দ পান,বিনা মূল্যে চিকিৎসা সেবা পান, So and So..
অথচ আইনজীবীদের সরকারি কোনও সুযোগ সুবিধা নেই।আইনজীবীদের মান উন্নয়নে প্রতি বছরের বাজেটেও কোনো বরাদ্দ থাকে না।
আইনজীবীদের জন্য ব্যাংকের স্বল্প মূল্যের লোনের কোনো সুবিধা নেই,পেনশন ব্যবস্থা নেই,সরকারি প্লট বরাদ্দে আইনজীবীদের কোনো তালিকা নেই।
আইনজীবীদের স্বল্প/বিনা মূল্যে চিকিৎসার জন্য নিজস্ব কোনো হাসপাতালও নেই।
আমাদের আইনজীবীদের মধ্যে অনেকেই বলে থাকেন এটা রাজকীয় পেশা,আমিও বলি রাজকীয় পেশা।কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে,রাজকীয় পেশা হবার পরও রাজ্যের বেশিরভাগ সুযোগ সুবিধাই আইনজীবীগণ ভোগ করতে পারেন না।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সংসদ অধিবেশনে ৫৫% আইনজীবীর প্রতিনিধিত্ব ছিল,এখনও মাননীয় রাষ্ট্রপতি সহ ৮/৯ জন মন্ত্রী এবং ৬০ এর অধিক সম্মানিত এমপি মহোদয় আছেন বর্তমান সংসদে যাঁরা আইনজীবী।অথচ আইনজীবীদের সরকারি কোনও সুযোগ সুবিধা নেই।আইনজীবীদের সুরক্ষার কোনো আইন নেই। বরিশাল বারের রবিউল ইসলাম যার উপযুক্ত উদাহরণ (আরো অনেক রয়েছে)।রাষ্ট্রের বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মচারীদের হাতে দেশের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পেশার এই মানুষগুলো প্রতিনিয়ত হয় লাঞ্ছিত।
আজ করোনা পরিস্থিতিতে আইনজীবীদের বাস্তব চিত্র ফুটে উঠেছে।অধিকাংশ আইনজীবী তাঁর রোজকার আয় দিয়ে চলেন।এই পরিস্থিতিতে কোর্ট ২/৩ মাস বন্ধ থাকার কারণে অধিকাংশ আইনজীবী সংকটে পড়েছেন এটা স্বাভাবিক।
ঢাকা বারের একজন আইনজীবী আমার বন্ধু হবার কারণ হিসেবে সেখানকার কথা বলি,
ঢাকা আইনজীবী সমিতি লোন প্রদানের ঘোষণা দেয়ার পর এখানে দরখাস্ত পড়েছে ৭৫০০ এর উপরে।একজন আইনজীবীর ৩ মাস চলার হিসেব করে লোন দিতে চাইলে লাখ খানেক টাকার নিচে হয় না। সেক্ষেত্রে প্রায় ৭৫০০০০০০০/= টাকা প্রয়োজন,যা বারের ক্ষেত্রে বহন করা ভীষণ কঠিন হয়ে পড়ে। এই অবস্থায় আইনজীবী সমিতি কর্তৃপক্ষ সরকারের নিকট প্রণোদনা বা সহযোগিতা চাইতেই পারেন।
করোনা পরিস্থিতিতে সরকারের নিকট প্রণোদনা বা সহযোগিতা চাওয়াতে বিজ্ঞ আইনজীবীদের নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে অনেক শ্রেণী পেশার মানুষজনই বিভিন্ন ধরণের বাজে ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য করে আসছেন যা সমস্ত আইনজীবী সমাজকে হেয় প্রতিপন্ন করার শামিল।
আসলে গণতান্ত্রিক একটি দেশে জনগণের জন্যই সরকার।রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে সরকার আমাদের সবার অভিভাবক।মহা সংকটের এ মুহূর্তে তাই প্রয়োজন অনুসারে সরকারের কাছে প্রণোদনা চাওয়ায় এটা নিয়ে বাজে মন্তব্য করাটা নিতান্তই অযৌক্তিক বলে আমি মনে করি।আসলে এরকম মন মানসিকতার আমুল পরিবর্তন দরকার।
যাই হোক পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ও রাজকীয় এই পেশাকে আরো যথাযথ সম্মান ও মর্যাদা দেয়া দরকার।রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে সকল মানুষকে আইনের প্রতি এবং আইনের কারিগর হিসেবে আইজীবীদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা দরকার।
তানাহলে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলা আমাদের জন্য কঠিন নয় একেবারে অসম্ভব হয়ে পড়বে।
লেখিকা- আয়েশা সিদ্দিকা লোপা
আইনজীবী ও মানবাধিকারকর্মী
বার্তা বিভাগ প্রধান