ওই যে দেখছো থাকের পরে থাক সাজানো গাছ, ওই হলো চা -গাছ আর ওই হলো চা -বাগান। ওখানে গেলেই দেখতে পাবে পাহাড়ের চূড়োর ওপর কী সুন্দর সব ইংরেজ সাহেবদের বাংলো। দেখলে চোখ জুড়িয়ে যাবে। এই ইংরেজ জাতিটা কি পারলো না! গহিন অরণ্য কেটে গুঁড়িয়ে দিয়ে একেবারে থাকে থাকে সাজিয়ে ফেলেছে সবুজের গালিচায়। রাধিয়া চোখ মেলে দেখে আসামের উঁচু নিচু টিলা পেরিয়ে রেলগাড়ি চলছে তো চলছেই। দুইদিন দুইরাত পেরিয়ে গেলো, গঞ্জুরাম সর্দার এখনো গন্তব্যে নিয়ে যেতে পারলো না রাধিয়া আর শ্রীচরণকে। এই দূরের পথ যে এমন হবে জানলে রাধিয়া এদেশে আসতো না, আস্তে আস্তে শ্রীচরণের কানে বললো।
বলি, এই যে তুমি গঞ্জুরামের কথায় এই দূরদেশে যাচ্ছো বলি দুইদিন দুইরাত গেলো এখনো সে দেশে যাওয়া হলো না। ভগবান জানে গঞ্জুরাম আমাদেরকে কোন দেশে নিয়ে যায়। সেই দেশের নাম কি গো! দেশের নাম হামার কুছু জানা নাই রাধিয়া! চুপ কর তুঁ। কাল বিহান বেলায় চা-বাগানকে দেশ মে পৌঁছ যাঁয়েগে।
গঞ্জুরাম শুনলে যদি এই বনের পথেই নামিয়ে দেয়, তখন আমরা কোথায় যাবো ? আমরা তো পথের কিছুই চিনি না। তাই রাধিয়াকে বেশি কথা বলতে না করে দেয় শ্রীচরণ।
শ্রীচরণের কথা শুনে রাধিয়া তার দৃষ্টি ফিরিয়ে আনে রেলগাড়ির কামরায়। তার বুকের ভেতর কাঁপুনি দেয় আবার ভবিতব্যের ইঙ্গিত। এমন সময় মনে পড়ে দেশের মাটিতে বাপ – মা, ভাই-বোন সবাইকে রেখেই রাধিয়া অচিন দেশে চলে যাচ্ছে ; কী যে হয় সেখানে! গঞ্জুরাম বলেছে চা-বাগানে গেলেই দুজনকেই কাজ দিয়ে দেবে ইংরেজ সাহেবরা, থাকার জন্য ঘরও দেবে। কিন্তু সেই ইংরেজ সাহেবদের চা-বাগানের দেশে যেতে যে এতদূর আসতে হবে, তা কী তার জানা ছিলো! এমন হবে জানলে রাধিয়া নিজের মুল্লুকেই না খেয়ে মরে যেতো, তবুও আসতো না। রেলগাড়িতে বসে থেকে তার শুধু ঝিমুনি আর ঝিমুনি পাচ্ছে, রাধিয়ার মন বিষিয়ে গেলো। রাত আর ভোর হয় না। রাধিয়া চুপ করে থাকে আর কথা বলার শক্তি নেই তার। কখন কি বলে দেয়, আর গঞ্জুরাম শুনে ফেলে; তাহলে বিপদ হবে। এমন সময় ধরা গলার চিৎকার শুনে তার মৌনতা ভেঙে গেলো। আকাশ চিরে রেলের হুইসেল বেজে উঠলো। কালো ধোঁয়ার মতো কুয়াশায় চারদিক নিমগ্ন; তারই মাঝে রেলের ব্রেক বন্ধ হওয়ার শব্দ শোনা গেলো। ছোট একটি স্টেশন ঘরের সামনে রেল থেমে যায়। গঞ্জুরাম তাড়াহুড়ো করে নামতে লাগলো এবং রাধিয়া ও শ্রীচরণকে নামতে সাহায্য করছে। নেমে পড়লো তিনজনেই। চারদিকে স্টেশনে হৈ-চৈ। যাত্রীর দল এদিক থেকে সেদিক ছুটোছুটি। গঞ্জুরাম নিঃশব্দে আগে আগে হেঁটে যাচ্ছে, পেছনে শ্রীচরণ আর রাধিয়া চলেছে। স্টেশন পেরিয়ে কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর গঞ্জুরাম ভাবছে কিভাবে তাদেরকে মানাবে। এতোদূরের পথ হেঁটে যেতে যদি না চায় তারা! তখন কি হবে! খালি হাতে ফিরে গেলে বড় সাহেব হয়তো তার জরিমানা করে দেবে। যদি এদেরকে কোনোভাবে চা-বাগান পর্যন্ত নেওয়া যায়, তাহলে বড় সাহেব কিছুটা প্রসন্ন হবে, বখশিস পেলেও ভালো না পেলেও ভালো; অন্তত জরিমানা থেকে তো রেহাই পাবে সে। বড় সাহেব কড়া করে বলে দিয়েছে দু-চারজন নতুন শ্রমিক তাকে যোগাড় করতেই হবে। তাই তো গঞ্জুরাম খুব করে শ্রীচরণকে ভুলিয়ে ভালিয়ে রাঁচি থেকে আসাম পর্যন্ত নিয়ে এসেছে। এখন ভালোয় ভালোয় চা-বাগান পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে বড় সাহেব আর ছোট সাহেবের চোখের সামনে তাদেরকে হাজির করতে পারলেই মুক্তি।
বাগানে চারদিকে কুয়াশায় জমাট বাধা অরণ্যাঞ্চলের পথ। তীব্র হিমেল বাতাস। গঞ্জুরাম বলেছিলো, পথে কোনো কষ্টই হবে না, রেল থেকে নেমেই চা-বাগান। কিন্তু রেল থেকে নেমে গঞ্জুরাম বলে উঠে, __
“ থোড়া দূর পয়দল জানেকো হ্যয়।
শ্রীচরণ বলে ওঠে, “পয়দল যানেকো হ্যয় ? কিতনে দূর ?”
“জ্যায়াদা দূর নহি হ্যুয়, থোড়া জোরসে চলো।”
পথচলা শুরু হলো। প্রথম দু’একমাইল ভালই লাগলো হাঁটতে। চা-বাগানের নতুন পরিবেশ। চারদিক কেবল সবুজ আর সবুজ। এমন সবুজের সমাহার রাধিয়া জীবনে কখনো দেখেনি। সে রাজপুত ঘরের মেয়ে। শ্রীচরণও রাজপুত। বিবাহিত জীবনটা আর নিজের দেশে থাকতে পারলো না। দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ চলছিলো। জীবনটাই বাঁচানো দায় হয়ে পড়েছে, তাই দেশ ছেড়ে চলেছে তারা অন্যত্র কাজের সন্ধানে, খাদ্যের সন্ধানে। কিছুদূর পথ চলার পর সমতল পথ হঠাৎ শেষ হয়ে যায়। দুধারে জঙ্গলভরা চড়াই উতরাইয়ের পথ আর কতো দূর যে যেতে হবে, শ্রীচরণ জানে না। আগে আগে গঞ্জুরাম হাঁটছে, তার পেছনে শ্রীচরণ, আর তার পেছনে রাধিয়া পুটলিতে দু’চারটে কাপড়চোপড় নিয়েছে, তাকেই বুকের সাথে আগলে রেখে হাঁটছে। এমন চড়াই উতরাই পথ তারা কখনো হাঁটেনি। গাছ থেকে টুপটাপ করে শিশির ঝরছে। জঙ্গলের ভেতর দিয়ে সরু পথ। দুদিকে জঙ্গল আর জঙ্গল। কেবল অন্ধকার হয়ে আসে চারদিক। কোন গাছের কি পাতা কিছুই বুঝা যায় না। একটি গাছপালা আরেকটি গাছের সাথে জংলি সব গুল্মলতায় জটলা বেঁধেছে। পথে সাপ, বিচ্ছু কত যে কি দেখে রাধিয়ার প্রাণ যায় যায়, তবুও পথ হাঁটছে। মাঝে মাঝে গুইসাপ এসে তাদের পথ রোধ করে, তারই মাঝে বনের ভেতর থেকে কিসব অজানা অচেনা পতঙ্গের শব্দ ভেসে আসছে। ঝাঁ ঝাঁ করছে চারদিক। সেসব শব্দ ভয়ানক, গা ছমছম করার মত, কিন্তু হেঁটে যেতেই হবে। পেছনে ফিরবার মত কোনো সুযোগ নেই, কেবল সামনের দিকেই এগিয়ে যাওয়া, যতই বাধা-বিঘ্ন আসুক।
তাদের মনকে সান্ত্বনা দিতে গঞ্জুরাম মাঝে মাঝে কিছু চটক বাক্য বলে তাদেরকে বুঝিয়ে দেয় যে এ আর এমন কি! ক্ষুধার অন্ন যোগাতে বীরেরা এইভাবেই অজানার পথে পা বাড়ায়, তাই শ্রীচরণ সস্ত্রীক এখানে এই চা-বাগানে এসে কোনো ভুলই করেনি। না খেয়ে মুল্লুকে মরে যাওয়ার চেয়ে খেটে খুটে পেটের অন্ন যোগানো তো কোনো অন্যায় নয়; চটক কথা বলার পরেই বলে ওঠে, ‘এইতো এসে গেলাম।’
গঞ্জুরামের এমনতর কথা শুনে, শ্রীচরণ ঠিক ঠিক নিজেকে বীর বলে ভাবতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি, কারণ খেটে খাওয়া তো বীরের মতোই। খেটে খেলে নিজেকে বীর ভাবতে তার তাই কোনো দ্বিধা নেই, আর তাইতো বীরের মতো সে দুর্ভিক্ষ পীড়িত এলাকা ছেড়ে সে বীরের মতই হেঁটে চলেছে অজানার পথে। কোথায় যাচ্ছে তা অজানা কিন্তু ভাগ্যের সন্ধানে ছুটেছে।
গঞ্জুরামকে চা -বাগানের ইংরেজ সাহেব পাঠিয়েছে যেভাবেই হোক দেশে গিয়ে দুর্ভিক্ষ এলাকা হতে সরল সহজ মানুষগুলোকে ভুলিয়ে ভালিয়ে চা-বাগানে কাজের কথা বলে নিয়ে যেতে। কারণ তার আগে যেসব মানুষকে তারা নিয়ে গেছে চা-বাগানে তাদেরকে ডেরায় রেখেছে। সেখানে দলে দলে মানুষগুলো একই স্থানে থাকে আর চা -বাগানে কাজ করে। রোদে পোড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে, রক্তচোষা জোঁক তাদের দেহের রক্ত চুষে নিত্যদিন, হিংস্র জীবজন্তুর থাবায় আঘাতপ্রাপ্ত হয়, আর জংলি মশকের আক্রমণে ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়ে দলে দলে মানুষ মরে গিয়ে চা-বাগানে শ্রমিক সংখ্যা হ্রাস পেয়েছে। কোম্পানি চলবে কি করে ?
বড় সাহেব আর ছোট সাহেবের এখন একটাই চিন্তা, চা-বাগানে নতুন মানুষ আনতেই হবে। তাই গঞ্জুরামকে কিছু লোভ দেখিয়েছে ছোট সাহেব, সে যদি তার দেশে থেকে কিছু নতুন মানুষ নিয়ে আসে তবে তাকে পুরস্কার দেওয়া হবে। তাই গঞ্জুরাম যেভাবেই হোক কিছু মানুষ সে নিয়ে গেছে ঝারখন্ড থেকে নিয়েছে, উড়িষ্যা থেকে নিয়েছে, পাটনা থেকে নিয়েছে। সেই কাজে সে অসফল হলে তার ঘাড়েই মাথা থাকবে না। ইংরেজ সাহেবেরা এমন শাস্তি দেবে তাকে সে জানে। তাই নিজের জীবন বাঁচাতেই অন্যদেরকে নিয়ে যায় চা-বাগানে কাজ পাইয়ে দেওয়ার লোভ দেখিয়ে। চা-বাগানে কাজের ব্যবস্থাও হয়ে যায় তাদের এবং সেইসাথে আজীবন চা-বাগানের দাসত্বের শৃঙ্খলে বন্দী হয়ে যায় তাদের জীবন এবং ভবিষ্যৎ বংশধর। এসব কথা কাউকে বলে না গঞ্জুরাম। সে শুধু সেই কথাই বলে যে, চা-বাগানে সে তাদেরকে কাজের ব্যবস্থা করে দেবে এবং তাদের থাকার জন্য একটি ঘরের ব্যবস্থাও করে দেবে । যেখানে জীবন মরণের প্রশ্ন সেখানে যদি একটি কাজের ব্যবস্থা এবং আশ্রয় পাওয়া যায় সেটি অনেককিছুই। তাই শ্রীচরণ আর রাধিয়ার মতো আরো অনেক মানুষ এসেছে।
অনেক চড়াই উতরাই পথ পেরিয়ে তারা এসে যখন পৌঁছালো, তখন চা – বাগানের ডেরায় যেতে চোখে পড়লো বড় সাহেবের বাংলো পাহাড়ের ওপারে উঁচু টিলার চুড়ায় যেন অনিন্দ্য সুন্দর এক জীবনছবি। নির্জন বাংলোর মাথাটা দেখা যাচ্ছে অনেক দূর থেকে। তার ত্রি-সীমানায় বিনা অনুমতিতে কারও সাধ্য নেই প্রবেশের। শুধু ইংরেজরাই সেখানে অফিসিয়াল কাজের জন্য মাঝে মাঝে গিয়ে বাংলোর ঝুল বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে চা- পান করে আর কাজ করে। আরো কিছুদূর অতিক্রম করতেই ছোট সাহেবের বাংলো, নয়নাভিরাম! রাধিয়া আর শ্রীচরণ অবাক চোখে শুধু দেখে, ভাবে এই পাহাড়ের ভেতর এমন সুন্দর এসব কি দেখছে তারা ? সেসব বাংলোর লাল লাল চূড়া দেখা যাচ্ছে দূর থেকে। অপরূপ শুধু অপরূপ । তার পরে চা-বাগানের ছোট ছোট সব অফিস ঘর, চারদিকে শুধু চা-গাছ আর চা-গাছ। বাহারি ফুলের সৌরভ। এমন পরিবেশ প্রকৃ্তি রাধিয়া আর শ্রীচরণ কোথাও কখনো দেখেনি, আর এসেই যে এতোসব দেখবে এমন কথাও ভাবেনি। নিরিবিলি নির্জন পথ, শান্ত জলের ছোট ছোট নালা, দূর থেকে ঝরণার জল ঝরছে দেখা যাচ্ছে। সেই ঝরণার জল চুঁইয়ে এসে পড়েছে পাহাড়ি পথের ওপর। ঝরণার জল কী স্বচ্ছ। বাংলো থেকে শুরু করে এসব পথের গল্প বলতে বলতে গঞ্জুরাম যে কতদূর পথ তাদেরকে পায়ে হাঁটিয়ে নিয়ে এসেছে তা তাদের বোধগম্য নয়।
এইভাবে কতদূরের পথ হেঁটে এসে চা-বাগানে গঞ্জুরাম তাদেরকে নিয়ে রাতেরবেলায় শ্রমিকদের ডেরায় রাখে। পরদিন সকাল সকাল অফিস ঘরের সামনে নিয়ে যায় শ্রীচরণ আর রাধিয়াকে। বড় সাহেবের কাছে গিয়েই যে হাত ঠেকিয়ে সেলাম সাহেব, হুজুর মা-বাপ বলতে হবে, কথাটি গতকাল রাতেরবেলায় গঞ্জুরাম তাদেরকে শিখিয়ে দিয়েছে; তবুও অফিস ঘরের সামনে যাওয়ার সময় পথের মধ্যে পুনরায় বার কয়েক স্মরণ করিয়ে দেয়। এবার শ্রীচরণ রাধিয়াকে সাবধান করে বলে, “সাহেবকো দেখকর সেলাম ঠুকনে ভুলানা মত। কুছ গড়বড় হোনেসে সবকুছ মিট্টিমে মিল যায়েগা।” ঠিক এই কথাই গঞ্জুরামও বহুবার বলেছে তাদেরকে। এখন শ্রীচরণ এই কথাই রাধিয়াকে বলে যাচ্ছে।
রাধিয়া কখনো এইভাবে কোনো ইংরেজ সাহেবকে দেখে সেলাম ঠুকেনি। ইংরেজ সাহেব দেখতে কেমন তাও সে জানে না। পথে যেতে যেতে, তাই সে নিজেকে প্রস্তুত করে নিচ্ছে। সাহেবকে দেখেই সেলাম ঠুকতে হবে।
অফিস ঘরের সামনে গিয়ে গঞ্জুরাম চৌকিদারকে ডেকে তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফুসুর ফুসুর করে বলে, “ বড়া সাহেব আয়া হ্যায় ?”
চৌকিদার মাথা নেড়ে জানান দেয়, বড় সাহেব এসেছেন।
গঞ্জুরামের মাথা ঝিম ধরে আসে। বড় সাহেব তো এসেছেন, কিন্তু এখন বড় সাহেবের কান পর্যন্ত এই সংবাদ কে পৌঁছাবে ? সে যে দুজন নতুন লোক যোগাড় করে এনেছে মুল্লুক থেকে চা-বাগানের কাজের জন্য। অফিসঘরের দুয়ারে সাদা সিল্কের পর্দা পাহাড়িয়া হাওয়ায় দোল খাচ্ছে। গঞ্জুরামের ইচ্ছে হয় সাদা দোলখাওয়া পর্দার ফাঁক দিয়ে যদি একটিবার সে বড় সাহেবের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারে তাহলেই সে রাধিয়া আর শ্রীচরণের কথা জানিয়ে দিতে পারে। কিন্তু অফিস ঘরের পর্দা পর্যন্ত যাওয়া গঞ্জুরামের ইখতিয়ার নেই।
তাই গঞ্জুরাম অফিস ঘরের সিঁড়িতেই বসে ফাঁক ফোকড় খুঁজছে কিভাবে বড় সাহেবকে খবরটা দেওয়া যাবে! শ্রীচরণ আর রাধিয়া জপমালার মতো মনে মনে সেলাম সাহেব কথাটাকে মুখস্থ করছে শিরীষ গাছের ছায়ায় কাঁকড়ভরা লালমাটির পথের ওপর বসে। বহু বহু সময় পর ছোট সাহেব কাচের গ্লাসে পানি হাতে নিয়ে বারান্দায় আসেন কুলকুচি করবেন বলে, অফিসে তখন চা-বিরতি। বাইরে এসে দেখে গঞ্জুরাম সিঁড়িতে বসে আছে। ছোট সাহেবকে বাইরে আসতে দেখে গঞ্জুরাম তাড়াহুড়ো করে সিঁড়ি থেকে উঠেই বড় করে সেলাম ঠুকে বলে, হুজুর মা -বাপ! আমি দুজন নতুন মানুষ এনেছি, দয়া করুন হুজুর, তাদের কাজের ব্যবস্থাটা আপনাকে করতে হবে, আর বড় সাহেবের কাছে কথাটা আপনাকেই বলতে হবে। অনেক দূর থেকে নিয়ে এসেছি হুজুর।
ছোট সাহেব ভুরু কুচকে বলে ওঠে, “ ঠিক হ্যয়, ঠিক হ্যয়” কথাটি উচ্চারণ করতে গিয়ে ছোট সাহেবের মুখ বিকৃ্ত হয়ে গেলো, কিন্তু উচ্চারণ না হলেও তাদেরকে এইভাবেই ভাঙা হিন্দুস্তানী ভাষায় কথা বলতে হয়। চা-বাগানের লোকেরা তো তাদের ইংরেজি বুঝবে না। বাংলাটাও বুঝে না, বলাটা তো দূরের কথা। সঠিক অনুচ্চারিত ঠিক হ্যয় কথাটি বলতে বলতে ছোট সাহেব কুলকুচি করে অফিসের ভেতরে চলে গেলেন এবং দ্রুতই বড় সাহেবের কানে সেই কথা চলে গেলো যে, দুজন নতুন লোক এসেছে এই চা-বাগানে, গঞ্জুরাম নিয়ে এসেছে। তাদেরকে কাজ দিতে হবে। বড় সাহেব তো মহাখুশি। ম্যালেরিয়ায় অগণিত চা-শ্রমিক মরে যাচ্ছে । নতুন শ্রমিকের আগমনে বড় সাহেব যারপরনাই খুশি হন। তাই রাধিয়া আর শ্রীচরণের কাজের কথাটি ইয়েস হয়ে গেলো সঙ্গে সঙ্গে । ইয়েস করে দিলে ছোট সাহেব বাইরে এসে দাঁড়ালে গঞ্জুরাম শ্রীচরণ আর রাধিয়াকে ছোট সাহেবের সামনে এনে দাঁড় করায়। শ্রীচরণ আর রাধিয়া হাত তুলে সমস্বরে সেলাম সাহেব, হুজুর মা-বাপ বলে একটা ধ্বনি করলো, সেই ধ্বনি চা-বাগানের নির্জনতায় কোথায় মিলিয়ে গেলো, তা তারা দুজনের কেউ জানলো না; আর সেইসাথে চিরজীবনের জন্য সেলাম সাহেম কথাটি দুজনেরই মুখস্থ হয়ে গেলো। আর ভুল হবে না কখনো। সাহেবকে দেখলেই সেলাম ঠুকতে আর কোনো বাধা থাকবে না। সেই সেলামের সাথে সাথে চা-বাগানের খাতায় শ্রীচরণ আর রাধিয়ার নাম উঠে গেলো।
(২)
চা-বাগানের খাতায় চিরজীবনের জন্য শ্রীচরণ রাজপুত আর রাধিয়া রাজপুত নাম উঠে গেলে, ছোট সাহেব গঞ্জুরামকে সাথে নিয়ে তাদের জন্য ঘর ঠিক করতে গেলো শ্রমিক লাইনে। সেসব লাইনের নম্বর রয়েছে। এক নম্বর লাইন, দুই নম্বর লাইন, তিন নম্বর লাইন। এইভাবে লাইনের পর লাইন রয়েছে। কে কত নম্বর লাইনে থাকে, কার ঘর কোনটি এসব সাহেবদের নখদর্পণে থাকে। সন্ধ্যার পর সেসব লাইনে চৌকিদার পাহারা দেয়। রাতের অন্ধকারে কোনো শ্রমিক যেন চা-বাগান ছেড়ে পালিয়ে না যায়। চা-বাগানের ডেরায় ছোট ছোট ঘর, সেই ঘরের কোনো একটি ঘর ফাঁকা ছিলো, সেটি শ্রীচরণকে দেওয়া হলো। শ্রীচরণ তার কয়েকদিনের দিনের ক্লান্তি মুছবার জন্য যে একটি আশ্রয় পেয়ে গেলো এ যেন তার পরম সৌভাগ্য। রাধিয়া আর শ্রীচরণ এখন চা-বাগানের নতুন বাসিন্দা। নতুন শ্রমিক। পাশের ঘরে অন্য শ্রমিকেরা বাস করে। শ্রীচরণ আর রাধিয়া কোনোরকম রাতটুকু কাটিয়ে দিয়ে সকালবেলায় পাশের ঘরের শ্রমকিদের সঙ্গে পরিচিত হতে গেলো। পুরনো শ্রমিকেরা তাদেরকে শক্তি সাহস যোগায়, তাদেরকে একবেলার অন্ন দিয়ে সাহায্য করে। এমন আতিথেয়তা তাদের জন্য ভগবানের কৃপা পাওয়ার মতো। নাহলে এই অচেনা দেশে এসে অন্য কারো ঘরে একবেলা অন্ন গ্রহণ সে তো সুদূর পরাহত! শ্রীচরণ ভাবে বুঝি ভাগ্যটা ফিরে যাবে এবার এই সবুজ পাতার দেশে। তাই মনের ভয় কিছুটা কেটে যেতে লাগলো। এইভাবে একদিন যায়, দুইদিন যায়, রাধিয়া আর শ্রীচরণ সংসার পাতে চা-বাগানের নতুন ঘরে, নতুন পরিবেশে। রাধিয়া চা-পাতা তুলতে পারে না। পিঠে চা-পাতার খারা ঝুলাতে জানে না। বেতের তৈরি নতুন খারায় তার হাত কেটে গেছে। পায়ের আঙ্গুলের চিপায় রক্তচোষা জোঁক তার রক্ত চোষে। রাধিয়া ভয়ে কাজে যেতে চায় না। মাঝে মাঝে সাঁই সাঁই করে সাপ এগিয়ে আসে তার দিকে, সে কাজ ছেড়ে পালিয়ে যায় পথের ধারে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রথম যেদিন সে চা-বাগানে গেলো কাজ করতে সেদিন তার দুই পা কেটে গেলো। কিভাবে তার পা কেটে গেলো সে বুঝতেই পারেনি। মাথার ওপর তপ্ত রোদ। রোদে পোড়ে যায় তার সারা দেহ। দুইদিনেই রাধিয়া রোদে পোড়ে জ্বরে পড়েছে।
শ্রীচরণ অসহায়, কি করবে, কোথায় যাবে! এ তো এমন জ্বর নয়। রাধিয়ার জ্ঞান থাকে না। এ তো জ্বর। শুধু যে জোঁক চা-বাগানের মানুষের দেহের রক্ত চুষে এমন নয়, জংলি মশাও তাদের রক্তের মধ্যে সংক্রামক ছড়িয়ে দেয় রক্ত চোষার সময়। সর্দার, চৌকিদার ইংরেজ সাহেবরাও তাদের রক্ত চুষে। রাধিয়া মাত্র কয়েকদিনের মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়ে পড়ে থাকে মাটিতে। শ্রীচরণ মাথার কাছে বসে থেকে আবার চলে যায় কাজে। কাজ না করলে খাবার জোটবে না। রাধিয়া শূন্য ঘরে একলা পড়ে থাকে। এইভাবেই রাধিয়া কখনো ম্যালেরিয়া, কখনো কলেরায় ভোগে।
এইভাবে চলতে থাকলে তাদের জীবন চালানো কষ্টের হবে। এমনিতেই সপ্তাহান্তে রাধিয়া পাবে তিনআনা। যদি কোম্পানির দেওয়া নিরিখ পূরণ করতে পারে। প্রতিদিন যে নির্দিষ্ট পাউন্ড চা-পাতা গাছ থেকে তুলতে হবে, তার কম হলে এই তিনআনা পুরো ভাগ্যে জুটবে না। তখন না খেয়ে মরতে হবে। রাধিয়া ভাবে, এই দূরদেশে এসেও এত কষ্টের পরেও যদি না খেয়েই মরতে হয় তবে কেন নিজের মুল্লুক ছেড়ে আসলাম! এই চা-বাগানে শুধু চা-পাতা তোলা ছাড়া আর অন্য কোনো কাজ নেই, রাধিয়া কিভাবে বাঁচবে ? তিনআনা যদি না আনতে পারে সপ্তাহে তাহলে বাঁচা দায়। কাজে না গেলে সাহেবরা চা-বাগান থেকে বের করে দেবে। থাকার জন্য যে ঘরটি শ্রীচরণ পেয়েছে, তা ছেড়ে দিতে হবে। কারণ দুজনের নাম চা-বাগানের খাতায় উঠেছে তাই একটি ঘর তারা পেয়েছে থাকার জন্য, রাধিয়া যদি কাজে না যায় তাহলে ঘর পাবে না। শ্রীচরণ একা কাজ করলে ঘর ছাড়তে হবে। চৌকিদার এসে সকাল সকাল জানিয়ে গেছে।
রাধিয়া ঘরে বসে কাঁদে। এই দেশে যে কেন এলো শ্রীচরণ! এই মরার দেশ, এখানে এতো জোঁক, এতো জংলী মশা, এতো সাপ-বিচ্ছু, এতো রোগ-শোক, সাহেব, বাবু সর্দার আর চৌকিদারদের এতো শাসন বারণ! প্রতিদিন মানুষ মরে। কেউ বসন্তে মরে, কেউ ম্যালেরিয়ায় মরে, কেউ কলেরায় মরে … রাধিয়া রোজ রোজ নিজের মৃত্যু কামনা করে, কিন্তু তার মরণ নেই। চৌকিদার বলে গেছে কাল থেকে কাজে না গেলে বড় সাহেবের কাছে গিয়ে কারণ দর্শাতে হবে। কি কারণে কাজে যায়নি রাধিয়া। সেই ভয়ে রাধিয়া পরদিন সকালবেলায় কাজে চলে যায়। দুটো পাতা তুলে, আবার নিজের পায়ের দিকে খেয়াল করে দেখে । আবার দুটো পাতা তুলে আবার নিজের হাত পা দেখে, এইভাবে তো কাজ হয় না। সর্দার হেঁকে ওঠে, বলে __ “ তুমকো কা ইয়ে পাত্তি তোরনা আতা নাহি ? খায়েগা ক্যায়া ? সাহেব জানেগা তব বাগানসে নিকাল দেগা। হাত চলাকর পাত্তি তোড়ো।” সর্দারের কথা শুনে ভয়ে রাধিয়া জান-প্রাণ লড়িয়ে দেয় কিন্তু পারে না । কাজের কিছুই পারে না। খাতায় তার নাম উঠে যায় সে প্রতিদিন কাজে যায়, কিন্তু সপ্তাহের দিন সে হাতে পায় এক আনা। কারণ বাকি দুই আনা কোম্পানি কেটে রাখে, রাধিয়া নিরিখের পুরো পাতা তুলতে পারে না।
এইভাবেই চলে তাদের দিন। দারিদ্রতার চরম পরিণতিকে মেনে নিয়ে আর বাঁচার ইচ্ছে থাকে না রাধিয়ার। তারই মধ্যে রাধিয়ার পেটে সন্তান এসে গেলো। এখন কি উপায় ? কাজ তাকে করতেই হবে। পাতা তুলতে যেতেই হবে। একেতো নিজের জীবন চালানো দায়, তার ওপর নতুন মুখের সম্ভাবনা সব মিলিয়ে তাদের জীবন দুর্বিসহ হয়ে ওঠে।
শ্রীচরণ একদিন রাধিয়াকে বলে তারা এই চা-বাগান ছেড়ে পালিয়ে যাবে একদিন। এই চরম দুর্দশার মধ্যে আর এখানে থাকা যাবে না। কিন্তু পালানোর পথ নেই। সারাদিন রাত চা-বাগানের চারদিকে পাহারা চলে। চৌকিদার বসে থাকে, কেউ যদি পালাতে গিয়ে ধরা পড়ে তাহলে তার চরম শাস্তি পেতে হয়। শ্রীচরণ প্রতিদিন রাতে চেষ্টা করে কোনোরকম যদি চৌকিদারের চোখ ফাঁকি দিয়ে পালানো যেতো, তাহলে তারা নিজের মুল্লুকেই চলে যেতো। সেখানেই যদি মরে যেতে হয় মরে যাবে । কিন্তু হয় না, তা আর কোনোদিনই হলো না।
অবশেষে চা-বাগানের শৃঙ্খলের মধ্যেই রাধিয়ার জীবন বাঁধা পড়ে গেলো। চা-বাগানেই রাধিয়ার সন্তানের জন্ম হলো। এতোদিন নিজের ভাবনায় মরেছে রাধিয়া এখন নিজের ভাবনা শেষ, এখন সে তার সন্তানের ভাবনায় মরে প্রতিটা মুহূর্ত। দুজনেরই খাবার জুটে না ঠিকমত, এখন তিনজন হয়েছে। নিদারুণ কষ্টের মধ্যে কাটে তাদের দিন। শ্রীচরণের শারিরীক নানারকম সমস্যা হয়ে গেছে। অপুষ্টিজনিত কারণে সে এখন চোখে কম দেখে, কাজে শক্তি পায় না। সাহেবদের কাছে রিপোর্ট চলে গেছে রাধিয়া আর শ্রীচরণ দুজনেই কাজে ফাঁকি দেয়।
রাধিয়া কাজে যাওয়ার সময় তার সন্তানকে কার কাছে রেখে যাবে, কেউ তো নেই, তাই সাথে করে নিয়ে যায়। একটু কাজ করে আরেকটু নিজের সন্তানের সাথে সময় কাটায়। ভাগ্যে তো মরণ লেখাই আছে, যে কটা দিন বেঁচে আছে তার সন্তানকে সে সময় দিয়েই মরবে, এই তার ভাবনা। ভাবে , মরে গেলে তার সন্তানটিকে কোথায় রেখে যাবে ? এই চা-বাগানে থাকলে তার সন্তানেরও একদিন এইভাবে মরণদশা হবে। কিন্তু অন্য কোনো উপায় নেই যে সে তার সন্তানের জন্য কোনো সুব্যবস্থা করবে । এইভাবেই কাজ করে রাধিয়া সারাদিন কাজ করে সন্ধ্যায় ঘরে ফিরে। সারাদিন কাজ করেও পেট ভরে না তাদের। ভাতের অভাব লেগেই আছে। তার সন্তান একটু বড় হলো। তার কিছু ওজন বেড়েছে। সারাদিন চা-পাতা তোলে রাধিয়া। সকাল থেকে দুপুরে যে পাতা তোলে তা একবার ওজন হয়ে কারখানায় চলে যায়। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত যে পাতা তোলে তা বিকেলে ওজন হয়। বিকেলের ওজনে রাধিয়া তার সন্তানকে পাতার ভেতরে লুকিয়ে দেয়। টুকরিতে চা-পাতার ভেতরে রাধিয়া তার সন্তানকে একদিন লুকিয়ে ওজন করতে দেয়, ভাবে তার সন্তানের ওজন এখন বেশ বেড়েছে, পাতার সাথে তাকে লুকিয়ে ওজনে দিলে, পুরো তিন আনাই সে পাবে। তাই দিয়ে সে তার সন্তানের জন্য গরুর দুধ কিনতে পারবে। তার সন্তান গরুর দুধ খেলে তাড়াতাড়ি বড় হয়ে যাবে। আট বছর হলে তো সেও চা-বাগানে কাজ পেয়ে যাবে। তখন তিনজনের কাজে বেশ চলে যাবে তাদের দিন।
রাধিয়ার কোমল মন এই কথা ভাবতেই পারেনি যে, চা- পাতার ভেতরে তার সন্তানের নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। সে মরে যাবে এ কথা তো তার ভাবনাতেই নেই। সে ভেবেছে বাড়তি আয়ের কথা আর তারই পেছনে যে বিপদ এসে কড়া নাড়ছে সে তার ভাবনায় নেই। রাধিয়া তার শিশুটিকে চা-পাতার ভেতরে লুকিয়ে ওজন দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে আছে মাথায় চা-পাতার বড় টুকরি নিয়ে আর এদিকে কখন যে তার কোলের শিশুটির প্রাণপাখিটি উড়ে চলে গেলো দূর অজানায় সে জানতেই পারলো না । …
৩ নভেম্বর ২০১৯
লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া।
নির্বাহী সম্পাদক