বাংলাদেশি মেয়ে সেঁজুতি সাহা। তিনি যখন সেই ছোট্টটি ছিলেন, দেখতেন রাতের বেলা খাবার টেবিলে কথা হচ্ছে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, সংক্রামক রোগ—এসব নিয়ে। খাওয়ার সময় এমন সব আলোচনা অনেকের কাছেই উদ্ভট ঠেকবে। কিন্তু সাহা পরিবারে এমনটাই হতো। সেঁজুতির বাবা ড. সমীর সাহা মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক। তিনি তাঁর বিজ্ঞান বক্তৃতার অনুশীলন করতেন বাড়িতে রাতের খাবার টেবিলে। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ নিয়ে তিনি যখন যা জানতে পারতেন, তা নিয়েও কথা বলতেন ওই টেবিলে। ওই সব আলাপ সেঁজুতির উপর বড় ছাপ ফেলেছিল। পরে তিনি নিজেকে একজন অণুজীববিজ্ঞানী হিসেবে গড়ে তোলেন। ডা. সেঁজুতি সাহা এখন তাঁর বাবার সঙ্গে শিশুস্বাস্থ্য গবেষণা ফাউন্ডেশনে (সিএইচআরএফ) কাজ করেন। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশে শিশুমৃত্যু কমিয়ে আনতে তাঁর বাবা প্রতিষ্ঠানটি গড়ে উঠতে সহায়তা করেছেন।
বাবা-মেয়ে দুজনে মিলে এখন বিশ্বে স্বাস্থ্য খাতের প্রভাবশালী দুই ব্যক্তি। শিশুমৃত্যু বেশি বিশ্বের এমন স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সঙ্গে সম্পদশালী দেশগুলোর স্বাস্থ্যসেবার ফারাক কমাতে কাজ করছেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে তাঁরা উপাত্ত, রোগ নির্ণয়ের সর্বাধুনিক পদ্ধতি এবং সংক্রামক ব্যাধির বিরুদ্ধে টিকাদানকে কাজে লাগাচ্ছেন। তাঁদের গবেষণা শুধু বাংলাদেশেই ব্যবহৃত হচ্ছে না, বরং একই রকম স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশেও কাজে লাগানো হচ্ছে।
শিশুদের জন্য সরকারের গৃহীত টিকাদান কর্মসূচি এবং স্বাস্থ্যসেবায় জোরালো সহায়তার পাশাপাশি সিএইচআরএফের কাজের সুবাদে বাংলাদেশ পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার অব্যাহতভাবে কমিয়ে আনছে ও সার্বিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রগতি অব্যাহত রেখেছে। ১৭ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশে টিকাদান কর্মসূচির আওতা এখন ৯৮ শতাংশে পৌঁছেছে।
ড. সমীর রাজধানীর ঢাকা শিশু হাসপাতালের অণুজীব বিভাগেরও প্রধান। শিশুমৃত্যুর বড় দুই ঘাতক ব্যাধি মেনিনজাইটিস ও নিউমোনিয়া। এ দুই রোগের টিকা ব্যবহারে বাংলাদেশকে সহায়তায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে সমীর সাহার। টিকাগুলো যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য ধনী দেশে সহজলভ্য হলেও বাংলাদেশের মতো স্বল্প আয়ের দেশে সহজলভ্য ছিল না। এসব রোগের তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহে তিনি কাজ করে গেছেন নিরলসভাবে। ওই দুই রোগের টিকা চালু করার জন্য তাঁর এসব তথ্য–উপাত্ত দারুণভাবে সহায়তা করেছে জনস্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারকদের। ইতিমধ্যে হাজারো মৃত্যু প্রতিরোধ করেছে ওই টিকা।
দরিদ্র দেশগুলোতে অনেক রহস্যজনক রোগে আক্রান্ত হয় নবজাতক ও শিশুরা। এসব রোগ শনাক্তের সহজ উপায় খুঁজে বের করার ওপর জোর দিয়েছেন সেঁজুতি। ২০১৭ সালে বাংলাদেশে শিশুদের মধ্যে মেনিনজাইটিসের সংক্রমণ হঠাৎ অনেক বেড়ে যায়। কিন্তু এর কোনো ব্যাখ্যা মিলছিল না। সেই সময় সেঁজুতি শিশুদের জিনগত উপাদান বিশ্লেষণ করে এর রহস্য উন্মোচনে সক্ষম হন। (তিনি উদ্ভাবন করেন, চিকুনগুনিয়া জ্বরের বিস্তারের কারণেই মেনিনজাইটিসের প্রকোপ বেড়েছে। আর চিকুনগুনিয়ার ভাইরাস ছড়ায় মশার মাধ্যমে।) কিন্তু রহস্য সবিস্তারে জানতে নমুনা সংগ্রহ করে তা বিশ্লেষণের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে পাঠান তিনি। তখন থেকে তিনি বাংলাদেশে এ রোগনির্ণয়ে স্বল্পমূল্যের একটি উপকরণ বের করেন, যাতে ভবিষ্যতে মেনিনজাইটিস ও অন্যান্য প্রাণঘাতী ব্যাধির বিস্তার দ্রুত মোকাবিলায় দেশকে সহায়তা করা যায়।
নিজেদের গবেষণার মাধ্যমে বাবা–মেয়ে যেসব তথ্য সংগ্রহ করেছেন, তা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে রোগনির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অনেক সম্পদেরই ঘাটতি রয়েছে। সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে রোগ মোকাবিলায় সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করছে সিএইচআরএফের সংগৃহীত তথ্য। নতুন টিকা তৈরিতেও ব্যবহৃত হচ্ছে এসব তথ্য।
বাংলাদেশের যদিও অবস্থার উন্নতি হয়েছে, তবু দেশটির এখনো অনেক পথ যাওয়ার বাকি। এ বছর এক অনুষ্ঠানে বক্তব্যে সেঁজুতি তাঁর কাজের গল্প শুনিয়েছেন। যে গল্পে ছিল বাংলাদেশে এখনো রয়ে যাওয়া বড় স্বাস্থ্যগত নানা চ্যালেঞ্জের কথা। বাংলাদেশের শিশুদের চিকিৎসায় সর্বাধিক সুবিধাসংবলিত হাসপাতাল ঢাকা শিশু হাসপাতাল। সেখানেও প্রতিবছর ভর্তি না হতে পেরে ফিরে যায় ছয় হাজারের বেশি শিশু। কারণ, হাসপাতালটির ৬৬৫ শয্যা সব সময় রোগীতে পূর্ণ থাকে। এসব শয্যার বেশির ভাগে এমন রোগীরা থাকে, যারা প্রতিরোধযোগ্য রোগে আক্রান্ত। অথচ এ হাসপাতাল থেকে এমন অনেক শিশু ফিরে যায়, যাদের জরুরি চিকিৎসাসেবা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ যদি রোগ প্রতিরোধে আরও বেশি কিছু করতে পারে, তবে প্রতিরোধ করা যায় এমন সব অসুস্থতার দিকে আরও মনোযোগ দেওয়ার জন্য তার সম্পদ কাজে লাগাতে পারবে। সমীর ও সেঁজুতির কাজের কল্যাণে বাংলাদেশ এমন এক ভবিষ্যতের দিকে এগোচ্ছে, যেখানে সংক্রামক ব্যাধি কমে আসবে। আর চিকিৎসার জন্য খালি থাকবে হাসপাতালের শয্যা।
বাবা ড. সমীর সাহা ও মেয়ে সেঁজুতি সাহাকে নিয়ে নিজের ব্লগ ‘গেটসনোটে’লিখেছেন বিল গেট
বার্তা বিভাগ প্রধান