চায়নায় তৈরি মেডেলটি দেখতে ভারি সুন্দর। ৬৫ মিলিমিটার ব্যাস আর ৫ মিলিমিটার পুরু মেডেলটির একদিকে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী সোনালী আঁশ নিয়ে কৃষকদের ব্যস্ততার চিত্র আর অন্যদিকে শহীদ মিনারের চিত্র খুদিত। সাথে ইংলিশ অলিম্পিয়াডের লোগোও আছে। মাহরুফা কামালের নকশাকৃত এ ধরনের মেডেল বাংলাদেশে কোনো অলিম্পিয়াড প্রতিযোগিতায় প্রথমবারের মতো দেওয়া হয়েছিল।
নান্দনিক মেডেলটি কেইবা হাতছাড়া করতে চাইবে! কিন্তু মোমিনুল হক ফাহিম ব্যতিক্রমী, মানবিক এক যুবক। অনেক সাধনার মেডেলটি তাই করোনার দুঃসময়ে তুললেন নিলামে। সেই মেডেল বিক্রি হলো ২০ হাজার টাকায়। অবশ্য নিলামে বিক্রির পরও মেডেলটি ফিরে এসেছে ফাহিমের কাছেই! নিলাম থেকে পাওয়া পুরো টাকা ফাহিম দিয়েছেন ‘ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার’ নামক সংগঠনের সিলেট বিভাগীয় শাখায়। করোনাকালে সংকটে আবর্তিত মানুষদের সহায়তা করছে এই সংগঠন।
শুধু কী এই এক মেডেল? মোটেও না। মোমিনুল হক ফাহিম করোনার কঠিন সময়ে উদ্যমীর মতোই এগিয়ে এসেছেন, করেছেন বেশ কয়েকটি মানবিক কাজ।
মোমিনুল হক ফাহিম সিলেটের অন্যতম বেসরকারি মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটির বিবিএ ৪র্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। সিলেট নগরীর মাছুদিঘীরপাড়ের ৬৪/বি নং বাসার মোহাম্মদ আব্দুল হক ও সুলতানা পারভীন লাভলী দম্পতির ছেলে।
পড়াশোনার বাইরে নানাবিধ সামাজিক-সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ফাহিম। নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের মডেল ইউনাইটেড নেশন্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক, ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার সংগঠনের জেলা সমন্বয়ক, দ্য হাঙ্গার প্রজেক্ট-বাংলাদেশ এর ফ্যাসিলিলেটর, ইংলিশ অলিম্পিয়াডের ক্যাম্পাস অ্যাম্বাস্যাডর তিনি।
বাংলাদেশে করোনা হানা দিল, ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়লো পুরো দেশে। সিলেটসহ সারা দেশই লকডাউন তথা অবরুদ্ধ অবস্থার মধ্যে থমকে গেল। বিপাকে পড়লেন খেটেখাওয়া, দরিদ্র মানুষ। কর্মহীনরা হয়ে পড়লেন অসহায়। ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) নিয়ে সর্বত্র হাহাকার। এই পরিস্থিতি নাড়া দিল মোমিনুল হক ফাহিমকে। ‘কিছু একটা’ করার তাগিদ থেকে নেমে পড়লেন ময়দানে। এরপরের গল্প এক ‘মানবিক যোদ্ধা’র।
করোনাকালে নিম্নআয়ের মানুষেরা খাদ্য সংকটে পড়েন। তাদের জন্য খাদ্যসামগ্রীর ব্যবস্থা করতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অভিনব এক ‘চ্যালেঞ্জ’ শুরু করেন মোমিনুল হক ফাহিম। গত ২৩ মার্চ থেকে এটি শুরু হয়। এর মাধ্যমে একজন ব্যক্তি তার সামর্থ্য অনুযায়ী অসহায় একজনকে খাদ্যসামগ্রী দেন। সেই খাদ্যসামগ্রীর ছবি তুলে ফেসবুকে নিজের আইডিতে শেয়ার করে ৫ জন বন্ধুকে ট্যাগ করে একই ধরনের কাজ করতে বলবেন।
ফাহিম বলছিলেন, ‘কোভিড-১৯ ফুড ডোনেট চ্যালেঞ্জ কার্যক্রমে জ্যামিতিক হারে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে যাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জের মাধ্যমে এখনও পর্যন্ত এক হাজার ৫০টি পরিবারের মধ্যে খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানো গেছে।’
দেশে করোনা হানা দেওয়ার পর ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রী (পিপিই) নিয়ে বেশ শোরগোল হয়। পিপিই সংকটের কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্বাস্থ্যসেবায় জড়িত অনেকেই। সিলেটে স্বাস্থ্যসেবার সাথে জড়িতদের পিপিই দিতে উদ্যোগ নেয় ‘করোনা ভাইরাস আপডেট’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপ। এই গ্রুপের অ্যাডমিন প্যানেলে আছেন মোমিনুল হক ফাহিম, আব্দুল্লাহ, নাবিল, মাহবুবুর, ফারহান, সিয়াম, নাজমুল, জালাল, মাহির, রাজু, নাঈম, মোরশেদ, আমিরুল, সালমান ও রাফি। মূলত করোনার বিসয়ে সঠিক তথ্য প্রচারের জন্যই এ গ্রুপ খোলা হয়।
পিপিই সংকটের বিষয়টি ফাহিমদের ভাবিয়ে তুলে। তারা ওই গ্রুপের উদ্যোগে ‘কালেক্ট ফান্ড টু প্রটেক্ট ডক্টর’ নামে ইভেন্ট শুরু করেন। তাতে সাড়াও মেলে হৃদয়বান মানুষের। এ ইভেন্ট থেকে সংগৃহিত অর্থ দিয়ে গত ২৩ এপ্রিল ৬০টি পিপিই কিনে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও শহীদ শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতালে উপহার হিসেবে প্রদান করা হয়।
করোনা পরিস্থিতিতে ঝুঁকি নিয়ে মাঠপর্যায়ে কাজ করছেন পুলিশ সদস্যরা। তাদের প্রতি সহমর্মিতা দেখিয়ে ৩০ জন পুলিশ সদস্যদের মাস্ক ও গ্লাভস প্রদান করেছেন ফাহিমরা। চলতি রমজানের প্রথম দিন পুলিশ সদস্যদের ইফতারও প্রদান করেন তারা। ‘করোনা ভাইরাস আপডেট’ গ্রুপের উদ্যোগে এ কাজ করা হয়।
গত ১১ এপ্রিল থেকে সিলেট জেলা লকডাউনের মধ্যে রয়েছে। বছরের প্রায় সবসময়ই যেখানে সিলেটে পর্যটকদের আনাগোনা লেগে থাকে, এবার এই সময়ে সেরকম কিছুই হচ্ছে না। সিলেটের বিভিন্ন স্থানের মানুষও চলাফেরা সীমিত করেছেন। ফলে হযরত শাহজালাল (রহ.) মাজারেও মানুষের ঢল নেই। মাজারে আগত মানুষেরা মাজার এলাকায় জালালি কবুতর ও পুকুরে গজার মাছদের খাবার দেন। কিন্তু দর্শনার্থী না থাকায় খাদ্য সংকটে পড়েছিল এসব কবুতর ও মাছ। এ নিয়ে একটি বেসরকারি টেলিভিশনে সংবাদ দেখে কবুতর ও মাছদের খাদ্য প্রদানের সিদ্ধান্ত নেন মোমিনুল হক ফাহিম। গত ২৯ এপ্রিল তিনি ও তার চাচাতো ভাই সালমান আহমেদ নাবিল মিলে শাহজালালের মাজারে এ খাদ্য প্রদান করেন।
ফাহিম জানান, তারা কবুতরকে ৪০ কেজি ধান ও পুকুরের গজার মাছকে ছোট আকারের পুঁটি ও মখা মাছ প্রদান করেন।
শুধু শাহজালালের মাজারই নয়, হযরত চাষনী পীরের মাজারের ক্ষুধার্ত বানরদের কলা প্রদান এবং জিন্দাবাজার, বন্দরবাজার, তালতলা, লামাবাজারসহ বিভিন্ন এলাকার রাস্তার অভুক্ত কুকুরদের খাদ্য প্রদানও করেছেন ফাহিম।
শুরুতে যে মেডেলটির কথা বলা হয়েছে, সেই মেডেলটি মোমিনুল হক ফাহিম নিলামে তুলেন গত ১ মে। মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটিতে ২০১৭ সাল থেকে ইংলিশ অলিম্পিয়াডের ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডরের কাজ শুরু করেন ফাহিম। তিন বছর পরিশ্রমের পর চলতি বছরেই ইংলিশ অলিম্পিয়াডে ‘বেস্ট ক্যাম্পাস অ্যাম্বাসেডর’ হিসেবে মেডেলটি পেয়েছিলেন তিনি। অনলাইন নিলামে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চীন প্রবাসী ব্যবসায়ী খাইরুল হাসান রনি ২০ হাজার টাকায় মেডেলটি কিনে নেন। তবে মানবিক মানুষ রনি মেডেলটি কিনে ফের ফাহিমকেই উপহার হিসেবে প্রদান করেন। নিলাম থেকে পাওয়া টাকা ইয়ুথ এন্ডিং হাঙ্গার, বাংলাদেশ নামক সংগঠনের তহবিলে দেন ফাহিম। এ সংগঠনের জেলা সমন্বয়ক হিসেবে তিনি নিজেও জড়িত।
নির্বাহী সম্পাদক