বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দার্জিলিং জেলার মংপু নামক গ্রামে চারবার গিয়েছিলেন। অল্প বয়সে বাবার সঙ্গে তিনি হিমালয় ভ্রমণে গিয়েছিলেন, সেই রেশ তাঁর চোখে মুখে বিস্ময়ের সাথে লেগেছিলো পুষ্পপরাগের মতো। তিনি হিমালয়ের অপূর্ব সৌন্দর্যের কথা ভুলতে পারেননি শেষ জীবনেও। তাই মৈত্রেয়ী দেবীর আমন্ত্রণে তিনি জীবন সমাপ্তির গোধূলি লগনে দার্জিলিং এর মংপু নামক ছোট গ্রামে চার চারবার ছুটে গিয়েছেন অরণ্যের সৌন্দর্য সুধা পানের নেশায়। সেই পাহাড়িয়া নির্জন পথ, পথের ধারে ফোটে থাকা ফুল, অরণ্যের সবুজ সমারোহ, পাহাড়ের গাত্র থেকে থেকে নেমে আসা নির্ঝরিণির কলধ্বনি এসবকিছুই তাকে বারেবারে বাধ্য করেছিলো মংপুতে যেতে। তিনি প্রথম যে বছর গিয়েছিলেন মৈত্রেয়ী দেবীর অরণ্য নিবাসে, সেটি ছিলো সুরেলে। সুরেলের বাংলো বাড়িটিতে প্রথমবার গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। সুরেলের বাড়িটির বৈশিষ্ট্য এমনি যে তাঁর বসবার ঘরের পশ্চিমের জানালা দিয়ে বিশাল পামগাছ দেখা যেতো। সেই পামগাছের ডালপালা ভেদ করে তার নিচেই একটি ক্যামেলিয়া গাছ ফুলে ফুলে সাদা হয়ে থাকতো। সেই ক্যামেলিয়াকে তিনি বলতেন মোমের ফুল। সেই পশ্চিমের জানালার পাশে বসে তিনি লিখতেন সুরেলের বাড়িটিতে। মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর রচনায় লিখেছেন, __ “কতদিন দেখেছি লিখতে লিখতে কলম বন্ধ করে ঐ বিশাল ছায়াময় বনস্পতির দিকে চেয়ে বসে আছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ফুল ভালোবাসতেন সে কথা সবারই জানা রয়েছে; কিন্তু অরণ্যের ফুলেদের প্রতি তার কেমন বিচার, কেমন মনোভাব, কতোখানি মেখে নিয়েছিলেন নয়নের পাতায় অরণ্য পুষ্পরাগ! ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থে ‘ ক্যামেলিয়া ’ নামক একটি বিশাল কবিতায় যে ক্যামেলিয়া কথন ফুটিয়ে রেখেছেন তারই চিত্র। সেই কবিতার চিত্রটি এমন __
যেদিন নেমে আসব তার দু দিন আগে তনুকা বললে,
‘একটি জিনিস দেব আপনাকে, যাতে মনে থাকবে আমাদের কথা —
একটি ফুলের গাছ।’
এ এক উৎপাত। চুপ করে রইলেম।
তনুকা বললে, ‘দামি দুর্লভ গাছ,
এ দেশের মাটিতে অনেক যত্নে বাঁচে।’
জিগেস করলেম, ‘ নামটা কি ?’
সে বললে ‘ক্যামেলিয়া’।
চমক লাগল —
আর-একটা নাম ঝলক দিয়ে উঠল মনের অন্ধকারে।
হেসে বললেম, ‘ ক্যামেলিয়া, সহজে বুঝি এর মন মেলে না।’
দ্বিতীয়বার কবি আবার পুরী থেকে মংপু গেলেন যখন, মৈত্রেয়ী দেবীর বাংলো বাড়িটিতে সেই অরণ্যঘেরা ঘন সবুজের কাছে তখন দেখলেন মৈত্রেয়ী দেবীর একটি বাঁশের তৈরি পুষ্পাধার রয়েছে। নিশ্চয় দেবী সেই পুষ্পাধারে হয়তো পুজোর ফুল তুলে রাখতেন! কীজানি, তা জানা নেই, তবুও মনে মনে এই ভাবনাই ভেসে এলো, নয়তো পুষ্পাধার দিয়ে দেবী কি করবেন ? রবীন্দ্রনাথ সেই পুষ্পাধার দেখে তাকে বলেছিলেন, “ তোমার এই বাঁশের পুষ্পাধারটি ভারি সুন্দর। এইরকম জিনিসেই ফুল মানায় ভাল ___ সৌ্খিন দামী পাত্রে ফুলকেও যেন সাজাতে চায় ___ একটু বেশিরকম বাড়াবাড়ি সেটা। আমি তাই মাটির পাত্রে ফুল রাখতে চাই, এ তোমার আরো ভালো। কী এই নীল ফুলের নাম ? ফুলের নীল রংটাই আমার ভালো লাগে বেশি __ ভালো দেখতে পাই, কে এ বিদেশিনী ?”
এই প্রশ্নটি তিনি মৈত্রেয়ী দেবীকে করেছিলেন। দেবী প্র্ত্যুত্তর করেছিলেন, “ এর নাম জ্যাকারান্ডা।” জ্যাকারান্ডা ! বলো কী ? এমন সুকুমার রূপে এমন দন্তবিমর্দিনি নাম! তোমরা হলে শিক্ষিতা মালিনি, তোমাদের এসব নাম মনে থাকে। আমি একেবারেই মনে রাখতে পারি না। একটা জানি __ কারনেসান। বিদেশি ফুলের নাম তিনি মনে রাখতে পারেন না, এ কথা দেবীর কাছে অকপটে স্বীকার করেছেন। সে কথাও বলে ফেললেন কেবল মাত্র একটি বিদেশি ফুলের নাম তিনি মনে রাখতে পেরেছেন ‘ কারনেসান’। তাঁর যে নীল ফুলের রং খুব পছন্দ সেও বলেই ফেললেন। ফুল পিয়াসি মন কবি, বসে বসে সেইসব অরণ্যের ফুলের সৌন্দর্য পান করতেন। কাচের দেওয়ালেরর ওপাশে দুটি হলিহক ফুটেছিলো, আর তারই পাশে সারিবদ্ধভাবে ফুটেছিলো হলুদ রঙের অজস্র ফুল। তাই দেখে কবি বললেন, “ তোমার এই হলদে ফুলের সারিটি কিন্তু অতি অপরূপ হয়েছে, আমি বসে বসে শুধু দেখছিই। কি ফুল এ ? কোনো অভিজাতবংশীয়া নিশ্চয়?” সেই হলুদ রঙের সারিবদ্ধভাবে ফুটে থাকা ফুলগুলো অরণ্যের ফুল। কোনও অভিজাতবংশীয়া নয়! সেই ফুলের নাম জানা গেলো ‘বন্য লিলি’। এই বন্য লিলিকেই কবির কাছে অভিজাতবংশীয়া মনে হয়েছিলো সেই অরণ্যের কাছে বসে।
ফুল পিয়াসি কবি মৈত্রেয়ি দেবীকে বলেছিলেন, “ তোমার চাকরদের দয়া করে বুঝিয়ে দাও এমন করে একটা পাত্রে এতোগুলো ফুল না গুঁজে দেয়। ওই দেখো না মহাদেব এইমাত্র ওই ফুলগুলোকে রেখে গেল। এতোগুলোকে একসঙ্গে গুঁজে দিলে ওদের প্রত্যেকের জাত মারা হয় __ ওতে প্রত্যেকেরই বিশিষ্টতা নষ্ট হয়। তোমাদের সিঁড়ির টবে এগুলো কি ফুল ? এদের কথা লিখতে হবে।” “এগুলো জিরোনিয়াম”। “ এই বুঝি জিরোনিয়াম ? গল্পে পড়েছি। এই ফুল ওরা জানালার সীলের উপর রাখে।” এই ওরা কারা ? তিনি জাপানিদের কথা বলেছেন। বলেছেন জাপানিরা ফুল সাজায় ভালো। কে বা কারা ফুল ভালো সাজায় এই এতোবড় বিশ্বে তাও তিনি নিখুঁত চোখে দেখেছেন। এ কেমন ফুলের প্রীতি ? এ তো যেমন তেমন প্রীতি নয়। একবার মংপুতে থাকাকালীন সময়েই তাঁর জন্মদিন পঁচিশে বৈশাখ চলে এলো। মৈত্রেয়ী দেবী ভাবনায় পড়ে গেলেন। মংপু যে পুরোপুরি একটি গ্রামও নয়, একটা গভির অরণ্য মাত্র। কিছু জংলী পাহাড়ির দল আর মাত্র দু’তিন ঘর বাঙালি রয়েছে। এখানে কি করে বিশ্বকবির জন্মদিন পালিত হবে! তবুও তারই মাঝে কবির জন্মদিনের আয়োজন করা হলো। সকালবেলা স্নান করে কালো জামা কালো রঙের জুতা পরে বাইরে বসলেন কবি। পাহাড়িয়ারা সানাই বাজাতে লাগলো। ঠেলা চেয়ারে কবিকে বসিয়ে বাড়ির পথ দিয়ে ধীরে ধীরে নিয়ে যাওয়ার সময় পাহাড়িরা প্রণত হয়ে ফুল দিতে শুরু করলো। ফুলে ফুলে ভরে গেলো কবির সমস্ত মন-প্রাণ; লিখলেন কবিতা। নিজের জন্মদিনের কবিতা।
“ অপরাহ্নে, এসেছিল জন্ম বাসরের আমন্ত্রণে
পাহাড়িয়া যত।
একে একে দিল মোরে পুষ্পের মঞ্জরী
নমস্কার সহ।
ধরণী লভিয়াছিলো কোন ক্ষণে
প্রস্তর আসনে বসি
বহু যুগ বহ্নিতপ্ত তপস্যার পরে এই বর,
এই পুষ্পের দান।”
এই কবিতাংশটিতেও রয়েছে ফুলের কথা। ফুলের প্রতি কেমন পিয়াসি ছিলেন, তাঁর রচনাই তার প্রমাণ। এই কবিতাটি লিখেছিলেন তাঁর জন্মদিনে, মংপুতে বসে। সেইবার মংপুতে অরণ্যের গভীরে বাংলো বাড়িতেই যখন জন্মদিনের উৎসব হলো, তখন সেই মংপুর পাহাড়িয়াদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিলো। তারা এসে কবিকে ফুলের শুভেচ্ছা জানিয়েছিলো এবং নাচ-গানের আসর জমেছিলো। সেই সহজ-সরল মানুষগুলোর ফুলেল শুভেচ্ছায় কবি মগ্ন হয়ে লিখেছিলেন এসব কবিতা। তিনি নিজেই তাঁর রচিত কবিতায় বলছেন, “বহু যুগ বহ্নিতপ্ত তপস্যার পরে এই বর,এই পুষ্পের দান।” অর্থাৎ তাঁর এই যে আজকের প্রাপ্তি তা অনেক সাধনার পরে লাভ করেছেন। এমন তপস্যা সাধন না করলে এমন সহজ মানুষগুলো কি করে বুঝলো, যে তাঁকে এইভাবে প্রণত ফুলের শুভেচ্ছা জানাতে হবে! এমন কঠিন তপস্যার ফল যে বড় দুর্লভ। যার লাভ হয় তারই হয়। কবি গুরুর সেই লাভ হয়েছে। তিনি এমন সহজিয়া মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত হতে পেরেছিলেন।
দ্বিতীয়বার যখন মংপু ত্যাগ করবেন, তখন মৈত্রেয়ী দেবী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ এবার কি রিয়াং থেকে ট্রেনে যাবেন ? নদীর পাশ দিয়ে ট্রেনের পথ অনেক সুন্দর কিন্তু।” কবি বলেছিলেন সেই পথেই যাবেন। মংপু থেকে রিয়াং স্টেশন সাত মাইল দূরে। সিনকোনা কাননের ভেতর দিয়ে যেতে হয় সেখানে। ভারি মনোরম পথটি। একে তো সেই ট্রেন, ‘ টয় ট্রেন ’, তারপরে লাইন এঁকে বেঁকে নেমেছে পাহাড়ের গা বেয়ে। ছোট একটি কাঠের ঘরের মধ্যে স্টেশন মাষ্টারের আস্তানা। সজনে গাছের নিচে পাহাড়িদের চায়ের দোকান। ট্রেন স্টেশনে আসতে তখনো কিছুটা দেরি ছিলো। কবির জন্য একটি হাতলবিশিষ্ট চেয়ার যোগাড় করে প্ল্যাটফর্মের কাঁকরের উপর বসতে দেয়া হয়েছিলো। সামনে উদ্ধত পাহাড় গভীর অরণ্যের বুক করে দাঁড়িয়ে থাকা, নিচে স্রোতস্বিনী কলভাসিনী নদী, মাঝখানে বসেছিলেন জগতের মহাকবি। ধূসর রঙের জোব্বা পরিহিত, মাথায় ছিলো কালো টুপি, আর হাতে ফিরতি পথে থেকে নিজের হাতেই সংগৃহীত সিনকোনা কানন থেকে একগুচ্ছ ফুল। সেই সিনকোনা ফুল হাতে বসেছিলেন সেদিন কবি রিয়াং স্টেশনে, তাঁকে দেখতে কিছু মানুষের ভিড় জমে গেলো। সেই সিনকোনা ফুলেরা হয়তো এখনো ফুটে আর ঝরে দার্জিলিং রিয়াং এর পথে, সিনকোনা ফুলের পূজারী আজ সুদূরের পিয়াসি।
নির্বাহী সম্পাদক