চার বছরের ছোট্ট শিশু সিফাত। বাবা-মায়ের সঙ্গে রাজধানীর হাতিরঝিল থানাধীন মীরবাগ এলাকার ভাড়া বাসায় থাকে। বাবা ফিরোজ হাওলাদার পেশায় রঙমিস্ত্রি। সীমিত আয়ের সংসারে ভাড়া বাসায় থেকে স্ত্রী-সন্তানের মুখে দু’বেলা খাবার জোটাতেই হিমশিম খেতে হয় ফিরোজ হাওলাদারকে। এরমধ্যে মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘায়ের মতো ছোট ছেলে সিফাতকে অপহরণ করে অপহরণকারী চক্র। মুক্তিপণ হিসেবে চায় ৫০ হাজার টাকা। পুলিশের শরণাপন্ন হলে আট ঘণ্টার শ্বাসরুদ্ধকর অভিযানের পর বুধবার মধ্যরাতে মানিকগঞ্জের পাটুরিয়া ঘাট এলাকা থেকে উদ্ধার করা হয় সিফাতকে।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার জানান, শিশুটিকে উদ্ধার করা হয়েছে। অপহৃত সিফাতের বাবার এক সহকর্মী এই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। তার নাম মিলন। তাকে ধরতে অভিযান চলছে।
পুলিশ ও অপহৃত সিফাতের স্বজনরা জানান, গত বুধবার (২০ মে) বাসার সামনেই খেলছিল সিফাত। সকাল ১১টার দিকে হঠাৎ সে নিখোঁজ হয়ে যায়। ফিরোজ ও তার স্ত্রীর আর্তচিৎকারে আশপাশের লোকজন জড়ো হয়ে তন্নতন্ন করে খোঁজে বাসার চারপাশ। খবর পেয়ে ছুটে আসে ফিরোজের পরিচিত কয়েকজন রঙমিস্ত্রি, বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন। আলাদা আলাদাভাবে খোঁজা হয় পুরো এলাকা। মগবাজার, পেয়ারাবাগ, আমবাগান, পাগলা মাজার, মধুবাগ, নয়াটোলা, হাতিরঝিল, দিলু রোড, ইস্কাটন, রমনা, সাত রাস্তা, মহাখালী, রেলওয়ে স্টেশন, কাওরানবাজারে খোঁজ করেও সিফাতের সন্ধান পাওয়া যায়নি। দুপুর সোয়া একটার দিকে অজ্ঞাত একটি মোবাইল নম্বর থেকে সিফাতের বাবার মোবাইলে কল আসে। অপর প্রান্ত থেকে জানানো হয়, ‘সিফাতকে অপহরণ করা হয়েছে। ৫০ হাজার টাকা মুক্তিপণের বিনিময়ে সে তার ছেলেকে ফিরে পেতে পারে। পুলিশকে জানালে বা কোনোরকম চালাকি করলে ছেলের লাশের খোঁজও পাবে না’।
পুলিশ ও স্বজনেরা জানান, মুক্তিপণের কথা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে ফিরোজ হাওলাদারের। একবেলা রান্না করার মতো চাল নেই যার ঘরে, সে কীভাবে জোগাড় করবে ৫০ হাজার টাকা। পুরো বিষয়টি মোবাইল ফোনে হাতিরঝিল থানার অফিসার ইনচার্জ আব্দুর রশীদকে জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে সিফাতের বাবা। কিন্তু সিফাতের অপহরণের বিষয়টি হাতিরঝিল থানা পুলিশকে জানানো হয়েছে জানতে পারলে অপহরণকারীরা সিফাতকে মেরে ফেলতে পারে, এই ভয়ে পুলিশের সঙ্গে ফিরোজ হাওলাদারকে যোগাযোগ করতে দিতে চাইছিল না অপহৃত সিফাতের মা। পুলিশ তার সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করতে চেষ্টা করার একপর্যায়ে সিফাতের মা মোবাইল নম্বরটি বন্ধ করে দেয়।
পুলিশ জানায়, ঘটনাটি তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদারকে জানানো হলে তিনি দ্রুত সিফাতের বাসা খুঁজে তার মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে অপহৃত সিফাতকে উদ্ধারের নির্দেশ দেন। বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে ফিরোজ হাওলাদারের বাসা খুঁজে পায় হাতিরঝিল থানা পুলিশ। সিফাত অপহরণের বিষয়টি পুলিশকে জানানো হয়েছে অপহরণকারী তা টের পাবে না বুঝিয়ে আশ্বস্ত করা হয় অপহৃত সিফাতের বাবা-মাকে। এরপর পুলিশের পরামর্শে অপহরণকারীদের সঙ্গে মোবাইলে মুক্তিপণের বিষয়ে আলাপ চালিয়ে যেতে থাকে ফিরোজ হাওলাদার। অপরদিকে, তথ্য প্রযুক্তির সহায়তায় অপহরণকারীদের অবস্থান শনাক্ত শুরু হয়।
তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল জোনের এডিসি হাফিজ আল ফারুকের তত্ত্বাবধানে এস আই শরিফুল ইসলামের নেতৃত্বে হাতিরঝিল থানার একটি টিম অপহরণকারীদের তাড়া করে ডেমরা, মিরপুর, সাভার হয়ে রাত ১০.৫০ ঘটিকায় পাটুরিয়া ঘাটে পৌঁছে হাতিরঝিল থানা পুলিশের টিম। দুই বছর আগে তোলা সিফাতের একটি সাদাকালো ছবি সঙ্গে নিয়ে সিফাতকে উদ্ধারের অভিযান চলতে থাকে। রাত ১১টা ৪০ মিনিটের দিকে পুলিশ পাটুরিয়া ঘাটের পাশের একটি টংঘরের দেয়াল ঘেঁষে ঘুমন্ত অবস্থায় উদ্ধার করে সিফাতকে। এরপর গাড়ি থেকে ডেকে আনা হয় সিফাতের বাবাকে। বাবাকে দেখে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে সিফাত। পুলিশ ও বাবার কাছে সিফাত জানায়, ‘সে যখন বাসার বাইরে খেলছিল, তখন ‘মিলন মামা’ চকোলেট কিনে দেওয়ার কথা বলে দোকানে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাকে নিয়ে যায়।
হাতিরঝিল থানার ওসি আব্দুর রশিদ জানান, মিলন কয়েক মাস ধরে সিফাতের বাবার সহকারী হিসেবে কাজ করছিল। এ কারণে বাসায় প্রায়ই আসতো। মিলনকে মামা ডাকতো সিফাত। মিলনই সিফাতকে অপহরণ করেছিল বলে তারা ধারণা করছেন। মিলনকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে বলে জানান তিনি।
বার্তা বিভাগ প্রধান